কানা মায়ের ধনী ছেলে
লিখেছেন লিখেছেন মোঃ মাসুম সরকার আযহারী ২৪ মার্চ, ২০১৫, ০২:৩০:০৩ রাত
(আরবী থেকে অনূদিত)
আমার মায়ের ছিল এক চোখ কানা। এ জন্যে আমি মাকে খুব অপছন্দ করতাম। কারণ মা'র এই বিশ্রী চোখের কারণে আমাকে বন্ধু-বান্ধবদের সামনে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। কারণ আব্বা মারা যাওয়ার পর তিনি পরিবারের ভরণ-পোষণের জন্য আমাদের কলেজের হোস্টেলে বুয়ার কাজ করতেন। একদিন তিনি হোস্টেলে আমার রুমে আমাকে দেখতে আসেন। আমি এতে অত্যন্ত মনোক্ষুন্ন হই। ওনাকে অবজ্ঞা করি। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আড়চোখে এক নজর তাকিয়ে মনের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করি। মনে মনে ভাবি, কেন তিনি একাজটা করতে গেলেন। বন্ধু মহলে আমাকে লজ্জা দিলেন, হেয় করে গেলেন। পরেরদিন এক বন্ধু বলেই বসলো- " দোস্ত তোর মায়ের কি এক চোখ কানা"? শুনে অত্যন্ত লজ্জা পেলাম। মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে যদি মাটি বিদীর্ণ হয়ে যেত তাহলে আমি নিজেকে মাটির নীচে চাপা দিতাম। মাকে আমার জীবন থেকে আড়াল করতে পারতাম। নিজে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতে পারতাম।
যাইহোক, পরদিন মার সাথে সাক্ষাৎ করলাম। অত্যন্ত কর্কশ ভাষায় বললাম- "তুমি কেন আমাকে মানুষের হাসির খোরাক বানাও? তুমি মরতে পারো না? প্রতিদিন কত ভাল ভাল মানুষ মারা যায়, আজরাইল তোমারে চোখে দেখে না…।?"
মা নীরবে সব শুনে গেলেন। কোন উত্তর করলেন না। প্রচণ্ড রাগের মাথায় আমার মুখে যা এসছে নির্দ্বিধায় সব বলে ফেলেছি। কী বলেছি অতসব চিন্তা করারও সময় নাই। মা কী মনে করবেন, মনে কষ্ট পাবেন কিনা এতকিছু মাথায়ই আসে নাই। মনের ঝাল মিটিয়ে চলে আসলাম কলেজে। সে দিনের বকাঝকার পর থেকে মা আর কোন দিন হোস্টেলে আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন নাই।
এদিকে আমিও খুব মনযোগ সহকারে লেখা পড়া চালিয়ে যেতে থাকি। অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে লেখা পড়া শেষ করি। বিদেশে বিখ্যাত কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য দরখাস্ত করি। স্কলারশিপ পেয়ে বিদেশ থেকে লেখা পড়া শেষ করে দেশে আসি। ভাল একটা কম্পানিতে উঁচু বেতনের চাকরী পেয়ে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলি। বিয়ে করে ছেলে মেয়ে সংসার নিয়ে খুব আরামে জীবন যাপন করছি।
কয়েক বছর হয়ে গেল মা'র সাথে কোন যোগাযোগ নেই। ছেলের বৌ, নাতি-নাতনী কাউকে এখনো দেখেন নাই। তাই বলা নাই কওয়া নাই হঠাৎ একদিন মা আমার বাসার সামনে এসে হাজির।
দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই ছেলে মেয়েরা টেগরা ভিক্ষুক ভেবে হাসা হাসি শুরু করে দিল।
আমি খুব জোড়ে চেচামেচি শুরু করলাম। বললাম-"কত বড় সাহস! তুমি আমার সন্তানদের ভয় দেখাতে আসছ! এই মুহূর্তে দূর হও এখান থেকে।" জবাবে অত্যন্ত শান্ত কণ্ঠে বললেন-" খুবই দুঃখিত বাবা। মনে হয় আমি ভুল ঠিকানায় চলে এসেছি।" এই বলেই বিদায় নিলেন।
একদিন কলেজ থেকে একটি চিঠি পেলাম। কলেজের পক্ষ থেকে পূনর্মিলনী অনুষ্ঠান হবে। পরিবারের সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। স্ত্রীকে বললাম-"জরুরী অফিসিয়াল কাজে আমাকে বাইরে যেতে হবে"। অনুষ্ঠান শেষে আসার পথে আমাদের পুরাতন বাড়ীর একটু খোঁজ নেয়ার জন্য গাড়ী থেকে নামলাম। প্রতিবেশীরা জানলেন- "তোমার মা না ফেরার দেশে চলে গেছে্ন"। মায়ের মৃত্য সংবাদ শুনে চোখে পানি আসা দূরে থাক একটু মন খারাপও হয়নি। প্রতিবেশীরা বলল তোমার মা তোমার জন্য একটা চিঠি রেখে গেছেন। চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে লাগলাম-
আমার প্রিয় বৎস!
কত দিন হলো বাবা তোমাকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।আমি ঐদিন তোমার সন্তানদেরকে ভয় দেখানোর জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। সেদিন যখন শুনেছি তুমি কলেজের পূনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আসবে, কতো যে খুশী হয়েছি! কিন্তু বাবা আমি বিছানা থেকে উঠতে পারি না। তাই তোমাকে দেখতে যেতে পারি নাই। আমি অত্যন্ত দুঃখিত এই জন্যে যে আমার জন্য জীবনে বহুবার তোমাকে বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়েছে। বাবা! তোমার হয়তো স্মরণ নেই। বাল্যকালে তুমি এক মারাত্মক দূর্ঘটনার শিকার হয়েছিলে। এতে তোমার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মা হিসেবে তোমার এমন দৃশ্য দেখা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক ছিল। তাই আমি আমার একটি চক্ষু তোমাকে দান করেছিলাম। আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছিলাম এই ভেবে যে, আমার ছেলে আমার চক্ষু দিয়ে দুনিয়ার সৌন্দর্য উপভোগ করবে।
একরাশ ভালবাসা নিও।
ইতি
তোমার মা
বিষয়: বিবিধ
১৪৪০ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইয়া আল্লাহ আমার পিতা-মাতার উপর রহমত বর্ষন করুন। তাদেরকে ক্ষমা করুন। আর তাদের প্রতি যথাযোগ্য সুবিচার না করতে পারার কারনে আমাকে মাফ করুন। আমার সকল পাপ ক্ষমা করুন
০ গল্পটা খুব হৃদয় ছুঁয়ে গেল । তবে ....
একজনের চোখ কি আরেকজনকে দান করা যায় ? কর্নিয়া দান করা যায় তবে সেটা দানকারীর মারা যাবার পর । আমাদের দেশেও এর নজির আছে ।
কিন্তু সম্পূর্ণ একটা চোখ দান করা কি যায় যার ফলে গ্রহিতা দৃষ্টি শক্তি ফিরে পায় ?
কথা গুলো অন্তরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিলো...! এমন কথা শুনলে কার মন ভালো থাকে???
গল্পটা খুবই সুন্দর হয়েছে, ধন্যবাদ।
অন্তর নাড়া দিয়ে যাওয়া গল্পটির জন্য শুকরিয়া! জাযাকাল্লাহু খাইর!
মন্তব্য করতে লগইন করুন