গৃহযুদ্ধ

লিখেছেন লিখেছেন অগ্রহায়ণ ০৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:৪৯:৩৮ রাত

আমি যখন দিঘীর পাড়ে পৌছালাম তখন দুপুর। মস্ত বড় দিঘীর একপাশে পিঠে মুখ গুজে এক পায়ে দাড়িয়ে আছে কিছু রাজহাঁস। আমার অস্তিত্ব টের পেয়ে তারা চমকিত হয়ে গা ভাসিয়ে দিল দিঘীর জলে।

একটু এগিয়ে পৌছালাম মুন্সী মিয়ার বাজারে।

এক কালে বেশ নাম ডাক ছিল এই বাজারের। দুর-দুরান্ত থেকে মানুষ আসতো সদাই পাতি করার জন্য। সকাল থেকে সন্ধযা পর‍্যন্ত মানুষ গম গম করত।

বাজারের প্রবেশ পথে কয়েকটা কুকুর জিব্বাহ বের করে হাপাচ্ছিল। আমাকে দেখে তারা পিছু নিল।

প্রায় দোকান পাটে তালা ঝুলছে। মানুষ জন নেই বল্লেই চলে। যে সব দোকান খোলা তারাও দরজার সামনে মোটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। সম্ভবত সুর‍্যের তাপ থেকে বাচার জন্য এই ব্যাবস্তা। দুর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই খোলা নাকি বন্দ্ব।

আমি কাপড় সরিয়ে একটা দোকানে উকি দিলাম।

উদোম গায়ে বসে বসে ঝিমুচ্ছে মুরোব্বি গোছের একটা লোক। হাতে হাত পাখা। ক্যাস বক্স এর উপর কিছু নুয়ে পড়া বাসি পান আর সুপারির কৌটা।

একটু দুরে বসা ১২/১৩ বছরের একটা ছেলে। বোধয় দোকানের কর্মচারী।

- চাচা একটু পানি হবে?

আমার কথা শুনে সচকিতে সজাগ হলো দুজনই। খুউব ঠাউর করে আমাকে চেনা চেষ্টা করলেন।

পাশে রাখা পুরানো সিলভারের জগ আর হাতল বিহীন গ্লাস টা এগিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেটা? কইথথে আইলা? কই যাইবা?

বুজলাম চিনতে পারেননি। আমি নিজের পরিচয় এড়িয়ে গেলাম।

- টাউন থেইক্কা আইতাছি চাচা। সামনের এক গ্রাম পরেই আমাগো বাড়ি।

- টাউনের অবস্তা কেমুন দেখলা?

- তেমন ভালা না চাচা।

- অ । ( লোক টা বিড় বিড় করে আরো কি যেন বলল। বুজলাম না কিছুই )

- যাই চাচা। স্লামুয়ালাইকুম।

আমি আবার গন্তব্যের পথ ধরে চললাম।

আমি গ্রাম ছেড়েছিলাম বোশেখের মাঝামাঝি এক ঘুমন্ত রাতে।

এখন চৈত্র। চারিদিকে খা খা করছে কাক মরা রোদ। চোখ মেলে তাকানো দায়। ভ্রূ কুচকে থাকিয়ে থাকতে ক্লান্তি লাগছে।

আখাউড়া রেল ইস্টিশন থেকে সাত মাইল হাটে এসে ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু এই ক্লান্তির মাঝেও কেমন যেন একটা স্বস্তি অনুভব করছি। ছুঠি পাওয়ার স্বস্তি। দীর্ঘ দিন পর বাড়ি ফেরার স্বস্তি।

দীর্ঘ এগারো মাস পর এক সপ্তাহের ছুঠি পেয়েছি গ্রুপ কমান্ডারের কাছ থেকে। পিছনের দিন গুলো চোখ ভাসতেই রোমাঞ্চিত শিহরন বয়ে যাচ্চে শরীর জুড়ে।

আমি যখন ঘর ছেড়েছিলাম তখন রানীর বিয়ের কথা হচ্ছিল।

একদিন মা আমাকে তার ঘরে টেনে নিয়ে হাত চেপে ধরে বললেন , ছেলে খুব ভালা। মেট্রিক পাস দিছে। বাজারে দোকান চালাই। তাদের দাবী দাওয়া ও বেশি নাই। শুধু একটা হোন্ডা আর দোকান সাজাইবার জন্য চল্লিশ হাজার টাকা। তুই "না "করিস না বাপ। যে কইরা হোক ব্যবস্তা কর।

আমি মায়ের আগ্রহ দেখে "না " করিনি। মাকে আশ্বস্ত করবলেছিলাম, আমারে কিছু দিনের টাইম দেও। টাহা পয়সা জোগাড় পাত্তি করন লাইগবো।

ছোট ভাই মোজাম্মেল সেই বার এস এস সি পরীক্ষার্থী। আমাকে বলেছিল, ভাইয়া আমার রেজিস্ট্রেশন এর জন্য টাকা লাগবে। আর একটা পোনিক্স সাইকেল।

আমি তার পিঠ থাপড়িয়ে সাহস জুগিয়েছিলাম, হবে হবে সব হবে। আগে ভালো করে প্রস্তুতি নে। সময় মত সব পেয়ে যাবি।

কিছু ই হয়নি। হয়ে উঠেনি।

মায়ের জন্য একটা চিরকুট লিখে রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়েছি।

"মা, আমি চলে যাচ্চি।

যারা আল্লাহর নাম কে দুনিয়ে থেকে মুছে ফেলতে চাই তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।

ফিরবো কিনা জানিনা। তুমি রানী আর মোজাম্মেল কে নিয়ে বড় মামার বাড়িতে চলে যেও।

তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া করো । "

জানিনা ঐ চিটি পড়ে মা কতবার চোখের জলে বুক ভাসিয়েছ।

ময়দান থেকে বাড়ির কোন খবর নিতে পারিনি। মা কি ওদের নিয়ে বড় মামার কাছে চলে গেছে নাকি মৃত স্বামীর ভিটে আঁকড়ে পরে আছে। জানিনা।

হাটতে হাটতে কখন যে বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি খেয়ালই করিনি।

ঐতো দুরে বাড়ির চারপার নারিকেল আর বাশ ঝাড় গুলো দেখা যাচ্চে।

দাড়ি গোপ আর লম্বা লম্বা চুলে মুখভরতি হয়ে আছে। মা কি আমাকে চিনতে পারবে।নিশ্চয় পারবে।

আমার গলার স্বর শুনলে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আমাকে বুকে তুলে নিবে। অনেক্ষন জড়িয়ে ধরে কান্না করবে। দেউরি তে বসতে দিবে। তারপর আলমারি তে তুলে রাখা ভাজ করা লুংগি আর সাবান দিয়ে বলবে, যা গোসল করে আয়। আমি তোর জন্য রান্না বসাচ্ছি।

রানী অভিমান করে নিজের ঘরে দরজা লাগিয়ে বসে থাকবে। আমি জানালার ওপাশে দাড়িয়ে কানে ধরে বলব, রাগ করিস না বোন আমার। তুই যদি আমার সাথে কথা না বলস তাহলে আমি আবার চলে যাব।

রানী তখন আমার দিকে অশ্রু ভেজা চোখে তাকাবে। ফিক করে হেসে বলবে, উহ, অত সোজা না। তুমারে যাইতে দিলে তো।

সূর্য হেলে পড়ছে।

বাড়ীর উঠোনে দাড়ানো আমার ছায়া লম্বা হয়ে পড়ছে অনেক দুরে। আমি মুর্তির মতো দাড়িয়ে আছি। আমার চোখের সামনে যেখানে আমাদের ঘর ছিল, সেখানে কয়েকটা আধা পোড়া খুটি। ভিটের উপর পড়ে আছে জ্বলে অঙ্গার হয়ে যাওয়া টিনের ধ্বংসাবশেষ।

স্তানে স্তানে পড়ে আছে অনেকদিনের ছাই স্তুপ।

দেউরী ঘর টা যেখানে ছিল তার পাশের নিম গাছ টা আগুনে পুড়ে যাওয়া কান্ড নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

গোয়ালঘর এর কোন চিন্ন দেখলাম না।

সব কছুই মানুষ নামে কিছু দো পেয়ে প্রানীর হিংসার আগুনে জ্বলে ভষ্ম হয়ে গেছে।

আমার মা, বোন, ভাই ......কোথায়?

দীর্ঘ যুদ্ধে আমি টলিনি এতটুকু। মোনোবল হারায়নি। ভেঙ্গে পরিনি কখনো।

আজ স্তম্ভিত আমার পাথর দু-চোখ থেকে বেয়ে পড়ল হিমোগ্লোবিন ধারা। আমারই অজান্তে।

বিষয়: সাহিত্য

১০৫৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

271541
০৫ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০১:৪৪
শেখের পোলা লিখেছেন : বাস্তবের ছোঁয়া আছে বলে মনে হয়৷ অপূর্ব!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File