রাতের গরুর হাট দর্শনঃ
লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ০৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:২১:৪০ রাত
রাত প্রায় ১২ টা ছুঁই ছুঁই। এক বড় ভাইয়ের ফোন। গরু দেখতে যাবেন,পছন্দ হলে কিনে ও ফেলতে পারেন। এত রাতে? না বলে দিব ভাবছি, উনার এক কথায় মত পালটালাম। বললেন, 'এমনিই জিজ্ঞেস করছি, তোমার পক্ষে তো মনে হয় সম্ভব হবে না সারারাত হাঁটাহাঁটি করে গরু দেখা আর গরু কিনা। অনেক কষ্টের কাজ, কিন্তু উপায় নেই। '
সম্ভব হবে না!! অনন্তের পক্ষে সব সম্ভব হলে আমরা পিছিয়ে থাকব? হু ! বললাম - চলেন।
জানালেন ৩ টা কারনে রাতে গরু কেনা বুদ্ধিমানের কাজ। প্রথমত, রাস্তা ঘাট ফাঁকা থাকে বলে আরামে যাওয়া যায়। ২য় কারন রোদ থাকে না আর শেষটা হল ক্রেতার অভাবে দাম কম থাকে। রোদ না পেলেও বাকি দুটোতে মহা ধরা খেয়েছি।
গতকালের এক পোস্টে বন্ধুরা পরামর্শ দিল সিডিএ মার্কেটে যেতে। ৩ কিমি মত হবে। জিইসি মোড় পেরোতেই পড়লাম মহা জ্যামে। গাড়ি ফেলে হেঁটেই যেতে হল পুরো রাস্তা। এত জ্যাম যে এক যায়গায় দেখলাম এক ট্রাক গরু দাঁড়িয়ে। রাস্তার উপর এক গাছের বেশ বড় এক অংশ ট্রাকের উপর এসে পড়েছিল। গরুগুলো সময় কাটাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বড় ডাল ছাড়া সব খেয়ে ফেলেছে।
জ্যামের মধ্যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার বিপদজনক দিকটা হল- বাস, ট্রাক আর উঁচু গাড়িগুলোর জানালা দিয়ে যে কোন সময় গায়ের উপর এসে পড়তে পারে মানব মুখ নিঃসৃত পিচ্ছিল পদার্থ। উপস্থিতি জানান দিতে জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছি আর গান গাইছি। এটা থেকে বেঁচে গেলেও আক্রমণটা এল ভিন্ন দিক থেকে। প্রাইভেট কার এর জানালা দিয়ে এক মহিলা সশব্দে বমি করছেন। জ্যাম, ধোঁয়া আর গরমের ফল। অল্পের জন্য রক্ষা পেলাম।
এমন কোন বুদ্ধি আছে যে গরু নিয়ে কেউ বাসায় যাবে আর তার দাম জিজ্ঞেস করা হবে না? গোপাল ভাঁড়ের বুদ্ধি ছাড়া অবশ্য।
গরু নিয়ে আশ পাশ দিয়ে লোকজন যাচ্ছে।
ঃ ভাই দাম কত?
ঃ ৪০ হাজার। কি ভাই জিতলাম না ঠকলাম?
৬০ হাজার টাকার গরু ৪০ হাজারে? সবাই খুব ঈর্ষাকাতর চোখে তাকাচ্ছে।
গরু ধরে আছে একজনের টিপ্পনী কানে এল, দাম কম বলে দেখেছিস সবাইকে কেমন জেলাস করে দিচ্ছি!! কর আরও জিজ্ঞেস কর!!
মোটামুটি একটা বড় গরু নিয়ে এক লোক যাচ্ছে। কিছু বলার আগেই হাসি মুখে দাম বলতে বলতে যাচ্ছে -
ঃ এক লাখ ৪২ হাজার টাকা, বুঝলেন ভাই? অনেক বড় গরু না?
এই লোক নিশ্চিত আগামি ইলেকশনের জন্য মেজবান দিবে। দেখানোর যে প্রবনতা দেখছি!!
ছোট একটা গরু আসছে। ভাই দাম কেমন পড়ল?
ঃ ৮০,০০০ টাকা।
ঃ এত ছোট গরু ৮০,০০০?
ঃ ছোট ছোট সব ফ্লাই ওভারে এত বেশি টাকা খরচ করল, ছোট গরুতে বেশি টাকা খরচ করলে কোন সমস্যা?
ঃ ভাবসাব দেখে বলতে হল, না ভাই। অসাধারন গরু। খুব ভালো হয়েছে।
গরুর দাম জিজ্ঞেস করতে করতে হাটের মুখে এসে পৌঁছলাম।
সিডিএ হাটটা কয়েক ভাগে বিভক্ত। খালি জায়গাগুলোতে আলাদা আলাদা হাট বানানো হয়েছে। রাস্তা ঘাটেও অবশ্য গরু বিক্রি হচ্ছে। প্রথম যে হাটটাতে ঢুকলাম, মুখে লেখা - কুষ্টিয়া, নাটোর আর চাপাই নবাবগঞ্জের বড় গরুর বাজার। গরু বড় নাকি বাজার বড় বোঝা গেল না অবশ্য। হাটের অর্ধেক খালি। গরু যে কয়টা আছে, অর্ধেক জাবর কাটছে আর অর্ধেক ঘুম ঘুম ভাব। লোকজন অনেকে বাঁশের মাচা করে ঘুমাচ্ছে।
একটা গরু পছন্দ হল। ভাই দাম কত? বিক্রেতা গরুর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন।
ঃ ৮০,০০০ টাকা। অনেকে বিশ্বাস করবে না হয়ত, দামটা বলার পরই গরুটা পিছনের পা দিয়ে দিল একটা লাথি। লাথিটা পুরো লাগলে খুশি হতাম , পায়ে হালকা আঁচড় কেটে পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। এই গরুর দাম ৫০ হাজারের বেশি হবেই না।
আমি মিথ্যা শুনে গরুর রি-একশন দেখে হাসতে হাসতে কুটিকুটি।
একটা ছাগল ও দরকার। অদুরে ৪/৫ টা ছাগল দাঁড়িয়ে। মাঝখানে একটা গোলগাল ছাগল দেখতে পাচ্ছি, পছন্দ হল। বেশ অন্যরকম একটা ডিজাইন। সাদার উপর কাল বুটি বুটি। এইটা আমার চাই। সবাইকে অবাক করে দিব। ভাই, ওই ছাগলটার দাম কত?
ঃ দূর ভাই, ওইটা ছাগল নাকি? ওইটা আমার ছোট ভাই, ছাগলদের মাঝখানে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
সাদা-কাল টা কাঁথার ডিজাইন!! দেখে নিলাম আশ পাশে কেউ শুনে ফেলেছে কিনা।
থাক, আগে গরুই দেখি। একটা গরু বেশ সুন্দর দেখতে। ভাই গরুটার দাম কত?
ঃ ফিক্সড দাম ৫৫,০০০ আর দরাদরি করলে বেশি।
চেষ্টা করে দেখি, ভাই ৪৫,০০০ দিবেন?
ঃ দাম করলে ৬০,০০০। চোখ পাকাল লোকটা। বাপরে, দাম বেড়ে গেল! থাক তুই তোর ফিক্সড দাম নিয়ে। বের হলাম ওই বাজার হতে। আরেকটা বেশ বড় বাজারে ঢুকলাম।
ঢুকার মুখে এক অল্প বয়সি ছেলে, গরু নিয়ে মাত্র এসেছে। গরুটা সুন্দর, কিন্তু ৫০,০০০ হাজারের গরুর দাম বলছে ৭৫,০০০। কথা বলেই বুঝলাম লোকাল ছেলে। তার মানে দালাল। কোন সাদসিধা গরুর বেপারিকে পটিয়ে কম দামে কিনেছে। এখন ২/৩ ঘণ্টার মধ্যে ১০/২০,০০০ টাকা লাভ। ভালই ব্যবসা। আবার বেচে আরেকটা নিবে। ২/৩ দিনে যা কামাতে পারে। লোভের জন্য অবশ্য সে সারা রাতই গরুটা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সকালে বেরোবার সময় ও দেখা হল।
হালকা বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা বেশ খারাপ। গরুর গোবর, মুত্র আর বৃষ্টির পানি সব মাখামাখি। মাঝে শুধু একটাই সরু ভালো রাস্তা। এগোতে পারছি না, সামনে অনেক মানুষ জন। আমার সঙ্গী বলল, দাঁড়ান রাস্তা খালি করি। হাঁক দিল -
ঃ এই গরু আসতেছে, পাগলা গরু। সরেন, সরেন......।।
মুহূর্তে সামনের সবাই গোবরের মধ্যে নেমে গেল। আমরা সুন্দর করে হেঁটে এগোলাম। ২/৩ জন দেখার চেষ্টা করছে, কে পাগলা গরুর ডাক দিল। আমাদের আর পায় কে......
কুষ্টিয়ার এক লোক ২ টা গরু নিয়ে দাঁড়িয়ে। ১ টা পছন্দ হল। দাম কমিয়ে নিয়ে ফেললাম। গরু নিয়ে হাঁটছি বিক্রেতার সাথে। হাটের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। লোকটা বেশ সরল। বলল,
ঃ ভাই, কিছু মনে নিয়েন না। ৫৯ টা গরু আনছিলাম। ৫৭ টা দুপুর থন রাইত এর মইধ্যে বেইচে দিছি। প্রত্যেকটায় ৫-১০ হাজার টাকা লস দিছি। ভয় পাইছিলাম, কাল থেইক্যা কেউ কিনতাছিল না। যে যা রেইট বলছে, দিয়া দিছি। একেকটা গরু আনতে খরচ হইছে ৩৫০০ টেকা, বাজারে নিছে ৪০০০। আরও ২০০০ অন্যান্য খরচ। সব লস। শুধু আপনার গরুতে এই পরথম লাভ করলাম। বাজারে এখন গরু কম, দাম বাড়তি হইছে।
আমার নিজেকে একটু বোকা বোকা লাগলেও সান্ত্বনা দিলাম নিজেকে - লোকটা বেচে খুশি হয়েছে। গরুও সুন্দর আছে। কপালে যা আছে আর কি......
গেটের কাছে হাসিল নেবার জন্য লোকজন বসা। ১০০০ টাকায় ৫০ টাকা। আমি আসল দাম বলাতে চেয়ারে বসা ছেলেগুলো একটু অবাক।
ঃ ভাই, বিশ্বাস করবেন না। এক লাখ টাকা দিয়ে গরু কিনে, ৫০০০ টাকা হাসিল দিতে চায় না। ১০০০ টাকা বাঁচাইতে মিছা কথা বলে, গরুর দাম বলে ৮০,০০০। (প্রতি ২০,০০০ টাকায় ১০০০ টাকা হাসিল- দিতে হয় হাটের ইজারাদারদের)। বেশির ভাগ লোক কমাইতে চায়।
এই মিথ্যাটায় কোরবানির ক্ষতি হবে কিনা আমার জানা নেই। বের হলাম হাট থেকে।
ফজরের আজান দিচ্ছে। বড় ভাইয়ের কথায় লাফাতে লাফাতে আসছি। সারা রাত গরুদের সাথেই কাটল। শরীরে আর শক্তি নাই। ইচ্ছা হচ্ছে গরুটার পিঠে চড়েই বাসার দিকে রওনা দেই...............।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৮ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
দুর্দান্ত লিখনির দ্বারা-ই এটি সম্ভবপর হয়েছে।
খুব ভালো লেগেছে লিখাটি।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
আমার অভিজ্ঞতা আগামীকাল হতে পারে।
ধন্যবাদ শুভেচ্ছার জন্য এবং শুভরাত্রি।
ও হ্যা, একটা ভূতের গল্প লিখতে বসেছি। সবাই ঘুমে। কল্পনায় ভয় আনতে গিয়ে নিজেই ভয়ে এখন বাথরুমেও যেতে পারছি না )
দুপুর ১টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সিডিএতে ঘোরাঘুরি করেও গরু পা্ইনাই। পরে আরেক জায়গা থেকে কিনছি!!! সুন্দর ছাগলটা কিনতে পারলেন না!!!!
গরুও নিজের উপযুক্ত দাম বুঝে!!!
ঃ দূর ভাই, ওইটা ছাগল নাকি? ওইটা আমার ছোট ভাই, ছাগলদের মাঝখানে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।
কালকেই পড়েছি আর আমি হাসতে হাসতে কেন্দে দিছিলুম উপ্রের লাইনটা পড়ে!
ঈদ মোবারক!
মন্তব্য করতে লগইন করুন