মানুষ কেন দেরীতে বিয়ে করে?
লিখেছেন লিখেছেন এ কিউ এম ইব্রাহীম ২৭ অক্টোবর, ২০১৪, ১১:২৪:২৬ সকাল
মানুষ কেন দেরীতে বিয়ে করে? এই প্রশ্নটি আমার প্রতি আমার নিজেরই। গত কয়েকদিন ধরে এই প্রশ্নটি আমার মাথায় ব্যাপকভাবে ঘুরঘুর করছে। অবশ্য আমি নিজেই চিন্তা করে এর কয়েকটি কারনও নির্ণয় করতে পেরেছি।
সৃষ্টি জগতে একমাত্র মানুষই দেরীতে বিয়ে করে অন্য কেউ নয়।
দেরীতে বিয়ে করা সৃষ্টির স্বাভাবিক নিয়ম নীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এখানে আবার একটি প্রশ্ন দাড়ায় মানুষ ছাড়া প্রাণীজগতের বাকী জীব-যন্ত্র কিংবা পশু-পাখী তারাও কি বিয়ে করে? আমি বলছি হাঁ, তারাও বিয়ে করে। তবে তাদের বিয়েতে কাজী বা স্বাক্ষী লাগেনা। তারা নিজেরাই নিজেদের সঙ্গী বেছে নেয়, যাকে একবার সঙ্গী হিসেবে বেছে নেয় তাকে সহজেই ভোলেনা। সর্বশক্তিমান এবং দয়ালু আল্লাহ সমগ্র বিশ্বের প্রাণীজগতকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন। কোন প্রানীকেই যেন একাকীত্ব বরণ করতে না হয় তাই এই ব্যাবস্থা। প্রাণীজগতের কেউই সৃষ্টি ও প্রকৃতির বিরুদ্ধাচরন করেনা তাই তাদের মাঝে অশান্তিও নেই।
ছোট বেলায় কবুতর পালন করতাম তাই কবুতরের জীবন প্রণালী স্বচক্ষে দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার দুই জোড়া কবুতর ছিল তারা প্রায় একই সময় বাচ্ছা দিয়েছিল। প্রতিদিন তাদের দেখভাল করতাম আর একটি বিষয় লক্ষ্য করতাম কবে দুটি বাচ্ছা কবুতর একত্রে ঘর-সংসার শুরু করবে? শুরুতে দুটি বাচ্ছাই তাদের মা-বাবার সাথে উড়াউড়ি প্যাকটিস করতো অর্থ্যাৎ তখনো তারা বাবা-মা ছাড়া থাকতে শিখেনি। দিনে দিনে বাচ্চাগুলো যখন একটু বড় হতে লাগল আমি লক্ষ্য করলাম ওরা বাবা-মা ছাড়াই একাকী ওদিক সেদিক উড়ছে। তারপর প্রতিদিন সন্ধায় বাচ্চাদুটিকে একরুমে ঢুকিয়ে দিতাম কিন্তু ওরা ঝগড়া করতো। দিনের বেলোয়ও দেখতাম বাচ্ছা দুটি দূরত্ব বজায় রেখে গাছের ডালে পাশাপাশি বসতো। সাধারন একটি ব্যাপার তখনো আমার মাথায় আসছিলনা সেটা হলো দুটি বাচ্ছাই ছিল ছেলে। একদিন আমার এক আত্নীয় আমাকে বললো বাচ্ছা দুটি বাজারে নিয়ে যাও এবং জোড়া মিলিয়ে আরো দুটি কবুতর নিয়ে আসো। যেদিন বাজারে নেব তার আগের দিন দুটি বাচ্ছার একটি বাচ্ছা হারিয়ে গেল, বহু খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া গেলনা। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল। আমারও পরের দিন আর বাজারে যাওয়া হলোনা। বেচারা কবুতরের বাচ্ছাটাও একা হয়ে গেল। প্রতিদিন দুই দোস্ত মিলে ঝগড়া করলেও এখন একা হয়ে গেল, ঝগড়া করারও কেউ নেই। দেখলাম সকাল বেলায় বেচারা খাঁচা থেকেই বের হচ্ছেনা, মনে হয় ভয় পেয়েছে সে! যাক, খাঁচার দরজা খুলেই রাখলাম।
দুপুর বেলায় বের হলো কিন্তু মুড অফ! চুপচাপ খাঁচার সামনে বসে আছে সারাদিন। বুঝলাম ওর জন্য লাল টুকটুকে বউ আনতে হবে। বিকেলে বাজারে নিয়ে গেলাম। কবুতর বেপারী বিভিন্ন কবুতরকে তার খাঁচায় ঢুকিয়ে কিছুক্ষনের জন্য রেখে জুড়ী মিলানোর চেষ্টা করছে। বেচারা কিছুতেই বউ পছন্দ করছেনা। এবার আমি নিজেই খাঁচার ভেতর একটি কবুতর দেখিয়ে দিলাম লোকটাকে। লোকটা বললো ওটা বিক্রি করা হয়েছে। আমি বললাম সমস্যা কি? সে লোক আসলে আমি বুঝিয়ে বলবো তাকে আরেকটা দিয়ে দেবেন।
এবার বেপারী রাজী হলো। দেখানো সেই কবুতরটি যখনি আমার কবুতরের খাঁচায় ভরল ছেলে কবুতরটি পৌরুষ ভাব দেখাতে শুরু করলো। ভাব দিয়ে বুঝালো তার বউ পছন্দ হয়েছে। তারপর উপযুক্ত দাম পরিশোধ করে বাড়ী চলে গেলাম।
সেদিন রাতে বউ জামাইকে এক খাঁচায় রাখলাম। রাতের শুরুর দিকে দুজনার কুহু কুহু ডাক শুনে বুঝলাম ওরা হ্যাপী। রাত পেরিয়ে সকাল হলে আমি তাদের খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। কে যেন এসে বলল নতুন কবুতরটি এখুনি খাঁচা থেকে ছাড়া ঠিক হবেনা, চলে যেতে পারে। কিন্তু ততক্ষনে দেরী হয়ে গেছে। দুটি কবুতর একত্রে উড়াল দিয়ে মন্ডল গাছের ডালে গিয়ে বসল। ভাবলাম সত্যিই নতুন কবুতরটি তার কপোতকে রেখে চলে যাবে? সারাদিন কবুতর দুটি চোখে চোখে রাখলাম।
না, কপোতী চলে গেলনা। তবুও সপ্তাহ খানেক ওদেরকে খাঁচাবন্দী থাকতে হলো । সাতদিন পর ওদেরকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করে দিলাম। ওরা সুখে-শান্তীতে দাম্পত্য জীবন কাটাতে লাগল।
কবুতরের ব্যাপারটি এখানে তুলে ধরলাম প্রাণীজগতে সিঙ্গেল এবং কাপল লাইফ সম্পর্কে একটু বাস্তব চিত্র তুলে ধরার জন্য। তবে এখানে কয়েকটি বিষয় আছে যা খুবই শিক্ষনীয়। যেমন সেক্সুয়ালী এ্যাডাল্ট হওয়ার সময় থেকেই প্রাণীদের কাপল লাইফ শুরু হয়ে যায় অথচ মানুষের বেলায় তা ব্যতিক্রম। আবার প্রাণীজগতে সমলিঙ্গের সেক্সুয়াল রিলেশন কিংবা লিভ দুগেদারেরও কোন নজির নেই কিন্তু মানুষের বেলায় তা শোনা যায়। বর্তমানে ছেলেরা ১৪/১৫ বছর বয়সে বালেগ হয় আর মেয়েরা হয় ১২/১৩ বছর বয়সে| তবে শারিরীক গ্রোথ কার কেমন তার উপর ভিত্তি করে দু/এক বছর কম-বেশীর তারতম্যও ঘটে। কিন্তু আমার বুঝে আসেনা যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পরও ১৫/১৬ বছর একাকী কাটিয়ে দেওয়ার সংস্কৃতি কিভাবে মানুষের মাঝে জায়গা করে নিল।
এসব নিয়ে লেখালেখির ফলে কেউ আবার ভাববেন আমি বাল্য বিয়ের পক্ষ নিয়ে কথা বলছি। আসলেই আমাদের মন-মগজ এভাবে গড়ে উঠেছে। একটু কম বয়সে বিয়ে করলে তা বাল্যবিয়ের মধ্যে পড়ে যায় কিন্তু বিয়ের বয়স পার করে বৃদ্ধ বয়সে বিয়ে করলে তা কোন পর্যায়ে পড়ে? তার উপাধিইবা কি?
অনেককে বলতে শুনি বাল্যবিয়ের সন্তানাধি কম সুস্থ হয়। আমি এটা মানতে নারাজ কারন কমবয়স্ক একটি মেয়ের শারিরীক অসুস্থতা বিভিন্ন কারনে হতে পারে কিন্তু কেবল অপ্রাপ্ত গর্ভ ধারনকে এখানে দোষ ধরা হয়।
বাইষোর্ধ্ব বহু মেয়ে সন্তান ধারনে অক্ষম এমনকি অতি দেরীতে বিয়ে হওয়ার ফলে বহু মেয়েরা আজীবন বন্ধাত্ব জনিত সমস্যায় ভূগছে। এ বিষয়টিকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখবো।
আজ থেকে প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগে গ্রামে বাল্যবিয়ে প্রচলিত ছিল। তখন দাদা-দাদীরা শখ করে নাতী-নাতনীদের বিয়ে দিত।পরের মেয়েকে বউ করে এনে লালন পালন করে পড়ালেখা শিখিয়ে বড় করত। বউরা তখন শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর নিকট নিজ সন্তানের মতো সোহাগ পেত। আমার মনে হয় সেসময়কার পারিবারিক বন্ধন অনেক মধুর এবং মজবুত ছিল, বউ-শ্বাশুড়ীর মাঝে ঝগড়া বিবাদ কম হত। বউ এর প্রতি শ্বশুর-শ্বাশুরীর শাসন ছিল নিজ সন্তানকে শাসন করার মতই। বউরাও শাশুড়ীর শাসনকে নিজ মায়ের শাসন মনে করত। তবে কোথাও খুব বেশী ব্যতিক্রম হলে তার মূলে কারণ ছিলো দুই পরিবারের অসামঞ্জস্যতার ব্যাপকতা।
সবার অলক্ষ্যে আমাদের বর্তমান পারিবারিক ব্যবস্থায় দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে তবে কিছু পরিবার এর চেয়ে আলাদা।
বর্তমানে বেশিরভাগ মেয়ে শ্বশুর-শ্বাশুড়ীকে নিজের মায়ের স্থানে বসাতেই চায়না। অনেকে আবার শ্বাশুড়ীর শাসনকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা দেয়না অথচ ভূলের জন্য নিজ মায়ের হাতে চড় খেত। অনেক মেয়েরা আবার উল্টো নিজ শ্বাশুড়ীকে শাসন করতে চেষ্টা করে। আমি এখানে একটি বিষয় বলবো সেটা হলো আপনি কি ভবিষ্যতে আপনার পুত্রবধুর কথামত উঠবস করতে পারবেন? যদি সেটা এখুনি আপনার নিকট কষ্টদায়ক মনে হয় তবে আপনার শ্বাশুড়ীর কথা ভাবুন। তাকে ভালবাসুন, তার আর আপনার মধ্যকার সকল দূরত্ব এক এক করে দূর করে ফেলুন। আপন মায়ের মত তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। মানুষের মন মেজাজ সবসময় একরকম থাকেনা। রেগে গিয়ে আপনাকে কিছু বলে ফেললে তাৎক্ষনিক উত্তর দেবেননা। পরে একসময় কথার ছলে হাসতে হাসতে সেকথা মনে করিয়ে দিতে পারবেন। বিশ্বাস করুন তিনি আপনাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলবে, বৌমা ওকথায় কিছু মনে করোনা আমি রাগের ছলে বলেছি। সত্যিই এধরনের কিছু টিপস একটি পরিবারকে সুখময় করতে পারে।
আমার মনে হয় বর্তমানে দেরীতে বিয়ের কয়েকটি কারনের মধ্যে বউ-শ্বাশুড়ীর সম্পর্কও অন্যতম একটি। অনেকে মনে করে সংসারটি এমনিতেই ভালো আছে, বউ আনলে হয়ত ছেলেকে আলাদা করে ফেলবে এই ভয়ে বাবা-মা সন্তানকে বিয়ে করাতে দেরী করে। বহু ছেলেও এসব চিন্তায় বিয়ে করতে দেরী করে। আবার মেয়ের বাবা-মারও একই চিন্তা। তারা মনে করে আমার মেয়ে এখানে ভালই আছে, বিয়ে দিলে না জানি শ্বাশুড়ীর অত্যাচার সহ্য করতে হয়।
এধরনের নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গীর ফলে বর্তমানে ছেলে-মেয়েদের দেরীতে বিয়ে হচ্ছে। পারিবারিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে হলে এসব থেকে বেরিয়ে আসা অত্যাবশ্যক।
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৬ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন