"স্বজনপ্রীতি বা আত্মীয়তার সম্পর্ক"

লিখেছেন লিখেছেন মাহবুবা সুলতানা লায়লা ১৮ মার্চ, ২০১৬, ০২:৪৩:১৩ রাত
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন "রাহেম" এর মর্যাদা বুলন্দ করেছেন। স্বীয় নাম থেকে এর উৎপত্তি ঘটিয়ে একে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন; আমি রাহমান। 'রাহেম'কে আমি সৃষ্টি করেছি এবং নিজের নাম থেকে এর নাম করন ঘটিয়েছি। যে একে রক্ষা করবে, আমি তাকে রক্ষা করবো। আর যে, একে ছিন্ন করবে আমি তাকে ভুলে যাব।
'হাদীসে কুদসী'
সুতরাং প্রকৃত মুসলিম অবশ্যই 'রাহেমের' মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে, নিজেকে তাঁর রহমত-বরকত আর নিয়ামতের সু-শীতল ছায়ায় অবস্থানের যোগ্য করে তুলবে। অন্যথায় জীবন হয়ে উঠবে আল্লাহর করুনাবিহীন অশান্ত, দূর্ভোগ আর নানা বালা-মুসিবতে পরিপূর্ণ।
একজন সত্যিকার মুসলিমের দয়া-ভালোবাসা-সদ্ব্যবহার ইত্যাদি শুধু তার পিতা-মাতা, স্ত্রী কিংবা সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ থাকবেনা বরং এর শাখা-প্রশাখা ক্রমশ প্রসারিত হয়ে আত্মীয়-স্বজনদেরকেও শামিল করে নেবে। আর 'আরহাম' বলা হয়- 'যে সকল আত্মীয় বংশীয় সূত্র ধরে কারো সাথে সম্পৃক্ত হয়। চাই তারা তার সম্পত্তির অধিকারি হোক কিংবা না হোক।
আত্মীয়তার সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিঃ আত্মীয়তার সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলাম যে ভূমিকা নিয়েছে, অন্য কোন ধর্ম, সমাজ ব্যবস্থা বা সংবিধানে মানবতা তার কানাকড়িও দেখেনি। ইসলাম এ সম্পর্ক ধরে রাখার আদেশ দিয়েছে, আরো সুদৃঢ় করার জন্য উৎসাহিত করেছে, পাশাপাশি এসম্পর্ক ছিন্নকারীর জন্য কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে। একজন সত্যিকারের আল্লাহভীরু সচেতন মুসলিম স্বীয় আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। দুনিয়ার চাকচিক্য, বৈষয়িক ব্যস্ততায় ডুবে থেকে কিংবা স্ত্রী-সন্তানের চাহিদা মেটাতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের ভুলে যাবেনা। তাদের সাথে সদ্ব্যবহার বা তাদের সহযোগীতায় পিছিয়ে থাকবেনা। এক্ষেত্রে সে ইসলামী দিক-নির্দেশনা ফলো করবে। কেননা, ইসলামই এ সম্পর্কগুলো সৃষ্টি করেছে এবং নৈকট্য ও গুরুত্বের বিচারে এগুলোর স্তরবিন্যাস করেছে। প্রথমেই মা, তারপর বাবা, তারপর যে বেশী কাছের...........। এমনই ভাবে শেষ পর্যন্ত।
এক লোক যখন রাসূল (সঃ) এর কাছে এসে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল, 'ইয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ)! কে আমার সদ্ব্যাবহার পাওয়ার বেশী হকদার? রাসূল (সঃ) বললেন, 'তোমার মা' তারপর 'তোমার মা'। তারপর তোমার বাবা। তারপর সম্পর্কের বিচারে যে তোমার বেশী কাছের......। এভাবেই চলবে। (বুখারী-মুসলিম)
আত্মীয়তার সাথে সদ্ব্যবহার করলে মুসলিম দু'দিক থেকেই সওয়াব অর্জন করবে। সম্পর্ক রক্ষার সাওয়াব ও সাদকাহ এর সাওয়াব। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ যদি দরিদ্র ও সম্পদের প্রতি মুখাপেক্ষী থাকে, তাহলে তাকে সম্পদ দান করার মাধ্যমে মুসলিম আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দু'ধরনের প্রতিদান পাবে। এর সাথে সাথে সাহায্য প্রাপ্ত আত্মীয়দের হৃদয়ে-মনে তার জন্য অপার ভালোবাসা ও নিঃস্বার্থ কল্যাণ কামনার মনোভাব সৃষ্টি হবে।
রাসূল (সঃ) এ ধরনের দান-সাদকাহ বেশী ভালোবাসতেন এবং এ বিষয়ে উৎসাহ প্রদান করতেন। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) এর স্ত্রী যয়নব আস্ -সাকাফিয়্যাহ (রাযি) আনহাঃ থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল (সঃ) যখন বললেন, 'হে নারী জাতি! তোমরা দান সাদকাহ কর। এমন কি নিজেদের অলঙ্কার দিয়ে হলেও।' যয়নব বলেন, 'একথা শুনার পর আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাযিঃ) এর কাছে গিয়ে তাকে বললাম: 'তোমার সহায়-সম্পত্তি কম। এদিকে রাসূল (সঃ) আমাদেরকে সাদকাহ করার আদেশ দিয়েছেন। তুমি তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করো যে, আমি তোমাকে সাদকাহ করতে পারবো কি না? নইলে আমি অন্যদের সাদকাহ করবো।' আব্দুল্লাহ বলল, আমি পারবোনা। বরং তুমি নিজে গিয়ে জেনে এসো।
তখন আমি নিজেই রওয়ানা দিলাম। রাসূল (সঃ) এর ঘরের দরজায় গিয়ে দেখলাম, আমার মতো একই প্রয়োজন নিয়ে এক মহিলা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। রাসূল (সঃ) এর ব্যপারে প্রবল শ্রদ্ধা আর ভয়ের কারনে সে তাঁর কাছে খবর পাঠাতে পারছিলো না। এমন সময় বেলাল (রাযিঃ) বের হলে আমরা তাঁকে বললাম: 'রাসূল (সঃ) এর কাছে গিয়ে জানান যে, দুজন মহিলা তাঁর দরজায় এসে তার কাছে জানতে চাচ্ছে, তারা কি তাদের দরিদ্র স্বামী এবং তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা ইয়াতীমদের জন্য সাদকাহ করতে পারবে? তবে আপনি রাসূল (সঃ) কে আমাদের পরিচয় বলবেন না।' বেলাল (রাযিঃ) রাসূল (সঃ) এর কাছে গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে রাসূল (সঃ) বললেন, 'এ দু'জন কে?' বেলাল (রাযিঃ) বললেন, একজন আনসারী মহিলা ও যয়নব।' রাসূল (সঃ) বললেন, কোন যয়নব?' বেলাল (রাযিঃ) বললেন, আব্দুল্লাহর স্ত্রী'। তখন রাসূল (সঃ) বললেন, 'এ দুজনের জন্য দুটি পুরষ্কার। একটি সম্পর্ক রক্ষার এবং অন্যটি সাদকাহ-এর।(বুখারী-মুসলিম)
রাসূল (সঃ) আরো বলেন, 'মিসকীনকে সাদকাহ করলে শুধু সাদকাহরই সাওয়াব। কিন্তু দরিদ্র আত্মীয়কে সাদকাহ করলে দু-ধরনের সাওয়াব: সম্পর্ক রক্ষার ও সাদকাহ এর।'
(তিরমিযী: হাদীসটি হাসান সহীহ)
হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি স্বামীহীন নারী ও মিসকীনদের সহযোগিতার জন্য পরিশ্রম করে সে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর মতো এবং সেই ব্যক্তির সমতুল্য যে দিনের বেলায় রোযা রাখে এবং রাত্রিবেলায় নফল নামায আদায় করে।
-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩৫৩, ৬০০৬-৭
হযরত সাহল ইবনে সা’দ হতে বর্ণিত অন্য এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,, আমি এবং ইয়াতীমের ভরণপোষণকারী জান্নাতে এভাবেই থাকব। এ কথা বলে তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলী একত্র করে ইঙ্গিত করলেন।
-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০০৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৯৮৩
কতেক মানুষ আছেন, যারা নিজের বাবা, মা, ভাই, বোন বা নিজের আত্মীয় ছাড়া অন্যদের গুরুত্ব দেয়না। এমন কি স্বামীর পরিবারের কাউকেই না। তাদেরকে পর পর ভাবেন। এবং কখনো দাওয়াত করলেও নিজের স্বজনদের মূল্যায়ন বেশী করেন। আবার দেখা যায় কেউ কেউ বিয়ে/শাদী/খৎনার অনুষ্ঠানে ধনী দেখে দেখে দাওয়ার করেন গরীব স্বজনেরা সেখানের উপযুক্ত নয় বলে দাওয়াতই করেন না। আবার যারা গরিব স্বজনদের দাওয়াত করেন তারা যদি কোন হাদীয়া বা উপঢৌকন আনেন তা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। এতে করে সেই স্বজনেরা পরবর্তীতে নিজের অপারগতার কারনে কারো দাওয়াতই গ্রহণ করেন না। বাস্তবতায় অনেককে দেখেছি, আপন ভাই, বোনেরা এক ভাইয়ের বেশী সন্তান বলে তাদেরকে কোন ঈদ বা অন্য কোন আয়োজনে দাওয়াত করেন না।
আবার বিয়ে/শাদী/ বা খৎনার অনুষ্ঠানে দায়াও করেন উপহার পাবার আশায়। আবার অনেক পরিবারে ধনী বেয়াই বাড়িলোতর কদের গুরুত্ব দেন বেশী। গরীব বেয়াইকে তেমন সম্মান করেন না। ধনী বলে তাদেরকে হুজুর হুজুর করেন। আর গরীব বলে গণনায়ও ধরেন না। এটা কখনোই সমাচীন নয়। ছোট বেলায় দেখেছি ঈদেরদিন গুলো আসলে পাড়াপ্রতিবেশীরা একে অপরকে খাবারের জন্য ডাকতেন। একাকি কিছুই খেতেন না। এমন কি যে কোন খাবার, বা হোক তা সামান্য ভর্তা তাই প্রতিবেশী স্বজনদের দিতেন।
আর বর্তমানে আপন ভাই বোনেরাও একে অপরকে বছরের পর বছর গেলেও খোজ খবর নেয়না। দাওয়াত করেনা। মনে করেন খরচ বেশী হবে যা তাদের পিছনে খরচ করবো তা আমাদের সন্তানের জন্য করবো। আর এসব কারনেই আমাদের সন্তানেরা ইসলামের সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত। মানুষের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। বিপদে আপন আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগীতা থেকে বঞ্চিত। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আল্লাহর রহমত থেকেও বঞ্চিত তারা। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে ইসলামের সঠিক বিষয় গুলো জেনে আমল করার তৌফিক দান করুন।
আমার ওয়েব সাইট থেকে পড়ুন
বিষয়: বিবিধ
১৩০৬ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একজন সত্যিকার মুসলিমের দয়া-ভালোবাসা-সদ্ব্যবহার ইত্যাদি শুধু তার পিতা-মাতা, স্ত্রী কিংবা সন্তানদের জন্যই বরাদ্দ থাকবেনা বরং এর শাখা-প্রশাখা ক্রমশ প্রসারিত হয়ে আত্মীয়-স্বজনদেরকেও শামিল করে নেবে।
খুবিই চমৎকার উপস্থাপনা। জাজাকাল্লাহু খাইর।
দূরের মানুষ বেশি আপন হয়ে যায়, আর কাছের মানুষগুলো উপেক্ষিতই থাকে সারাজীবন। আর কাছের মানুষের থেকে এই উপেক্ষা কত যে বেদনাবিধুর, তা ভুক্তভোগী ব্যক্তি মাত্রই অনুধাবন করতে পারেন।
জাযাকাল্লাহু খাইর।
আল্লাহ আমাদের রেহেমের সম্পর্ক অটুট রাখার শক্তি, সামর্থ এবং যোগ্য মন দান করুন। জাহান্নাম থেকে হিফাজত করুন!
জাযাকিল্লাহ!
মন্তব্য করতে লগইন করুন