Sing Sing Singapore: ২য় এবং শেষ পর্ব (ছবি সমৃদ্ধ, ভ্রমন কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:৩৫:৪৯ দুপুর
দ্য মারলিওন, সিঙ্গাপুর
৪। শপিং অভিজ্ঞতাঃ সপ্তাহান্তে ভায়রা ফাহিমের ছুটি। গাড়ির সার্ভিস পাওয়া যায়। ওদের সাথে শনি আর রবিবারে সিঙ্গাপুর বোটানিক গার্ডেন, সিঙ্গাপুর ফ্লায়ার (এশিয়ার সবচেয়ে বড় নাগরদোলা), মেরিনা বে / গার্ডেনস বাই দা বে, সেন্তসা আইল্যান্ড এ ফোরট সিলসো ও লেজার গান ফাইট / বাটারফ্লাই পার্ক / লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো / থ্রিডি আর ফোর ডি সিমুলেশন রাইড, আন্ডারওয়াটার ওয়ার্ল্ড এ ডলফিন আর সিল শো ইত্যাদি টুরিস্ট স্পট ঘোরা হয়ে গেল।
ফোরট সিলসো, সেন্তসা, সিঙ্গাপুর
গার্ডেনস বাই দ্য বে, সিঙ্গাপুর
রোববার রাতে অর্চারড রোডে গেলাম ডিনার করতে। দুপাশে দুনিয়ার সব নামকরা ব্র্যান্ড শপের সমাহার, বিশাল বিশাল সব শপিং মল। পাওয়া যায়না এমন কিছু আছে বলে মনে হয় না। মাটির নিচে, উপরে সব দোকান আর দোকান। আমার একটা ক্যামেরার মেমরি কার্ড দরকার, ১৬ গিগাবাইট হলে চলবে। উপরের বাহারি দোকান গুলোতে দাম বেশি হবে ভেবে ঢুকে পড়লাম পাতালে। মুখের দোকানটায় দাম হাঁকল ৮০ ডলার, আমার শপিং অভিজ্ঞতা বলে, জিনিস কিনতে হয় ভিতরের দোকান গুলো হতে। তুলনামূলক সস্তা পাওয়া যায়। মাঝের দুটো দোকানে ৫৫-৬০ ডলার দাম দিল। একদম ভিতরে এক দোকানি বল্ল-‘স্যার আপনি শেষ ক্রেতা, দোকান বন্ধ করে দিচ্ছি, শুধু আপনার জন্য বিশেষ ডিসকাউন্ট মূল্য ৪০ ডলার’। ৪০ ডলারে কিনে রাজ্য জয় করার হাসি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। মুনমুনদের বললাম - দেখেছ কিভাবে শপিং করতে হয়, আর তোমরা বেশি বেশি দাম দিয়ে জিনিস কিনো? অন্যরা কেউ তর্ক করার সাহস পেল না, তারিফ করল ‘ আসলেই দারুন শপিং’! দুদিন পর মোস্তফা সেন্টার (সিঙ্গাপুরের অন্যতম বিখ্যাত ফিক্সড প্রাইস শপিং মল) এ গিয়ে আমার হাসি উবে গেল। একই মেমরি কার্ড টার দাম ১৫ ডলার।
আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, সেন্তসা, সিঙ্গাপুর
৫। ভিক্ষুক ও ভুরিভোজনঃ মোস্তফা সেন্টার এর পাশ দিয়ে হাঁটছি। রবিবার রাত, নয়টা বাজে প্রায়। বাংলাদেশী আর উপমহাদেশীয় লোকজনের ভিড়ে হাঁটা দায়। শনি – রবিবার এখানে সবাই সময় কাটাতে আসে, নিজের দেশের আমেজ পাওয়া যায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেক বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টের সাইনবোর্ড ও দেখতে পাচ্ছি। ভাবছি কোনটাতে ডিনার করা যায়। এক ভদ্রবেশি পাকিস্তানি দম্পতি কাছে এসে দাঁড়াল। ‘আপনার কাছে কিছু ডলার হবে? আমাদের ব্যাগ ডলারসহ হারিয়ে গেছে। ডিনার করব তারপর বাসায় ফিরব’। মুখে কোন অসহায়ত্ব বা চিন্তার লেশমাত্র নেই, হাসি মুখ। প্রফেশনাল ভিক্ষুক মনে হয়। বউকে নিয়ে ভিক্ষা করছে। কোনমতে এড়িয়ে একটা ভাল রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়লাম। দুজনের পছন্দ অনুযায়ী অর্ডার দিলাম, কিছু এক্সপেরিমেন্টাল ডিশ সহ। মাঝে মাঝে ব্যাকফায়ার করে এক্সপেরিমেন্ট করাটা, এবার করল না। সব সুস্বাদু খাবার। ভুরিভোজন শেষে পান চিবুতে চিবুতে বের হলাম। কিছু দুর হাঁটার পর খেয়াল হল একটা লোক পিছন হতে দৌড়াতে দৌড়াতে আমার দিকে আসছে। রাস্তার মৃদু আলো। বাংলাদেশ হলে নির্ঘাত দৌড় দিতাম। মনে হল সেই পাকিস্তানিটা নাকি আবার? একটু জোরে হেঁটে দিক বদলে অন্যদিকে গিয়েও লাভ হল না। আমার পিছেই আসছে, হাতে একটা সাদামত কিছু। মুনমুনকে বললাম তুমি মার্কেটে ঢুকে পড়, আমি দেখছি। লোকটা কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ‘স্যার আপনাদের খাবার বিল দিতে ভুলে গেছেন’। লজ্জা পেয়ে বললাম ‘সরি, তোমরা কেউ কিছু বললে না, বিল ও দিলে না। খাবার বেশি মজা ছিল, বিলের কথা ভুলিয়ে দিয়েছ’। বিল মিটিয়ে দিলাম।
বোটানিক্যাল গার্ডেন, সিঙ্গাপুর
৬। চাইনিজ ড্রাইভারঃ বাসায় ফিরব। ট্যাক্সি, এক চাইনিজ ড্রাইভারের পাল্লায় পড়লাম। আমাদের কোন সুযোগ না দিয়ে পুরো রাস্তা এক নাগাড়ে বকবক করে গেল। মাঝে আমার দুয়েকবার মনে হল দরজা খুলে লাফ দেই। পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার পারিবারিক ইতিহাস আমার মুখস্ত হয়ে গেল। বেচারার দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, ১০-১২ ঘণ্টা ট্যাক্সি চালিয়ে বাসায় গিয়ে বউ আর ৪ ছেলে মেয়ের রান্নাবান্নার দায়িত্ব ও তাকে নিতে হয়। তার বউ ঘরের কোন কাজ করে না। সে এত টায়ার্ড থাকে, ট্যাক্সি কোথাও পার্ক করলেই ঘুমিয়ে পড়ে। আহা বেচারা। তার একটা মন্তব্য মনে পড়ছে,‘আমার জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের মুহূর্ত ছিল আমার শাশুড়ির সাথে দেখে হওয়া। আমাদের এলাকার ছিলেন, আমাকে পটিয়ে কিভাবে যেন উনার অকর্মা মেয়েকে আমার কাঁধে গছিয়ে দিয়েছেন। সারাজীবন ভাজা ভাজা হয়ে গেল’।
সিঙ্গাপুর ডিসকভারি সেন্টার
৭। মেয়েকে নিয়ে আউটিংঃ আগের দেখা বলে কিছু দর্শনীয় স্থান মুনমুন দেখতে গেল না। শিক্ষামুলক হওয়াতে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাইন্স সেন্টার, ডিসকভারি সেন্টার, আর্মি মিউজিয়াম, স্নো সিটি ইত্যাদি ঘুরে সন্ধ্যার সময় এক বন্ধুর সুপারিশে ‘ব্যাটম্যান’ ছবিটা দেখতে গেলাম। পুরা হলে মাত্র ৭ জন দর্শক। ৯ বছরের মেয়ে। বাচ্চাদের ছবি মনে করে সাথে এনেছি। আধঘণ্টা পরেই রোমান্টিক দৃশ্য শুরু হয়ে গেল। স্ক্রিনে বাইরে বৃষ্টি, হালকা তুষারপাত আর রুমে ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বেলে নায়ক নায়িকার আবেগঘন দৃশ্য। ঠোঁট দুজোড়া এগিয়ে আসছে। গায়েও স্বল্পবসন। বিপদে পড়লাম। মেয়েকে নিয়ে উঠতেও পারছিনা, আবার ওর চোখ চেপে ধরলেও মুশকিল। স্থির হয়ে জমে আছি। মেয়েই এগিয়ে এল। ‘পাপা, চল যাই। ছবিটা ভাল লাগছে না’। উঠতে যাব, দৃশ্যটার ততক্ষনে সমাপ্তি ঘটল। তারপর অবশ্য আর এধরনের সমস্যা হল না। একটা স্মরণীয় দিন কাটিয়ে বাসায় ফিরলাম।
সিঙ্গাপুর জু
৮। বিমান অফিসঃ দেশে ফিরব। বিমানের রিটার্ন টিকেট কনফার্মেশন এর জন্য এনসন রোডের পাশে বিমান অফিসে গেলাম ফাহিমকে নিয়ে। খুব সুন্দরী এক মহিলা ডেস্কে বসা। অভ্যর্থনা ও টিকেটের কাজ দুটোই দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন। বাথরুমে যাওয়া দরকার। একজন সুন্দরী মহিলাকে বাথরুমের কথা বলতে অস্বস্তি লাগছে। উপায় নেই, বলতেই হল। হাসিমুখে বললেন ‘এখানকার বাথরুম বিশেষ ব্যবস্থায় চলে। আমার চাবিটা নিয়ে যান। অফিস হতে বেরিয়ে করিডোরে হাতের ডানে একটা দরজা পাবেন, এই চাবি দিয়ে খুলবেন। অফিসের স্টাফদের ১ টা করে চাবি দেয়া আছে’। ইতস্তত করে নিলাম। ওয়াশরুমের ভিতরে ১ টা টয়লেটে ঢুকে চাবিটা কমোডের উপরে দেয়াল ঘেঁষে একটা কাঠের র্যাকে রাখলাম। র্যাক এর ঢাকনায় যে সমস্যা আছে কে জানত! চাবিটায় যেন চাকা গজিয়ে গেল। ঢাকনাটা সুন্দর করে কাত হয়ে চাবিটা শেষ মাথার ফাঁক দিয়ে বাক্সের একদম তলায়। হাত দিয়ে নাগাল পাওয়া যাচ্ছে না, তার উপর বেশ কিছু পাইপ আর ভালভের জন্য উদ্ধার করা আরও দুঃসাধ্য ব্যাপার। একটা লাঠি হলে চেষ্টা করে দেখা যায়। বাথরুমে কোন লাঠি জাতীয় কিছু পেলাম না। আশপাশে কোন ক্লিনার বা কেয়ারটেকার ও নেই। বাথরুম হতে বেরোতেই লক হয়ে গেল। হায় হায়, চাবিটাও ভেতরে। আবার ঢুকি কেমনে? ক্লিনারদের কাছে থাকতে পারে। লাঞ্চ ব্রেক চলছে। সিঙ্গাপুরি, চাইনিজরা নাকি খুব বন্ধুবৎসল আর সাহায্যকারী চরিত্রের। গার্ড আর ৩/৪ জন ক্লিনার আয়েশ করে আড্ডা দিচ্ছে। অনেক অনুরোধ পরও একটাকেও নড়াতে পারলাম না। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে টিকেট ডেস্কের মহিলার কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। উনি হেসে জানালেন ‘ক্লিনারদের দিয়ে চাবি উদ্ধার করিয়ে দেবেন’। হাঁপ ছেড়ে বাচলাম। টিকেট নিয়ে কোনমতে অফিসের বাইরে পালিয়ে বাঁচলাম।
বাটারফ্লাই পার্ক, সেন্তসা, সিঙ্গাপুর
৯। খাবার দাবার ও অন্যান্যঃ সিঙ্গাপুর একটা বৈশ্বিক মিলনমেলা। সব ধরনের সংস্কৃতি আর খাবারের সমাহার। বেংকুয়েট একটা চেইন ফুডকোর্ট আছে যাতে সব স্টল মুসলিমদের খাবার বিক্রি করে। আর কপিটিয়াম ফুডকোর্টে মালয় ও ইন্দোনেশিয়ান স্টলে হালাল খাবার পাওয়া যায়। এমনিতে জাপানিজ, চাইনিজ, স্প্যানিশ, ভিয়েতনামি, ইন্ডিয়ান, আমেরিকানসহ যা চাই তাই পাওয়া যায়।
বাথরুমগুলো এত সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন করে রাখা, মেঝেতে শুয়ে পড়া যায়। সমস্যা শুধু দুয়েক জায়গা ছাড়া বাকীগুলোতে পানির ব্যবস্থা নেই। সাথে পানির বোতল নিয়ে ঘোরাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
১০। জায়গার অভাবে অনেক ঘটনাই উল্লেখ করা হল না। ফাহিম আর মুনিয়ার মেহমানদারি ফাইভ স্টার হোটেলের চেয়ে কম নয়। ছেলে দুটো কদিনেই অনেক ঘনিসট হয়ে গেল। ছোটটা যেটা বাবা মায়ের নাম এখনও বলতে পারেনা, আতিক আতিক বলে আমার পিছে পিছে ঘুরতে লাগলো। হয়ত আতিক শব্দটা খুব সহজ ওর জন্য। ওদের ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হলেও বাস্তবতা মেনে প্লেনে উঠে বসলাম। ট্রানজিটে ঢাকায় ঘণ্টাখানেক দেরি ছাড়া আর বিড়ম্বনা পোহাতে হয়নি। পেছনে রয়ে গেল অজস্র মধুর স্মৃতি।
বিষয়: বিবিধ
১৬৩৬ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
খুব ভালো লাগলো লিখাটি। সাথে ছবিগুলোও ছিল আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। অনেক কিছু জানতেও পারলাম। ভিক্ষুক তাহলে সব যায়গাতেই রয়েছে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
গদবাধা জীবনের একগুয়েমী কিছুটা হলেও এড়ানো যায় ভ্রমনে।অজানা অনেক বিষয় সম্পর্কে ধারণাও হয়।তাই তো ভ্রমনে উৎসাহ দিতে ঐশী বানী....سيروفى الارض...(তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমন কর আর.....)
শপিংয়ের জিতে গিয়ে খাওয়ার বিল ভূলা স্বাভাবিক ব্যাপার।মাঝে মাঝে বিব্রতকর অবস্হার শিকার হওয়া ভ্রমনকেই স্মরণীয় করে রাখবে।
অনেক ধন্যবাদ.........।
সেন্তোসার সিনেমেনিয়া কি আছে এখনও?
মুভির সাথে যেখানে চেয়ার ও ঘুরে।
ধন্যবাদ কষ্ট করে পড়ার জন্য
### সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগলো বেচারা টেক্সি ড্রাইভার এর জন্য।
### বাথরুমের ঘটনাটা বেশ মজা পাইছি..... হাহাহহা
### ভাইয়া আমার মনেহয় এখন প্রায় সব সিনেমাই “সুগার ক্বোটেড্ ট্যাবলেট” এর মতো দুরে থাকতে পারলেই ব্যাট্যার.....
### আমার মামণিটার জন্য মনের ভিতর থেকে দোআ আসলো। আসসালামু আলাইকুম প্রিয় মামণি, তোমাকে আল্লাহ্ একজন দ্বীনদার মুত্ত্বাকী আদর্শ নারী হিসেবে কবুল করুন। আমীন। (মামণির কাছে পৌঁছায়ে দিবেন আমার এই দোআ ও সালাম)।
মন্তব্য করতে লগইন করুন