১৯৭১ এর যুদ্ধের জন্য ক্ষমা চাওয়া ভুল / ঠিক: ইসলামিক দৃষ্টিকোণ
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ০২:২৪:৩২ রাত
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ মুসলিম-মুসলিম সংঘাত হিসেবে মূল্যায়নযোগ্য, কারণ উভয় পক্ষই মুসলিম ছিল (এক পক্ষ জালিম ছিল)। ইসলামে প্রথম কর্তব্য শান্তি প্রতিষ্ঠা ও জালিমকে সংশোধন করা। পাকিস্তানি বাহিনী হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ঘৃণ্য অপরাধ করেছে। কিন্তু যারা যুদ্ধ চাননি, মানুষ রক্ষা করতে চেষ্টা করেছেন ও সংঘাত বন্ধে সর্বত চেষ্টা করেছেন —তাদের ক্ষমা চাইবার প্রশ্ন কি যৌক্তিক ইসলামের আলোকে? ইসলামের আলোকে তারা আদৌ কি ভুল করেছিলেন যে ক্ষমা চাইতে হবে? তবে এটা ঠিক যে,ইসলামী নীতি অনুযায়ী ফৌজদারি অপরাধের দায় পাকিস্তানি বাহিনী সহ সকল সহযোগী জালিমের
এ আলোচনা পুরোপুরি একাডেমিক – কোরআন (মূলনীতি ১), হাদিস (মূলনীতি ২), মুসলমানদের মধ্যকার যুদ্ধ সম্পর্কে (জামাল, সিফফীন, প্রভৃতি) দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রসিদ্ধ স্কলারদের মতামত(মূলনীতি ৩) ভিত্তিতে রচিত।
মূলনীতি ১: মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত
এবং যদি মুমিনদের দুইটি দল পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে মীমাংসা করো। আর যদি তাদের একদল অন্য দলের উপর সীমালঙ্ঘন করে, তবে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতক্ষণ না তারা আল্লাহর বিধানে ফিরে আসে। অতঃপর যদি তারা ফিরে আসে, তবে তোমরা তাদের মধ্যে ন্যায়সঙ্গতভাবে মীমাংসা করো এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।(সূরা আল-হুজুরাত: ৯)
নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সুতরাং তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমাদের প্রতি দয়া করা হয়।(সূরা আল-হুজুরাত: ১০)
মূলনীতি ২: মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কিত হাদিস
১. মুসলমানদের পারস্পরিক হত্যাকাণ্ড
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যদি দুই মুসলমান তলোয়ার নিয়ে একে অপরের মুখোমুখি হয়, তবে হত্যাকারী ও নিহত—উভয়ই জাহান্নামে যাবে।”
সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন: “হে আল্লাহর রাসূল, হত্যাকারী তো বটে, কিন্তু নিহত কেন?”
তিনি উত্তর দিলেন:
“কারণ সেও তার সঙ্গীকে হত্যা করার জন্য উদগ্রীব ছিল।”
সহীহ আল-বুখারী (৩১), সহীহ মুসলিম (২৮৮৮)
২. একজন মুসলমানকে হত্যা করা মহাপাপ
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“যখন দুই মুসলমান তলোয়ার নিয়ে লড়াই করে, তখন হত্যাকারী ও নিহত উভয়ই জাহান্নামে যাবে।”
সহীহ মুসলিম (২৮৮৮)
৩. পারস্পরিক হত্যাকাণ্ডে ফিরে যাওয়ার সতর্কবার্তা
বিদায় হজ্জে রাসূল ﷺ বলেছেন:
“আমার পরে তোমরা আবার কাফিরে পরিণত হয়ো না, যে তোমরা একে অপরের ঘাড়ে আঘাত করবে।”
সহীহ আল-বুখারী (৪৪০৫), সহীহ মুসলিম (৬৫)
৪. মুসলমানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখা
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“একজন মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও মর্যাদা অন্য মুসলমানের জন্য হারাম (অক্ষত ও পবিত্র)।”
সহীহ মুসলিম (২৫৬৪)
৫. ফিতনার সময় জিহ্বা ও হাত সংযত রাখা
রাসূল ﷺ বলেছেন:
“ফিতনার সময় বসে থাকা দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে উত্তম, দাঁড়িয়ে থাকা হাঁটার চেয়ে উত্তম, আর হাঁটা দৌড়ানোর চেয়ে উত্তম। যে এতে জড়িয়ে পড়বে, তা তাকে ধ্বংস করবে। সুতরাং যে আশ্রয় বা রক্ষা পেতে পারে, সে যেন তা খুঁজে নেয়।”
সহীহ আল-বুখারী (৩৬০১), সহীহ মুসলিম (২৮৮৬)
মূলনীতি ৩: মুসলমানদের মধ্যকার যুদ্ধ সম্পর্কে (জামাল, সিফফীন সহ যেকোন যুদ্ধ) দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রসিদ্ধ স্কলারদের মতামত
জামাল যুদ্ধ (৩৬ হিজরি / ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দ) ছিল খলিফা উসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতের পর মুসলমানদের মধ্যে প্রথম বড় গৃহযুদ্ধ। আয়েশা (রাঃ), তালহা (রাঃ) ও জুবায়ের (রাঃ) উসমানের হত্যাকারীদের দ্রুত শাস্তি দেওয়ার দাবিতে বাহিনী পরিচালনা করেন, আর খলিফা আলী (রাঃ) রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল করার পর তাদের বিচার করতে চেয়েছিলেন। বসরায় উভয় পক্ষই সমঝোতার ইচ্ছা পোষণ করলেও উসকানিদাতাদের কারণে যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধে প্রায় ১০,০০০ জন নিহত হন (প্রতি পক্ষ থেকে প্রায় ৫,০০০ জন)। তালহা ও জুবায়ের নিহত হন, আর আলী (রাঃ) আয়েশাকে সম্মান দিয়ে মদিনায় ফিরিয়ে দেন। যদিও এটি ছিল এক মর্মান্তিক ঘটনা, উভয় পক্ষই সত্যের সন্ধান করছিলেন, তবে ভুল সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা রক্তপাত ডেকে আনে।
হযরত আলী ইবনে আবী তালিব ও মু‘আবিয়া ইবনে আবী সুফিয়ানের যুদ্ধ শুরু হয় খলিফা উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর। আলী (রা.) চতুর্থ খলিফা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, কিন্তু উসমানের আত্মীয় ও সিরিয়ার গভর্নর মু‘আবিয়া (রা.) প্রতিশোধ নেওয়ার আগে আনুগত্য স্বীকার করতে অস্বীকার করেন। এর ফলে সিফফিনের যুদ্ধ (৬৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) সংঘটিত হয়, যেখানে প্রবল লড়াইয়ে প্রায় ৭০,০০০ মানুষ নিহত হন বলে প্রাচীন ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধ শেষে সালিশি (তাহকীম) করা হয়।
যুদ্ধ হওয়া সত্বেও আলী (রা) ও মুয়াবিয়া (রা) এর সৌহার্দ্যপূর্ণ মতামত পরস্পরের প্রতি:
আলী (রাঃ) মুসলিম প্রতিপক্ষ ও কাফের শত্রুর মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য করতেন। তিনি একবার মুআবিয়া ও তার বাহিনী সম্পর্কে বলেছিলেন:
“তারা আমাদের ভাই, যারা আমাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে।”
(আল-বালাধুরী, আনসাবুল আশরাফ, খণ্ড ৩)
আলী (রাঃ) মুআবিয়াকে সবসময় একজন মুসলিম ভাই হিসেবে দেখেছিলেন, কখনোই কাফের হিসেবে নয়। চিঠি ও খুতবায় আলী (রাঃ) সবসময় মুসলমানদের মধ্যে মিলন ও সন্ধির ওপর জোর দিয়েছেন এবং একই সঙ্গে নিজের খেলাফতের বৈধতাও সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
মুআবিয়া (রাঃ) র বক্তব্য (ঐতিহাসিক সূত্র):
ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া (খণ্ড ৭, পৃ. ৩৩৮)-এ এসেছে:
“আল্লাহর কসম! আলী আমার চেয়ে উত্তম এবং খেলাফতের বেশি হকদার। কিন্তু আমি কী করতে পারি? উসমানের হত্যাকারীরা তার সঙ্গে আছে, আর তিনি তাদের আমাদের হাতে তুলে দেন না।”
ইবন সা‘দ, আত-তাবাকাত আল-কুবরা (খণ্ড ৩)-এ বর্ণিত আছে যে, আলীর শাহাদাত (৪০ হিজরি / ৬৬১ খ্রিঃ) এর পর মুআবিয়া বলেছিলেন:
“আল্লাহ আবুল হাসান (আলী)-এর উপর রহম করুন। আল্লাহর কসম! তিনি সত্যিই সাহসী, দৃঢ়চেতা এবং ন্যায়বিচারে নিবেদিত ছিলেন।”
দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেক প্রসিদ্ধ স্কলার (যেমন হাসান আল-বাসরী, সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব, এবং মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ) মুসলমানদের মধ্যকার যুদ্ধগুলোকে (জামাল, সিফফীন, নহরওয়ান প্রভৃতি) প্রাথমিক উম্মাহর ঐক্য থেকে দুঃখজনক বিচ্যুতি হিসেবে দেখতেন।
দুই মুসলিম দলের মাঝে যুদ্ধ সম্পর্কে তাদের ইজতিহাদ (মতামত) সূক্ষ বিবেচনার দাবি রাখে – এমনকি ১৯৭১ এর যুদ্ধ সহ দুই মুসলিম দলের মাঝে যেকোন যুদ্ধ পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও (ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে)।
সাহাবীগণ:
আবদুল্লাহ ইবন উমর (রাঃ):
তিনি সিফফিন ও জামালের যুদ্ধে অংশ নেননি। তিনি বলতেন: “যে আমাকে ডাকে ‘এসো নামাজ পড়ো’, আমি সাড়া দেব। আর যে আমাকে ডাকে ‘এসো তোমার ভাইকে হত্যা করো’, আমি সাড়া দেব না।”
তাবারী, তারীখ আল-রুসুল ওয়াল-মুলূক, সিফফিনের ঘটনা (খ্রিঃ ৬৫৭)
সা‘দ ইবন আবী ওয়াক্কাস (রাঃ):
তিনি গৃহযুদ্ধগুলোতে নিরপেক্ষ অবস্থান নেন।
ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান-নিহায়া, খণ্ড ৭, পৃ. ২৩৮
তাবেঈন ও প্রাথমিক আলেমগণ:
মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আশ-শিখখীর (মৃত্যু: ৯৫ হিজরি / ৭১৪ খ্রি. খ্রিষ্টাব্দ) মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি:
মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আশ-শিখখীর ছিলেন প্রাথমিক যুগের মুসলিম আলেম ও তাবেঈ, অর্থাৎ সাহাবিদের পরবর্তী প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত।
মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ তাঁর গভীর তাকওয়া ও মুসলমানদের মধ্যে সংঘটিত ফিতনা (গৃহযুদ্ধ) থেকে দূরে থাকার প্রবল আগ্রহের জন্য পরিচিত ছিলেন। এর মধ্যে ছিল সিফফীন যুদ্ধ (৬৫৭ খ্রি., যেখানে হযরত আলী ইবনে আবি তালিব ও মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছিল)।
তাঁর যে বক্তব্যগুলো রয়েছে:
(ক) গৃহযুদ্ধ এড়িয়ে চলা: তিনি জোর দিয়ে বলতেন যে মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধ একটি ভয়াবহ বিপর্যয়, এবং একজন মুমিনের উচিত আরেকজন মুসলমানের রক্ত ঝরানো থেকে বিরত থাকা।
(খ) ফিতনায় নিরপেক্ষ থাকা: যখন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হতো কোন পক্ষের সাথে যোগ দেওয়া উচিত, তিনি পক্ষপাতিত্ব নিরুৎসাহিত করতেন। বরং তিনি ইবাদত ও আল্লাহর আনুগত্যে মনোনিবেশ করতে বলতেন।
(গ) ধৈর্যের নীতি: তাঁর উক্তি থেকে জানা যায়, মুসলমানরা যখন একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখন সবচেয়ে নিরাপদ পথ হলো ধৈর্য ধরা, রক্তপাত এড়িয়ে চলা এবং অন্যায়ের সাথে অংশগ্রহণ না করা।
সাধারণ প্রেক্ষাপট:
দ্বিতীয় প্রজন্মের অনেক প্রসিদ্ধ স্কলার (যেমন হাসান আল-বাসরী, সাঈদ ইবনে মুসাইয়্যিব, এবং মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ) মুসলমানদের মধ্যকার যুদ্ধগুলোকে (জামাল, সিফফীন, নহরওয়ান প্রভৃতি) প্রাথমিক উম্মাহর ঐক্য থেকে দুঃখজনক বিচ্যুতি হিসেবে দেখতেন। তাঁরা প্রায়ই উপদেশ দিতেন:
“যখন মুসলমানদের রক্ত ঝরছে তখন উভয় শিবির থেকেই দূরে থাকো।”
রাজনীতিক সংঘাতে জড়িয়ে না পড়ে ইবাদত, আল্লাহর স্মরণ এবং আত্মশুদ্ধির প্রতি মনোনিবেশ করো।
মূলত, মুতাররিফ ইবনে আবদুল্লাহ মুসলমানদের মধ্যে যুদ্ধকে ভীষণ বিপদ ও দুঃখের বিষয় বলে মনে করতেন। তিনি বরং দূরে থাকা, ধৈর্য ধারণ করা এবং অংশগ্রহণ না করার পক্ষে ছিলেন।
ইমাম আবু হানিফা (মৃ. ১৫০ হিঃ / ৭৬৭ খ্রিঃ):
তিনি তার ছাত্রদের ফিতনায় অংশ নিতে নিষেধ করেছিলেন, বরং নামাজ ও ধৈর্যের প্রতি জোর দিয়েছিলেন।
আল-খাতীব আল-বাগদাদী, তারীখ বাগদাদ, খণ্ড ১৩, পৃ. ৩৩৩
ইমাম মালিক (মৃ. ১৭৯ হিঃ / ৭৯৫ খ্রিঃ):
তিনি বিদ্রোহ ও মুসলিমদের মধ্যে যুদ্ধ নিরুৎসাহিত করতেন। বলতেন: “তরবারির দ্বারা যে কোনো ফিতনা হারাম।”
ইবন আবদুল বার, আত-তামহীদ, খণ্ড ২৩, পৃ. ২৭৮
ইমাম আশ-শাফিঈ (মৃ. ২০৪ হিঃ / ৮২০ খ্রিঃ):
তিনি ধৈর্য ও শান্তির উপর জোর দিতেন, তবে প্রকাশ্য অন্যায়ের ক্ষেত্রে অবস্থান নিতে বলতেন।
আল-উম্ম, খণ্ড ৪, কিতাব আস-সিয়ার
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (মৃ. ২৪১ হিঃ / ৮৫৫ খ্রিঃ):
তিনি অন্যায় শাসকের অধীনে ধৈর্য ধরতে বলতেন এবং মুসলিম রক্তপাত ঘটায় এমন বিদ্রোহকে নিষিদ্ধ করতেন।
ইবন কাইয়্যিম, ই‘লাম আল-মুওয়াক্কি‘ঈন, খণ্ড ৪, পৃ. ২১২
পরবর্তী আলেমগণ:
ইমাম গাজ্জালী (মৃ. ৫০৫ হিঃ / ১১১১ খ্রিঃ):
তিনি মুসলমানদের পারস্পরিক লড়াইকে বাইরের শত্রুর চেয়েও ভয়ংকর বলেছেন।
ইহইয়া উলূমুদ্দীন, কিতাব আদাব আস-সুহবা
ইবন তাইমিয়া (মৃ. ৭২৮ হিঃ / ১৩২৮ খ্রিঃ):
তিনি মুসলিম ঐক্যের উপর জোর দেন, এবং শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কেবল স্পষ্ট কুফরের ক্ষেত্রেই বৈধ বলেছেন।
মাজমূআ ফাতাওয়া, খণ্ড ৩৫, পৃ. ১৫–২০
ইবন হজর আল-আসকালানী (মৃ. ৮৫২ হিঃ / ১৪৪৯ খ্রিঃ):
তিনি গৃহযুদ্ধ সংক্রান্ত হাদীস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন— মুমিনদের উচিত হত্যা ও অন্যায়কে সমর্থন দুটোই এড়িয়ে চলা।
ফাতহুল বারী, সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যা, হাদীস ৩১
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ:
১৯৭১ সালের যুদ্ধ ঘটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে, যা পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)-এর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় অস্বীকার করার পর বিক্ষোভ বাড়তে থাকে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাদের সামরিক দমনপীড়ন ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ ঘটায়, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত ভারতের হস্তক্ষেপের পথ তৈরি করে।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে যুদ্ধ চাননি; বরং তাঁর অগ্রাধিকার ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও রাজনৈতিক অধিকার অর্জন করা, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভরপুর বিজয়ের পর। তিনি ধারাবাহিকভাবে আলোচনার মাধ্যমে এবং সাংবিধানিক ক্ষমতা হস্তান্তরের পথ অনুসরণ করেছিলেন। তবে পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা নির্বাচনের ফলাফল মানতে অস্বীকার করলে, এবং ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে শুরু হওয়া নিষ্ঠুর সামরিক অভিযান (অপারেশন সার্চলাইট) রাজনৈতিক সমাধানের পথ বন্ধ করে দেয়। গণহত্যা, গ্রেপ্তার ও হত্যাযজ্ঞ শান্তিপূর্ণ সমাধানের সব সুযোগ নষ্ট করে দেয়, এবং গণতন্ত্র ও আলোচনার মাধ্যমে যা মুজিব চেয়েছিলেন, তা স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিপুল প্রাণহানি ঘটায়, যদিও মৃতের সঠিক সংখ্যা এখনো বিতর্কিত। বাংলাদেশ সরকার দাবি করে যে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল, যা স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন এবং যা জাতীয় স্মৃতির অংশ, যদিও সরকার কখনো সঠিক হিসাব করেনি। অপরদিকে পাকিস্তান এই দাবিকে অস্বীকার করে এবং অনেক কম সংখ্যা প্রস্তাব করে, যা ২৬,০০০ থেকে ১ লাখ এর মধ্যে। বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও, নৃশংসতা ও গণহত্যা অস্বীকারযোগ্য নয়।
প্রশ্ন:
১) ১৯৭১ এর যুদ্ধকে কি মুসলিম-অমুসলিম যুদ্ধ হিসেবে নাকি মুসলিম-মুসলিম যুদ্ধ হিসেবে মূল্যায়ন করা যায়? আপনি পাকিস্তানী শাসককে জালিম বলতে পারেন কিন্তু কাফের বলতে পারেননা।
২) উপরের ইসলামিক স্কলারলি দৃষ্টিকোণ থেকে ১৯৭১ এর যুদ্ধে শুরুতেই অংশ নেয়া কি ইসলামের দৃষ্টিতে বৈধ আরেক পক্ষ যদি ‘কাফের’ না হয়ে থাকে?
নাকি সর্বাগ্রে দুই মুসলিম দেশের মাঝে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা দায়িত্ব? যেখানে ভারতের মত শত্রু কাফের দেশ এ যুদ্ধতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিল নিজের স্বার্থে?
কোনটি সবচেয়ে প্রথমে করা প্রয়োজন?
জুলুমকারী মুসলিমকে সংশোধন করা অবশ্যই কর্তব্য।
পাকিস্তানী বাহিনী ক্ষমা চাইতে পারে এবং চেয়েছে। কারন তারা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে।
কিন্তু যারা এ যুদ্ধ চায়নি – বা যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছে উপরের উল্লিখিত ইসলামী মূলনীতি অনুযায়ী এবং কোন হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় নাই — বরং মানুষ বাঁচাতে চেয়েছে এবং একই সাথে যুদ্ধ বন্ধ করতে চেয়েছে — তারা কেন ক্ষমা চাইবে?
কোন ইসলামিক মূলনীতি অনুযায়ী?
আরও বড় প্রশ্ন থাকে: জামায়াত যদি ৭১ এ মুসলিম দলের (পশ্চিম পাকিস্তান) বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়ানো থেকে বিরত থাকে এ ইজতিহাদের উপর ভিত্তি করে যে: তারা ইসলামিক অনুশাসন পূর্ণভাবে পালন করছেন (উপরের ৩টি মূলনীতির আলোকে), তবে ৫০ বছর পর, নিছক মানুষকে সন্তুষ্ট করতে কেন সেই ইসলামিক অনুশাসন পালনের জন্য ‘ক্ষমা প্রার্থনা’ তথা দু:খ প্রকাশ করবে? এতে কি ইসলামিক বিধানকে ছোট করা হবে না?
বিষয়: বিবিধ
১২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য






































পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন