রঙ্গের মানুষ - (পর্ব-১৬)
লিখেছেন লিখেছেন প্রবাসী মজুমদার ২৭ মার্চ, ২০১৪, ০৫:৪৪:০৭ সকাল
পর্ব-১৫
লেজার ডিপামেন্টের হেড নিতাই বাবু। দেখতে খুবই শান্ত শিষ্ট স্বভাবের। অবয়বে ভদ্র ও মার্জিত রুচির একজন সিনিয়র অফিসার। অধীনস্থ ক্লার্ক মোস্তাক সাহেব তার খুব কাছের মানুষ। সখ্যতাটা নজের পড়ার মত। কাউকে কেউ ফেলে কিছূ খেতে চায়না। দেখে মনে হত, এরা দুজন এ অফিসের সবচেয়ে বড় জুটি। নাস্তা, পানি, দুপুরের লাঞ্চ সহ সবকিছুতেই একে অন্যর সাথী। প্রদীপ বাবুর মত মোস্তাক সাহেবকে কখনও লেজারের কাজ নিয়ে বিরক্ত হতে দেখা যায়নি। অন্য কেউ লেজার ডিপার্টমেন্টে গিয়ে কাজ করুক, এটি মোস্তাক সাহেবের খুবই অপছন্দ।
ব্যাংকে নতুন স্টাফ হিসেবে যোগ দেয়ার পর কাজ শেখার জন্য আমার ভেতর এক অদম্য আগ্রহ তৈরী হল । তাই লেজার ডিপার্টমেন্টের কাজটি শেখার জন্য প্রদীপ বাবুর সাথে একটা সখ্যতা গড়ে তুললাম। কিন্তু মোস্তাক সাহেবের সাথে এটি সম্ভব হয়নি। আচরণের দিক থেকে মোস্তাক সাহেব কেন জানি এক বিরল প্রকৃতির প্রাণী। সেকেলের মানুষদের মত গরুর স্বভাবে গড়ে উঠা গৃহপালিত মানুষ। পান চিবাতে চিবাতে কথা বলছে কাষ্টমারের সাথে। ঠোঁটের এক ফাঁকে ঝুলন্ত সিগারেটের গোড়াটা চেপে ধরে কথা বলছে। নিভূ নিভূ সিগারেট থেকে নির্গত ধোঁয়ায় এক চোখ তেড়া করে কথা বলার বিরক্তজনক ভঙ্গীমাতে অনেককেই বিরক্ত হতে দেখেছি। সেদিকে মোস্তাক সাহেবের খেয়াল নেই। অভ্যাসের দিক থেকে প্রদীপ বাবু কিছুটা সামাজিক ও হাস্যেজ্জল। তার মাধ্যমে লেজারে পোাস্টিং সহ কিছু কাজ আয়ত্ব করেছি।
অনেকদিন আগের কথা। মোস্তাক সাহেব বাহীরে গিয়েছেন। লেজারে কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ায় আমি প্রদীপ বাবুকে সহযোগীতার জন্য এগিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে মোস্তাক সাহেব এসে উপস্থিত। আমাকে দেখেই চোখে লজ্জা শরম না রেখে সোজা বলে ফেললেন, "মজুমদার সাহেব। আপনি আর লেজারে পোস্টিং দিতে আসবেন না প্লীজ"।
- কেন?
জবাব না দিয়ে মোস্তাক সাহেব কেটে পড়লেন। মোস্তাক সাহেবের সেদিনের কথাটার সঠিক উত্তর খুঁজে পাইনি। শূধু এতটুকু ভেবেছি যে, আমি যাওয়ার কারণে হয়তবা ঘূষ নেয়ার পথে বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিন্তু সদ্য ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য ঘটনাটি শূনে বুঝতে পারলাম, মোস্তাক সাহেবের এ ধরণের আচরণের আসল রহস্য।
এ ধরনের বড় মাপের ঘাপলা করার জন্য নিতাই বাবু আর মোস্তাক সাহেব বেঁচে নিয়েছিল কয়েকজন বড় ধরনের কাষ্টমারের হিসেবকে। যারা দৈনিক কয়েকবার ট্রানজেকশান করত কয়েক লক্ষ টাকার। অফিসার ক্লার্ক দুজনে মিলেই এ কাজটি করতো।
ব্যাংকে অডিট আসলে সাধারণত বড় ধরনের ট্রানজেকশানগুলোই বেশী দেখা হত। দেখতে দেখতে তাদের নজরে এ ধরণের কয়েকটি হিসেবে গরমিল ধরা পড়ল। দুজনকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসা করা হল। তাদের সন্দেহের ভীতটা আরও গভীর হল। অবশেষে অনেক ইনভেস্টিগেশন শেষে বুঝা গেল, এ দুজন ব্যাংক থেকে হাউজিং লোন নিয়ে বাড়ী করতে গিয়েই এ গাফলাটি করতে বাধ্য হয়েছে।
দুজনেরই অকস্মাৎ বিদায়ে ব্যাংকে একটা আতংক তৈরী হল। কিন্তু সেটি কেটে যেতে বেশীদিন লাগেনি। এক মাসের মধ্যেই সব কিছু আগের মত নিয়মে পরিণত হয়ে গেল। এর মাঝে নিতাই বাবুর জায়গায় ইসলাম সাহেব নামে এক সিনিয়র অফিসার অন্য শাখা হতে আসলেন। তাকে পেয়ে আমি ভীষন খুশী হলাম। কারণ, বোধ-বিশ্বাস আর অনুশীলনে এ লোকটি ছিল একজন খাটি মুসলিম। নো কম্প্রোমাইজ। ইসলাম সাহেবের উপস্থিতিতে ম্যানেজার নিজেও কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ল। এ ধরণের সৎ লোকগুলো সময়ের বিবর্তে এক সময় অফিসে খুব অসহায় হয়ে পড়ে। পর্দার অন্তরালে গড়ে উঠা ঘুষখোরদের সিন্ডিকেটের নোংরা রাজনীতির কাছে এরা বেশীদিন টিকে থাকতে পারেনা।
ইসলাম সাহেবের উপস্থিতিতে কাস্টমারদের মাঝে এক ধরনের স্বস্তি ফিরে আসলেও আরশোলা আর তেলাপোকার মত ড্রয়ার কিংবা নর্দমার ভেতর লুকিয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝে অসন্তোষের দানা বাড়তে থাকল। দৃষ্টিভঙ্গীকে অন্যত্র ফিরিয়ে নেয়ার জন্য সিবিএ নেতাদের কাছেও ইসলাম সাহেবকে কলুষিত করার কাজ শুরু হয়ে গেল। একটি সময় এল, ইসলাম সাহেবের সততার এ দেয়াল ভাঙ্গার জন্য ম্যানেজার সাহেব নিজেই এগিয়ে এলেন। একান্ত আলাপ চারিতায় ব্যাংকের অন্যান্য ষ্টাফদের মাঝে গড়ে উঠা অসন্তোষের ইঙ্গিতটাও দিয়ে দিলেন। স্যার বললেন,
এ অফিসে আমরা সবাই একটি পরিবারের মত। এখানে আমরা সবাই ভাইয়ের মত। অনেকেই আছেন, যাদের পরিবারের ভরন পোষন এ বেতনে চলেনা। তাই তারা কাষ্টমার থেকে চা পানি বাবদ কিছু পয়সা নিয়ে থাকে। এটি এক দিকে সঠিক না হলেও অন্য বিবেচনায় কিছুটা সহজ না হলে অফিস চলেনা। এসব বিষয় উদার ভাবে না দেখলে কাজের ক্ষেত্রেও এক ধরনের জড়তা তৈরী হয়।
আমি আপনার সততাকে ও নিষ্ঠাকে স্বাগতম জানাই। সৎ জীবন যাপনে যারা অভ্যস্ত নয়, তাদের কাছে এটি একটা অসহ্য বিষয়। অল্পতে যারা সন্তুষ্ট নয়, কিংবা বাড়তি আয়ে যারা নিজের পরিবারের খরচের লাগামটা ধরে রাখতে পারেনি, তাদেরকে হঠাৎ করে বাধা দিলে এর অসন্তোষটা পরিবারেও শুরু হয়ে যায়।
আপনি এমন এক জায়গায় কাজ করেন, যেটি সব কিছুর গেট ওয়ে। আপনি একটু কঠোর হওয়ার কারণে সামনে পেছনে সব দরজাই একেবারে বন্ধ। আপনি ষ্ট্রেইট ফরওয়ার্ড হওয়ার কারণে খায়ের সাহেব এখন আর ডিডি টিটি বাবাদ টাকা নিতে পারেন না। কারণ কাষ্টমার যদি কোন কাজ আপনার কাছ থেকে বিনা পয়সায় নিতে পারে, খায়ের সাহেবের কাছে আসবে কেন?
এটা আপনিও ভাল করে জানেন যে, সিবিএ নেতাদের মাসিক যে চাঁদা দিতে হয়, এটিত আর আমি পকেট থেকে দিতে পারিনা। এটি আমার হয়ে খাযের সাহেবই দিয়ে থাকেন।
অন্যদিকে, আমাদের বড় বড় কাষ্টমারগুলো কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে ষ্টাফদের থেকে একটা সুযোগ সুবিধা নিয়ে থাকে। আর এসব বড় কাষ্টমারগুলোর পয়সা দিয়ে যেহেতু আমাদের ব্যাংক চলে, কাজেই এদেরকে ছাড় না দিলেতো আর ব্যাংক চলবেনা। ধরুন, কাষ্টমারের হিসেবে টাকা নেই। অনুরোধ করে বসল ২-৪ ঘন্টার জন্য এক লক্ষ টাকা দিতে। বিকেলে ফেরত দিয়ে যায়। এরা আবার এতই বিশ্বস্ত যে, আমাদের সাথে কখনও ২-৪ লক্ষ টাকা নিয়ে গাফলা করার মত নয়। এসব বিষয়গুলো ব্যাংকের নিয়ম নীতির বাহীরে হলেও, আমাদেরকে করতে হয়।
এক কথায়, আমি আপনাকে কোন ধরনের অনিয়মে জড়ানোর অনুরোধ না করলেও আপনার সততার কারণে বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে, এটা বুঝানোর চেষ্টা করছি। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন।
ইসলাম সাহেব জানতে চাইলেন, তাহলে আমি কি করব স্যার? আমি স্বল্প আয়ে নিজের সব কিছু চালিয়ে নিতে অভ্যস্ত। আমার পরিবারও সীমিত চাহিদায় অভ্যস্ত, সুতরাং বাড়তি আয় নিয়ে আমার কোন মাথ্য ব্যাথা নেই। আর ধর্মীয় অনুশাসনে অভ্যস্ত আমি এ ব্যাপারে নমনীয় হওয়ারও কোন সুযোগ নেই। কাজেই আপনি যদি আমাকে কোথাও বদলী করতে চান, আমার সমস্যা নেই।
- না। আপনাকে বদলী করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, আপনার ব্যাপারে পুরো চট্রগ্রাম বিভাগ নয়, হেড অফিস পর্যন্ত একটা সুনাম রয়েছে। সুতরাং আপনাকে বদলী করার মত এমন কোন কারণও আমার কাছে নেই। আর বলেলেইতো আপনাকে বদলী করতে পারবোনা।
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
১৬৮২ বার পঠিত, ৪৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
এটা হল সত্যের শক্তি। ইসলাম সাহেবদের মত মানুষরা পৃথিবীর সব কিছুকেই ধাক্কা দিতে পারেন।
নিজের মাঝেই ঘুমন্ত ওমর
মিছে খূঁজি বারে বার,
দোয়া মাঙ্গি প্রভূ পাঠাও আজি
ওমরকে আবার।
ভূলে যাই ওমর আমারই মত
নত করেনি কভু শির,
কোরানের রঙ্গে রাঙ্গিয়ে নিজেকে
হয়েছিল দিগ্বী বীর।
যে পথে এগিয়ে ওমর শ্রেষ্ঠ
ভূলে গেছি সেই গলি,
কেবলা বাবার দরগাহে বসে
মিছে সাজি মোরা 'অলী'।
মন্তব্য করতে লগইন করুন