ঝিল পাড়ে একদিন
লিখেছেন লিখেছেন নাসিমা খান ১৭ আগস্ট, ২০১৩, ০৫:৩৩:২৫ বিকাল
নাসিমা খান
দৃষ্টি নত করে বসেছিল চাঁদোয়া, লজ্জা তার রাঙ্গা ঠোঁট আরও রঙ্গিন করে ঘোষণা করলো ভালোবাসি, আকাশ থেকে খসে পড়লো রুপালী চাঁদ অনলের চোখে মুখে ,হাতটা নিসপিস করছিল স্পর্শের প্রত্যাশায়, এক অজানা সংকোচ থামিয়ে দিচ্ছিল তাকে ,ছুঁতে যেতে যেতে আবার ফিরে আসে হাত দু’টো নাহ এবার ছুঁয়ে দেবো ঠিক ওর হাত টা , পারে না অনল, ছুঁয়ে দেবার বাসনা তাকে উতালা করে তোলে , শরীরটা চাঁদোয়ার শরীরের সাথে লেপটে আছে,রিক্সার হূটটা তোলা ছিল না । অনলের ইচ্ছা করে হুটটা তুলে দিতে , তাও পারে না, সাহস সঞ্চয় করে বলে-কি হোলো ?
চাঁদোয়া মাথা দোলায়, বলে-কিছু না ।
-আপনি আসলে খুব আবেগ প্রবন ।
সদ্বোক্তি করে চাঁদোয়া-না, একটুও না।
-আমি বুঝতে পারি ।
-কচু বুঝতে পারেন আপনি।
হেসে ফেলে অনল, চাঁদোয়াও ।
রিক্সা থেকেই নামতেই প্রচন্ড বৃষ্টি ।রাস্তার পাশেই যাত্রী ছাউনী ।সন্ধ্যার এই খারাপ আবহাওয়াতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া এই ঝিল পাড়ের রাস্তায় কেউ আসে না ।আকশে মেঘ ডেকে জানান দেয় অশণী সংকেত । যেকোন সময় আকাশ ফুড়ে নামবে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ।হঠাৎ শুরু হলো দমকা হাওয়ার সাথে অঝোর বৃষ্টি ।বৃষ্টির ছিস এসে ভিজিয়ে দিল ওদের । চাঁদোয়া অনলের খুব পাশে সরে এলো ।অনলের নিঃশ্বাসে ছন্দ পতন ঘটে ।গভীর চোখের দৃষ্টি মেলে অজানা আশংকার ঘোষণা দেয় তার অপলক দুটি নয়ন । চাঁদোয়ার দৃষ্টিও অচেনা মনে হয় অনলের কাছে । রাস্তা জনশূন্য , অন্ধকার ছেয়ে ফেলেছে চারিদিক ।অনলের হাত দু’টো খুব সাহসী হয়ে ওঠে ।চাঁদোয়ার ঘাড়ে তার হাত রাখে , বলে-ভয় করছে ?
-হু।
চাঁদোয়া তাকিয়ে আছে অনলের মুখের দিকে । অনল বলে -কি দেখছো ?
ভয় নেই ।
চাঁদোয়া ঘাড়টা রাখে অনলের ঘাড়ে ,দু’হাতে আগলে রাখে অনল চাঁদোয়াকে। বসে পড়ে বেঞ্চিতে ।
গভীর অন্ধকারে ওরা ,বৃষ্টি থামবে বলে মনে হয় না ।বর্ষার ছিচে ওদের প্রায় অর্ধেক শরীর ভিজে সারা ।
চাঁদোয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে অনল বলে –মনে রাখবে আমাকে ?
চাঁদোয়ার বুকের ভীতর তখন প্লাবন বয়ে যাচ্ছে ভালোবাসার । চাঁদোয়ার নিস্পাপ মনে এটাই প্রথম গোলাপ কুঁড়ি ,শরীরের মাঝে এই প্রথম শীহরণের ঝড় ।অনলের মুখ পানে তাকিয়ে বুঝাতে চাইলো ভালোবাসি, ভালোবাসি ,ভালোবাসি ……………
কিন্তু বলতে পারলো না, কেবল সারা শরীরে অনলের স্পর্শের এক মোহনীয় স্বাদ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখলো ।
অনল বললো-একটি কথা শোনা হলো না, চাঁদ !
চাঁদোয়া মিষ্টি হেসে বেদনার্ত কণ্ঠে বললো-সব কথা বলে বোঝানো যায় না অনল ।
দুই
বাসায় ঢুকতে মামা মামীর চোখের দৃষ্টির কাছে চাঁদোয়া স্নগকুচিত হয়ে গেল ।মামী সন্দেহ নিয়ে তাকালো ।মামা কঠিণ কণ্ঠে জানতে চাইলো-এতো রাত অবধি, বৃষ্টির ভিতর এই অচেনা জায়গাতে তুই কোথায় ছিলি ?
চাঁদোয়া বললো-বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিলাম ।
-কোথায় ?
_ঝিলের পাড়ে
-বাসার পিছনের ঝিলে ?
-হা ,মামা ।
চাঁদোয়া মিথ্যে বললো, তাকে মিথ্যে বলতে হলো ,এই শহরে সে নতুন , মামা কুষ্টিয়া বদলী হয়ে এসেছে,তাই যশোর থেকে ও বেড়াতে এসেছে । এখানে দু’টো ঝিলের পাড়, একটা মরা নদীর পাড়ে, আর একটা তার মামার বাসার পিছনে ।
মামাকে বাসার পিছনের ঝিলের পাড়ের কথা বলতে হলো । বিছানাতে যেয়েও সে ঘুমাতে পারলো না, তার স্মৃতি তাকে উন্মাদ করে তুললো । মাঝে মাঝে তার শরীরের ভীতর অদ্ভুত এক আবেশ তাকে চমকে দিচ্ছিল ।এখনও বুঝি অনলের হাত তার হাতে, তার শরীরের সব টুকু সত্তা জুড়ে অনল, অনল,অনল…………
যশোরে বিএডিসিতে চাকুরী করতে এসেছিল অনল । অনলের সাথে চাঁদোয়ার মামার সূত্র ধরে পরিচয় । এক সময় কুষ্টিয়াতে বদলী হয় অনল ,সেখানে অনলদের বাড়ী , ফোনে ওদের আলাপ হতো কিন্তু তা কখনও আপনি থেকে তুমিতে গড়াইনি । হঠাৎ করেই চাঁদোয়র মামাও বদলী হয় কুষ্টিয়া তে ।
হঠাৎ করেই সকাল বেলা চাঁদোয়ার মনে হলো অনল কে । মোবাইল ডাকলো তাকে । বাইরে হাটতে যাচ্ছি বলেই বেরিয়ে ছিলো সে ,কখনও মনে হয়নি এতো নিবিড় ভাবে সে অনলকে কামনা করবে । এক অঝোর বৃষ্টিতে সে তার সর্বোশ্ব বিলিয়ে দেবে অনলকে ।
সে অবাক হয়ে ভাবছিল, তার কেন পাপ বোধ হোলো না, তবে কি সত্যিকারের প্রেমে পাপ বোধ থাকে না, না কি এটাও তার আবেগী মনের ভাবনা মাত্র , সে কি অনেক বড় পাপ করলো ?
যশোর ফিরে এসে তার কিছুই ভালো লাগে না ,ভালো লাগে না কলেজ, ভালো লাগে না খাবার, তার বন্ধু বিন্দুকে বলল । বিন্দু অবাক হয়ে বলল-কি করেছিস, পাগলী ,নিঝুম তো তোকে পাগলের মত ভালোবাসে,
-অনলকে যে আমার সব কিছু দিয়ে নিঃশ্ব হয়ে গেছি ।
-ভুল করেছিস, কাকা কাকি মা জানলে কি হবে ভেবে দেখেছিস ?
-কিন্তু অনলকে ছাড়া আমি যে বাঁচবো না, বিন্দু ?
-তুই একজনের বাগদত্তা ।
-জানি তো
-তবে ?
চাঁদোয়া হুহু করে কেঁদে ফেলে ।দিন তার যেতে চায় না , হঠাৎ করে তার শরীরটাও খারাপ হতে থাকে । সন্দেহ তার মনে দানা বাঁধে , তবে কি সে মা হতে চলেছে ?
বাড়ির পেছনের বড় রাস্তাটা বিলের পাশ্ব দিয়ে চলে গেছে , চাঁদোয়া সেখানে যেয়ে বসে , নীল আকাশের দিকে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকায় , তার চোখ দিয়ে পানি পড়ে ।আকাশ তার বেদনা শুষে নেই না ।বাতাস তার চোখের পানি মুছিয়ে দেয় না, অনল প্রতিদিন তাকে ফোন করে ,তাকেও সে বলতে পারে না, সে মরেছে, দেহ মনে শুধুই অনলের স্মৃতি সে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে , কিভাবে বলবে ? বিন্দু বলে-তুই তোর অবস্থার কথা অনলকে জানা, তুই পালিয়ে অনলের সাথে চলে যা ।
-আমি কি ভাবে বলবো অনলকে ?
চাঁদোয়ার পোষা খরগোশটাও বুঝতে পারে বোধ হয় চাঁদোয়ার বেদনা, লাফিয়ে লাফিয়ে তার চারপাশে খেলা করে খরগোশটা । চাঁদোয়া তার গায় পরম স্নেহে হাত বুলায়, মনে হয় খরগোশের নরম পেলব তার বুকে কিছুটা শান্তি এনে দিতে পারবে ।
তিন
অনলকে সে বলে-তুমি একটু যশোর আসতে পারবে ,অনল ?
অনলও আসতে চায়, কিন্তু তার ছুটি নেই, সেও উতালা উদ্ভ্রান্ত , বোধ হয় সেও বুঝতে পারে চাঁদোয়ার কষ্ট, বলে-আর মাত্র দু’মাস অপেক্ষা করো চাঁদ, আমি একেবারে বিয়ের বার্তা নিয়ে আসবো,
চাঁদোয়ার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে-নিঝুমের সাথে আগামী মাসে আমার বিয়ে।
অনল বেদনায় ভেঙ্গে পড়ে –প্লিজ চাঁদ, তুমি দু’টো মাস বিয়ে টা ঠেকিয়ে রাখো, আমি তোমার মামাকে রাজী, করিয়েই আসছি , বাবা হজ্জের থেকে ফিরলেই আমি আমাদের সব কাজ সেরে ফেলবো ।
চাঁদোয়া ভেঙ্গে পড়ে , অনলকে সে কেন খুলে বলতে পারছে না ? দিন দিন তার সত্ত্বা তার ভীতর গভীর যত্নে বড় হয়ে উঠছে ,
অবসন্ন দু’টো হাত কোলের উপর, দূর আকাশে তার দৃষ্টি ,নিঝুম পাশে এসে বসলো-চাঁদ !
চমকে তাকালো চাঁদোয়া, নিঝুম চাঁদের হাত দুটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল-কি হয়েছে, সোনা আমার ? কি হয়েছে তোমার ?
চাঁদোয়া নির্লিপ্ত চোখে দেখে নিঝুমকে, বলে-কিছু না।
-তোমার চোখের নীচে কালি, মুখ শুকনো, আমাকে খুলে বলো
চাঁদোয়া গভীর নিঃশ্বাস ফেলে , কিছুই বলতে পারে না ।
বলতে পারে না, সে শেষ হয়ে গেছে বিশ্বাসে, ভক্তিতে, লজ্জায়, পবিত্রতার একটুও তার ভিতর বাকী নেই, সে অস্পৃষ্য , সে কখনও আর তার হতে পারবে না, নিঝুম তুমি কেন এসেছো ?
কিছুই তার বলা হয় না, পরম যত্নে নিঝুম চাঁদোয়ার মাথাটা তার বুকের উপর রাখে ।
মাতার উপর হাত দিয়ে সযত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । চাঁদোয়ার কাছে এখন অর্থহীন সব কিছু ।
চার
জোর করে বিন্দু অনলের ঠিকানা নেই চাঁদোয়ার কাছ থেকে ,
সে অনলকে চিঠি লেখে
অনল ভাইয়া
অনেক বিপদে পড়ে কু্রিয়ারে এ চিঠি পাঠালাম ,আপনার চাঁদ কলংকের কালিমায় ডুবে যাবার আগেই আপনি যশোর চলে আসেন , চাঁদের জীবন মরণ সমস্যা, ওদিকে বিয়ে তারিখ মাত্র তিন দিন বাকী, অন্য দিকে আপনার সন্তান ক্রমশই তার অস্তিত্ত্ব প্রকাশ করতে চলেছে । পত্র পাওয়া মাত্র দেরী না করে চলে আসবেন ।
ইতি বিন্দু ।
অনল যখন এ চিঠি পেল সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো । মোবাইল করলো সে চাঁদোয়ার কাছে----চাঁদ
-বলো
-বিন্দু যা লিখেছে তাকি সত্যি ?
চাঁদোয়া দ্বীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রেখে দেয় মোবাইল ।অনল ছুটে যায় হেড অফিসে -স্যার আমার ছুটি লাগবে
ম্যানেজার বাবু কঠিণ কন্ঠে বলেন- আপনি জানেন না, কাল ঢাকা থেকে অডিটর আসবেন আগামী দিন, আপনি একজন একেউন্টেন্ট হয়ে এ রকম পাগলের মত কথা বলছেন কেন ?
-স্যার ,আমার খুব বিপদ ।
-আপনি পরশু ছুটি নেন ।
অনল বের হয়ে আসে ,ফোন দেয় চাঁদোয়াকে-চাঁদ, আর মাত্র দু’দিন পরে আমি আসছি, অপেক্ষা করো চাঁদ, আমি আসছি ।
চাঁদোয়ার সময় নেই হাতে , বাড়িতে বরের বাড়ি থেকে বরাত এসে গেছে । তার গাঁইয়ে হলুদ।
বিন্দু এসে বলল-অনল এলো না ?
ফিস ফিস করে চাঁদোয়া বলল-ও আসবে, আসবেই ,ওকে আসতে হবে বিন্দু……কেন আসবে না ও, ওকে আমি যে খুব ভালো বাসি, সেদিন ঝিলের পাড়ে সব দিয়েও যে কথা বলতে পারি নি , সেই কথাটি শুনতে ও আসবেই বিন্দু …
গোসল সেরে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে, চাঁদোয়া তার ঘরে যেয়ে দরজা লাগালো
বিন্দু দেখলো চাঁদোয়ার ঘরের কপাট ।
দৌড়ে গেল সে তার বান্ধবীর মায়ের কাছে । -কাকী মা। চাঁদ ঘরে দরজা লাগিয়েছে
উনি অবাক হয়ে বললেন-তাতে কি ? হয়তো কাপড় পাল্টাচ্ছে ।
-না, কাকি মা
-কি ?
-আপনারা ওকে ডাকুন।
অনেক্ষণ হলো দরজা খুলছে না দেখে দরজা ধাক্কালো স্কলে । ভীতর থেকে কোন সাড়া এলো না, দরজা ভেঙ্গে বের করা হলো চাঁদোয়াকে, বিষের শিশিটা তার হাতের মুঠিতে এখনও ।তার শরীর থেকে হয়তো দশ পনের মিনিট আগেই প্রাণ টা চলে গেছে ।
লাশের দাফন শেষ, অনলের গাড়ীটা চাঁদোয়াদের বাড়ীর সামনে দাঁড়ালো ।
অনেক লোকের ভীরে কী কাউকে দেখছে না , বিন্দুই চিনলো তাকে ।
পাশে গিয়ে বললো- চাঁদ মরে ঠিকই করেছে, অনল ভাইয়া, তুমি এলে না কেন ? অনেক অভিমানে চাঁদ চলে গেছে , আর পোষ্টমর্টেমের রিপোর্টের দ্বায়ভার সবটুকু ঐ নিঝুমই নিয়েছে , আপনার কাছে অনুরোধ, আপনার পরিচয় দিয়ে নিঝুমের ভালোবাসাকে ছোট করবেন না , প্লিজ চলে যান ।
অনল অশ্রু সিক্ত চোখে বোবা চোখে তাকালো । তারপর আবার ফিরে গেল………ফিরে গেল ঝিল পাড়ে ।
বিষয়: বিবিধ
১৭৮১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন