রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-১৩)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৩ মার্চ, ২০১৪, ০৩:১১:৩০ দুপুর
পর্ব-১২
প্রদীপ বাবুর আশাবাদী কথায় মফিজ সাহেব খুব উৎফুল্ল। পরদিন লেজার ডিপার্টমেন্টে যোগ দেয়ার মাধ্যমে এ শাখা মফিজ সাহেবের কর্ম যাত্রা শুরু হল। আগ্রহ উদ্দীপনা নিয়েই কর্মব্যস্ত হয়ে পড়লেন। একদিকে এনার্জেটিক ও চঞ্চল। অন্যদিকে সম্ভাবনাময়ী জায়গায় যোগদান। সব মিলিয়ে প্রথম ১৫-২০ দিন মফিজ সাহেব কর্মের মাধ্যমে সবার দৃস্টি আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছেন। প্রদীপ বাবু ও অনেকটা হাফ ছেড়ে বাচঁলেন। যাক বাবা, আমার জায়গায় একজন লোককে সেট করতে পারলাম।
কিন্তু যে উদ্দেশ্য মফিজ সাহেব এ ডিপার্টমেন্টে যোগ দিয়েছেন, সেটির কোন আলামত এখনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। সপ্তাহ, মাস সবই পেরিয়ে গেল। প্রদীপ বাবুর কথানুযায়ী কিছুই মিলছেনা। মফিজ সাহেব কিছুটা হতাশার কথা প্রকাশ করতেই প্রদীপ বাবু আবারও আশ্বস্ত করে বলেন
- হায়রে মফিজ সাহেব! আপনি একজন পুরোনো ষ্টাফ। আপনারতো এসব বুঝা দরকার। কয়দিন হল এ শাখায় এসেছেন মাত্র। পরিচিতির পর্বটাও এখনও শেষ হয়নি। আপনি কি জিনিষ -কর্মদক্ষতা দেখে লোকেরা বুজতে শুরু করেছে মাত্র। সবার সাথে আন্তরিকতার ভীত এক দিনে তৈরী হয়না। সে সময় পর্যন্ততো অন্তত অপেক্ষা করতে হভে।
এটাতো আপনি ভাল করে জানেন যে, অজানা কাউকে কেউ খুশী হয়ে দশ টাকা দিতেও তো ভয় পায় । না জানি লোকটা মাইন্ড করে বসে। এশাখায় যোগ দেয়ার প্রথম দিকে আমারও এমন হয়েছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে দেখুন, আমাকে লোকেরা কত পছন্দ করে।
আমিতো জেনেছি যে, চকবাজার শাখায় আপনি একজন জনপ্রিয় লোক। এ্টি কি একদিনে করতে পেরেছেন?
- মফিজ সাহেব মাথা নেড়ে না জবাব দেন।
প্রদীপ বাবু আরও বলতে লাগলেন, আমিতো আর একদিনে এ অবস্থান তৈরী করিনি। গতকালও এক কাষ্টমার আমাকে জিজ্ঞেস করছিল,
- প্রদীপ বাবু। আপনি সরে গেলেন কেন লেজার থেকে? আপনি থাকলে আমাদের জন্য খুব ভাল হত।
আমি কি বলেছি জানেন? - না না। আমার জায়গায় কাজ করা মফিজ সাহেব খুব ভাল এবং মাই ডিয়ার লোক। আমার বিশ্বাস, একটা সময় আসবে, ওর সাথে আপনাদের সম্পর্ক আমার চেয়েও গভীর হবে।
- ঠিক বলছিনা মফিজ সাহেব? প্রদীপ বাবু যুক্তির স্বপক্ষে জানতে চায়।
- মাথা নেড়ে মফিজ সাহেব আবার ও হ্যা উত্তর দিয়ে নীরবে চলে যায়। আবারও শুরু হয় অপেক্ষার পালা।
সেদিন ছিল লাঞ্চের সময়। কয়েকজন মিলে অফিসে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে মফিজ সাহেব প্রদীপ বাবুকে লক্ষ্য করে হাসতে হাসতে বলেই ফেললেন,
- প্রদীপ বাবু। জীবনের অনেক লোক দেখেছি। কিন্তু আপনার মত এত চালাক লোক দেখিনি। মানুষকে পটানোতে দারুণ ওস্তাদ।
- কেমন? প্রদীপ বাবু না জানার ভান করে জানতে চাইল।
এইযে আপনি পাম্প দিয়ে আমাকে লেজারে ঢুকিয়ে দিলেন, এখনতো দেখছি হাড্ডিও মিলেনা। সব কিপ্টার হাড্ডি। আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে পানিও পড়েনা।
মফিজ সাহেবের কথা শূণে উপস্থিত সবাই অট্রাহাসিতে ফেটে পড়ল। মফিজ সাহেব ও হাসছে। দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর জন্য প্রদীপ বাবু আবারও বলতে লাগল
- মফিজ সাহেব। এখনতো ব্যবসা মন্দা। বড় কাষ্টমার যারা, নিজে না এসে কর্মচারীদের পাঠিয়ে দেয়। আপনি আর একটু ধৈর্য্য ধরুন।তখন ঠিকই আমার কথা বলবেন।
- থাক। আমাকে আর পাম্প দিতে হবেনা। অনেক হয়েছে।
মফিজ সাহবের সাথে কাজ করে মোস্তাক সাহেব। ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারে বড়ই ডানপিঠে। লজ্জা শরম নাই বললেই চলে। উপরির জন্য পাগল। ওর কথা হল, যে বেতন পাই, ঘুষ না খেলে চাকরি করে লাভ নেই। মোস্তাক সাহেবের ঘুষ খাওয়ার ধরনটা একটু ভিন্ন টাইপের। কাষ্টমারের একউন্টে হয়তবা পাচঁ হাজার দুইশত টাকা আছে। মোস্তাক সাহেব কাস্টমারের অবয়ব দেখে বুঝে নিত, এটাকে শিকার করা যাবে কিনা। হিসেবে মিলে গেলে ইশারা দিয়ে পেছনে ডেকে নিয়ে যেত। আস্তে করে বলত,
- দেখুন। আপনি চেক দিয়েছেন পাচ হাজার টাকার। হিসেবে আছেই মাত্র পাচহাজার দুশত। পুরোটা উঠিয়ে নেয়ার বৈধতা বাংকে নেই। হিসাব চালু রাখার জন্য নুন্যতম পাচশত টাকা হিসেবে আপনাকে রাখতেই হবে। আমি পোস্টিং দিতে গেলেই স্যার আমার উপর রাগ করবে। দস্তখত দেবেনা। উড়িয়ে ফেলে দেবে।
বেচারা কাষ্টমার! একদিকে চেক লিখা হয়ে গেছে। ফেরত নিয়ে আবার লিখে ফেরত আসার সময় হাতে নেই। অন্যদিকে প্রয়োজনীয়তা বলতে কথা। ব্যাংকের পদ্ধতি। কিছু করার ও নেই। তাই মলিন মুখে জানতে চায়
- তাহলে কি করতে হবে স্যার?
- জানিনা কি করব - মোস্তাক সাহেব গাম্ভীর্যতার সাথে জবাব দেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করার ভান করে জবাব দেন, এক কাজ করুণ। ৩০-৪০ টাকা দিন। চা পানি এন স্যার আর ক্যাশিয়ারকে খাওয়াব। বলব, স্যার এটা আমার পরিচিত। এ সপ্তাহে আবারও টাক জমা করে দিবে। এখন খুব দরকার। বেচারাকে সাহায্য করুন।
- বেচারা! উপায় নেই। অবশেষে বলতে বাধ্য, ঠিক আছে স্যার। আপনি যা ভাল মনে করেন।
মোস্তাক সাহেব পিয়ন আহমেদকে ডেকে চায়ের অর্ডার দিল। চা আসল। নিজে খেল। স্যারকে ও দিল। উপরি বিশ টাকা নিজ পকেটে জমা করল।
প্রদীপ বাবু বলছে, দাখেন মফিজ সাহেব। আপনার সাথে কাজ করা মোস্তাক সাহেবকে কিন্তু কেউ পছন্দ করেনা। কারন ও সরাসরি ঘোষ খায়। কাজেই এজন্য কাস্টমারগন আমাকে বেশী পছন্দ করতে। মোস্তাক সাহেবের সাথে প্রতিযোগীতা করে আপনার অবস্থান নিজেকেই তৈরী করতে হবে। আমিতো আছি। যে কোন সহযোগীতা লাগে, এ বান্দা আগে হাজির।
মফিজ সাহেব এসবের ধার ধারেনা। তবে হিসেবের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। একদিন কোন এক কাজে জুবিলী রোড শাখায় কাজে যাচ্ছিলেন। ব্যাংক হতে ৫ মিনিটের রাস্তা। সেকেন্ড অফিসার খায়ের সাহেব ডেকে বললেন
- মফিজ সাহেব। আমার এ কাগজটুকু নিয়ে যান। জুবিলী রোড শাখার ম্যানেজারকে আমার কথা বলে দিয়ে আসবেন শুধূ।
- ঠিক আছে স্যার বলে মফিজ সাহেব কাগজ হাতে বিদায় নিলেন।
বিশ মিনিট পর মফিজ সাহেব নিজ কাজও সেরে ফিরে এসেছেন। ব্যাংকে ঢুকেই খায়ের সাহেবকে বললেন, স্যার আপনার কাগজটা দিয়ে এসেছি।
- ধন্যবাদ। খায়ের সাহেব জবাব দিলেন।
স্যার এ পিটি ক্যাশ ভাউচারটায় আপনার একটা দস্তখত দরকার।
খায়ের সাহেব পিটি ক্যাশ ভাউচার দেখে বিস্মিত।
- এটি কি মফিজ সাহেব?
- স্যার পিটি ক্যাশ ভাউচার।
- দশ টাকার ক্যাশ ভাউচার কি জন্য?
- স্যার আমি যে আপনার দেয়া কাগজ জুবিলি রোড শাখায় দিয়ে এসেছি, এটির পারিশ্রমিক।
- তার মানে? এ সামান্য কাজের জন্য আপনাকে দশ টাকা দিতে হবে?
- আচ্ছা স্যার। আমি আপনাকে একটা কথা বলি। আমি আপনার জুনিয়র। স্যার হিসেবে আমাকে একটা অর্ডার দিয়েছেন। আমিও শ্রদ্ধার সাথে কাজটি করে এসেছি। আমি ছোট ভাই হিসেবেও তো চা পানির জন্য আপনার কাছে দশ টাকা চাইলে অবশ্যই মানা করতেন না। তাহলে একটি কাজের বিনিময়ে আমি দশটা টাকা চেয়েছি। এ্টি কি আমার অপরাধ স্যর? তাছাড়া টাকাটাতো আর আপনার পকেট থেকে দিচ্ছেন না।
- মফিজ সাহেবের কথা শুনে খায়ের সাহেব হেসে দিলেন। বললেন, নিয়ে যান। দস্তখত করে দিলাম। তবে আজ থেকে আপনাকে আর কোন কাজ দেবোনা।
শাখায় ব্যাংকের অনেক গুলো ক্যালেন্ডার এসেছে। কিন্তু বন্টনের পর আর একটিও বাকী নেই। সব ষ্টাফরা মাত্র একটি করে পেয়েছে। ক্যাশিয়ার আলী সাহেব বড় দুস্ট প্রকৃতির। জোকার টাইপের। সামান্যতেই অন্যকে হাসাতে ওস্তাদ। তার একটি ক্যালেন্ডার বড় প্রয়োজন। তাই তিনি সোজা ম্যানেজারের রুমে চলে গেলেন। বললেন,
- স্যার। আমরাতো ব্যাংকে চাকুরী করে এক মহা বিপদে আছি। বন্ধু বান্ধবেরা মনে করে যে, প্রত্যোকে ৮-১০টা করে ক্যালেন্ডার পেয়েছি। অথচ পেয়েছি মাত্র একটি। বলুনতো এদেরকে ক্যামনে বুঝাই।
স্যার। আপনার পেছনে দেয়ালো ঝূলানো ক্যালেন্ডারটা কি দয়া করে ১০ মিনিটের জন্য দেবেন?
- কেন? দশ মিনিটের জন্য নিয়ে আপনি কি করবেন?
- ভাবছি জুবিলি রোডে ফটোকপির দোকানে গিয়ে ৮-১০টা কপি করব । বন্ধু বান্ধবকে দিয়ে বলব, দ্যাখ। চাকুরী করলেও ব্যাংকে কিন্তু একটির বেশী আমার ভাগ্যে জুটেনি। আসল ক্যালেন্ডার দিতে না পারলেও অন্তত ফটোকফি নিয়ে এসেছি।
- কি বলেন স্যার? সমাজে বন্ধু বান্ধব নিয়ে চলতে গেলে সামাজিকতা রক্ষায় এ ছাড়াতো আর বিকল্প কোন পথ নেই।
- স্যার হেসে দিয়ে বললেন, আলী সাহেব। আপনাদের সাথে আর পারলামনা। এই নিন। সাথে আরও দুটো আমার পক্ষ থেকে আপনাকে দিয়ে দিলাম।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৫৭৭ বার পঠিত, ৫৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ আর অভিনন্দন আমাকে।
ধন্যবাদ।
২৩ মার্চ ২০১৪ দুপুর ০৩:২৫
অর্থাত প্রথম মন্তব্যটি করা হয়েছে ১৪ মিনিট পর. আওণ রাহ'বার পড়ে করুক বা না পড়ে করুক তিনি কিন্তু ফাস্টু. তাঁকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ
ধন্যবাদ।
জীবনের চাওয়া যেটুকু ছিল তুমি বঞ্চিত করনি
প্রতি পদক্ষেপে সাথে ছিল পূণর্তার ছোঁয়া
অতি উচ্চস্তরে আসন দিয়েছ
না চাইতে দিয়েছ পৃথিবীর আলো দেহ প্রাণ
তোমার মহাদানের অকৃপণ ঋণী....
অতৃপ্ততা নিয়েই আমরা বেচে আছি।
ধন্যবাদ।
জীবনের চাওয়া যেটুকু ছিল তুমি বঞ্চিত করনি
প্রতি পদক্ষেপে সাথে ছিল পূণর্তার ছোঁয়া
অতি উচ্চস্তরে আসন দিয়েছ
না চাইতে দিয়েছ পৃথিবীর আলো দেহ প্রাণ
তোমার মহাদানের অকৃপণ ঋণী....
অতৃপ্ততা নিয়েই আমরা বেচে আছি।
আপনার গল্পটা যে দিকে এগুচ্ছে তার সাথে আমাদের সমাজের চিহৃগুলো বলা প্রয়োজন।
ধারাবাহিক প্রতিটি লিখাতে কিছু না কিছু পাই। আশেপাশের এই চিত্র দেখে বড় হয়েছি। আপনার লেখাতে তা পড়ছি।
কিন্তু একটি বিষয় - আপনার শাখায় এমন কেউ নাই - যাকে আপনি অনুসরণ করেন।আপনার পাঠক অনুসরণ করে। প্লিজ অন্য দশজনের মত করে আপনি লিখাকে পাঠক প্রিয়তার দিকে নযর দিবেন তা হয় না। বরং সামাজিক দায়িত্ববোধটা কাজে লাগাবেন। আশা করছি এবং প্রত্যাশা ও করছি।
ধন্যবাদ এ ব্লগ বাড়ীতে এ প্রথম আসার জন্য।
কোন দুঃখে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়েছিলাম। তার চেয়ে ঘুষ দিয়ে হলেও যদি সরকারি ব্যাংক এ একটা চাকরি নিতাম।
বর্তমানে এক বিখ্যাত শিল্প গোষ্ঠির চেয়ারম্যান একসময় খাতুনগঞ্জের এক ব্যাংক শাখায় চাকরি করতেন। সেই ইনকাম থেকে তিনি এখন বিরাট শিল্পপতি।
গোলাম আযম সাহেব বলতেন যোগ্যতা ছাড়া সততা অথর্ব
আর সততা হীন যোগ্যতা ভয়ংকর.।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাকে...........
ধন্যবাদ্।
ভাই
লেখনির জন্য অনেক ধন্যবাদ
আগ্রহ চাগায়া দিলেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন