Sing Sing Singapore - প্রথম পর্ব (ভ্রমন কাহিনী)
লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৩:৩৮:৩৪ দুপুর
১।এয়ারপোর্ট ও ইমিগ্রেশন
বাংলাদেশ বিমানের সাথে সখ্যতা আমার পুরানো। দেশের রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা আর ট্রাফিক জ্যামের সাথে বিমান ভাগ্যিস তাল মিলিয়ে চলে। কদিন আগেই ঢাকা হতে চট্টগ্রাম ফিরছিলাম। বনানিতে এক বিদেশগামী বন্ধুর সাথে দেখা না করলেই নয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ফ্লাইট। বন্ধুর বাসা ঘুরে মহাখালি, এয়ারপোর্ট রোডের জ্যাম পেরিয়ে আভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে পৌঁছলাম সন্ধ্যা সাতটা আঠারো মিনিট। অন্য এয়ারলাইন হলে বাসায় ফিরে যেতাম নির্ঘাত। বন্ধু বিমান বলেই ভরসা ছিল। আমাকে আশাহত করেনি, বিলম্বিত ফ্লাইট রাত আটটা পনের মিনিটে। এরকম আরও অনেক মজার অভিজ্ঞতা আছে বিমানে চড়া নিয়ে। খোঁজ নিয়ে জেনেছি সিঙ্গাপুর যাত্রার তারিখের আগের ৪ দিনে দুই দিন ফ্লাইট বাতিল হয়েছে আর দুই দিন কয়েক ঘণ্টার বিলম্ব। সেই বিমানে যাত্রার জন্য সাত সকালে ঘুম হতে উঠে দুই আড়াই ঘণ্টা আগে পৌঁছাতে গাত্রদাহ হচ্ছিল। ধীরে সুস্থে উঠে লাগেজ আর স্ত্রী – কন্যাসহ ভোর সাড়ে ৬টায় উত্তরা হতে রওয়ানা দিলাম। ফ্লাইট সকাল সাতটা চল্লিশে। সাতটায় আন্তর্জাতিক টার্মিনালে পৌঁছে চক্ষু চড়কগাছ। আমরা আর আরেকটা ফ্যামিলি ছাড়া বাকিরা ইমিগ্রেশন পেরিয়ে গেছে। বিমান এত শোধরাল কবে থেকে? তাড়াহুড়া করে বোর্ডিং কার্ড নিয়ে কাস্টমস / ইমিগ্রেশন পেরিয়ে চড়ে বসলাম বিমানে।
২। বিমান ও বাথরুম – মাঝারি সাইজের এরোপ্লেন। দুপাশে ৩ জন করে সারি বাঁধা চেয়ার। খাবার বেশ ভাল। সমস্যা হল বাথরুম নিয়ে। ১৮০ জনের প্লেনে মোট বাথরুম ৪ টা। ২ টা ভিআইপি ১০ জনের জন্য, বাকী ২ টা ১৭০ জনের জন্য। এই ধরনের বৈষম্য মেনে নেয়া যায়? ৩০ হাজার ফুট উঁচুতে মানুষ আর বাথরুম পাবে কই। সে দুটোও একদম শেষ মাথায়। সাড়ে ৩ ঘণ্টার ফ্লাইটে সারাক্ষণই ১২/১৫ জনের লাইন লেগে রইল। এদের অনেকেই আবার ফ্লাশ করার সুইচটা খুঁজেই পেল না। মহিলাদের অনেককেই দেখা গেল, লাইন ধরে বাথরুমে পৌঁছালেও একনজর দেখেই মুখে কাপড় চেপে সিটে ফিরে যাচ্ছেন। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা! সীট আর এসির অবস্থা অবশ্য মোটামুটি ভাল। প্লেনের এসি নিয়ে কদিন আগের একটা মজার ঘটনা মনে পড়ল –
চট্টগ্রাম হতে ঢাকা যাচ্ছি। প্লেনে চড়ে বসতেই খুব গরম বোধ হল। প্লেনে দেয়া পত্রিকাকে হাত পাখা বানিয়ে অনেকেই বাতাস করছেন নিজেকে। এয়ারহস্টেস কে ডেকে জিজ্ঞেস করতেই হাসি মুখে জানাল ‘কোন সমস্যা নেই’। প্লেন আকাশে উড়ল। গরমে হাঁসফাঁস করছি। আবার ডাকলাম ভদ্রমহিলাকে। একটু বিব্রতমুখে বললেন ‘ শুরুতে একটু সমস্যা হয়, অল্প সময় লাগে এরপর ঠাণ্ডা হয়ে যাবে’। কতটুকু সময় লাগে? ‘এই তো স্যার, ঘন্টাখানেক’। হুম, ৪০ মিনিটের ফ্লাইট আর ঠাণ্ডা হতে লাগবে ১ ঘণ্টা, ইয়ার্কি মারার আর জায়গা পাও না (এটা অবশ্য মনে মনে বললাম)। হাল ছেড়ে দিয়ে আমাদের অনেকেই সীট হতে দাঁড়িয়ে এসির আউটলেটের ছোট্ট মুখটার কাছে নাক নিয়ে গেলাম। পাঙ্খা হাতে ঘুরালে যেরকম বাতাস আসে সেরকম হালকা বাতাসের মধ্যে একটু স্বস্তি পেলাম। ভাবছিলাম – এটুকুও বন্ধ হয়ে গেলে জানালা ভেঙ্গে বাইরে লাফিয়ে পড়লে বাতাস কি বেশি পাব না কম? এই প্লেনগুলো ১৫০০০ ফুট উচ্চতায় উড়ে। ভাগ্যিস অল্প দূরত্ব, দুর্দশার শেষ হল একসময়।
ভায়রা ফাহিম আর শ্যালিকা মুনিয়া আমাদের রিসিভ করে নিয়ে গেল। সেংকাং এর কাছে এঙ্করভেইল রোডে ৩ বেডের সুন্দর ও গোছান ফ্ল্যাট। MRT (Mass rapid transit) স্টেশনের পাশেই বাসা হওয়াতে আমাদের বেশ সুবিধা হল। যখন খুশি যানবাহনের চিন্তা না করে বেরিয়ে পড়া। সিঙ্গাপুর ভ্রমনের গল্প লিখে এত স্বল্প পরিসরে শেষ হবে না, আমি কিছু মজার অভিজ্ঞতা শেয়ার করব।
মেরিনা বে, সিঙ্গাপুর
৩। সিনেমা ও MRT: বিদেশে গেলে অন্যতম যে কাজটা করা হয় সেটা হল বড় স্ক্রিনে সিনেমা দেখা। দেশে দুঃখজনক হলেও সত্যি যে সিনেমা হলে যাবার মত না আছে পরিবেশ, না সপরিবারে দেখার মত সিনেমা তৈরি হচ্ছে। বিকেলে একটু বিশ্রাম নিয়ে উঠে পড়লাম। বিদেশে আমি শুয়ে বসে না থেকে চেষ্টা করি সময়গুলো যতটুকু সম্ভব কাজে লাগাতে। মুনমুন (স্ত্রী) তৈরি হতে হতে সিনেমা হল আর পছন্দের সিনেমা তালিকা তৈরি হয়ে গেল। ইন্টারনেটে টিকেট পাওয়া যাচ্ছিল ছবি শুরুর ঘণ্টাখানেক আগেও। অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ট্যাক্সি নিয়ে দ্রুত ‘গোল্ডেন ভিলেজ’ হলে পৌঁছলাম। পছন্দের তালিকায় ‘TAKEN 2’ আর ‘ENGLISH VINGLISH’। ‘TAKEN 1’ ছিল দুর্দান্ত, কাজেই আমার আগ্রহটা ওইদিকে। অনেক বছর পরে শ্রীদেবী এর ছবি এসেছে, মুনমুন ‘ENGLISH VINGLISH’ ছাড়তে রাজী নয়। দ্বিপাক্ষিক সমঝোতায় দুটোই দেখার সিদ্ধান্ত হল। এসব সিদ্ধান্ত নিতে নিতে সামনেরর সারি ছাড়া বাকী টিকেট বিক্রি হয়ে গেল। প্রথম সারিতে বসে একশন ছবি দেখা এক ধরনের শাস্তি, ক্যামেরার এত দ্রুত নড়াচড়া ! সেই শাস্তি ভোগ শেষে বেরোলাম, খিদে পেয়েছে। স্নেক্স খেয়ে হেলেদুলে টিকেট কাউনটার পৌঁছলাম। হিন্দি ছবি সিঙ্গাপুরে কে দেখবে? আরামসে যে কোন সীট নিয়ে শুয়েবসে দেখব। ডেস্কগার্ল জানাল, পাশাপাশি কোথাও দুইটা সীট নাই। ৩ টা মাত্র সীট বাকী। এর মধ্যে দুইটা সামনে পিছনে প্রথম দুই সারিতে আর বাকিটা মাঝামাঝি। ধুর! এভাবে দেখা যায়? লাইন ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, মুনমুন বলল সামনে পিছনে দুই সিটে দেখতে আপত্তি নেই। আবার গিয়ে লাইনের পিছনে দাঁড়ালাম। লাইন যখন ডেস্কে পৌঁছালো আর মাত্র ১ টা টিকেট বাকী। হেসে ফেললাম দুজনেই, আজ আর কপালে নেই। (পরদিন বিকেলে অবশ্য ছবিটা দেখেছি, চমৎকার ছবি। একজন গৃহিণীর ইংরেজি শেখার গল্প, যাকে নানা সময়ে ইংরেজির কারনে নিজের বাচ্চাদের কাছেই অপদস্ত হতে হয়েছে। )
বোটানিক্যাল গার্ডেন, সিঙ্গাপুর
রাত নয়টা পেরিয়েছে। ডিনার করতে গিয়ে গোটা পঞ্চাশেক রেস্টুরেন্টে ঘুরেও পছন্দসই হালাল খাবার পেলাম না। রিভারসাইড রেস্টুরেন্টগুলোতে পঞ্চাশোর্ধ্ব ধনী টুরিস্টরা তাদের কমবয়সী সঙ্গিনীদের (সম্পত্তির লোভে বা শুধু ট্যুরের জন্য ভাড়া করা) সাথে বিয়ারে চুমুক দিতে ব্যস্ত। বার্গার কিং এর বার্গার খেয়ে ফিরছি। তাড়া নেই, MRT চড়লাম। দশ বছর আগে বছরখানেক থেকে গেলেও অনেক কিছুর পরিবর্তন চোখে পড়ছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা সম্ভবত সংস্কৃতির। পশ্চিমা সংস্কৃতি সবখানেই হানা দিয়েছে। আগে ট্রেনে উঠলে দেখা যেত হাই হ্যালো, ঠোটে মৃদু হাসি আর মাথা নড করা। এখন সবাই ব্যস্ত মোবাইল, আইফোন আর আইপ্যাডে। ছোট্ট যন্ত্রটাই এখন সব আকর্ষণের কেন্দ্রতে। মেয়েদের কাপড় চোপড় আরও সংক্ষিপ্ত ও পশ্চিমা ধাঁচের। টিন এজ কিশোর-কিশোরীদের খোলাখুলি ঘনিষ্ঠতা চোখে পড়ার মত। ট্রেনে একেক বগিতে ৩০-৪০ জন বসতে পারলেও দাঁড়াতে পারে আরও শখানেক। একটা লম্বা সিটের একপাশে বসেছি। পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও ক’জন দাঁড়িয়ে। একদম কান ঘেঁষে কিশোর – কিশোরী এক প্রেমিক জুটি। ছেলেটা মেয়েটার কোমর জড়িয়ে আছে। মেয়েও কারনে অকারনে ছেলেটার গায়ে ঢলে পড়ে যাচ্ছে। দুজনের রোমান্টিক কথাবার্তা আর গালে গলায় চুমুর শব্দে আমারই কান লাল হয়ে যাচ্ছে। অনেকে ওদের দিকে বিরক্তির চোখে তাকিয়ে থাকলেও ওদের থোড়াই কেয়ার। ট্রেন সেং কাং এ এসে থামলো।
সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানা, লিলি
এখান হতে LRT (LIGHT RAIL TRANSIT) তে করে টং কাং (ফাহিমের বাসা) যেতে হয়। সেং কাং হতে দুটো লুপ দুদিকে চলে যায়। দুটোই ঘুরে আবার সেং কাং ফিরে আসে। ২০-২৫ মিনিটের এক এক রাউন্ড ট্রিপ। আমাদের গন্তব্য পশ্চিম লুপ। কমাস আগে সিঙ্গাপুর ঘুরে গেছি। অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পূর্বদিকের ভুল লুপে চড়ে বসলাম। রাত প্রায় এগারোটা, দুজনেই টায়ার্ড। কিছুটা রাগি গলায় মুনমুন বলল ‘তোমার উপর ভরসা করে এই অবস্থা’। আধঘণ্টা ঘুরপাক খেয়ে আবার সেংকাং ফেরত। নামতেই দেখলাম একটা LRT তে লোকজন উঠছে, দরজা বন্ধ হবার পথে। চট করে ঢুকে পড়লাম, প্রায় খালি। আরাম করে বসলাম। দরজা বন্ধ হতেই টের পেলাম আবার পূর্ব লুপে উঠে বসেছি। এবার আর তাকাতে পারছি না মুনমুন এর দিকে। ওর চোখে নির্ঘাত অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। অনেক কষ্টে সাহস সঞ্চয় করে বললাম – ‘দেশে তো সম্ভব হয় না, তাই সিঙ্গাপুরে হলেও তোমার সাথে যতটুকু সম্ভব বেড়িয়ে নিচ্ছি। ইচ্ছা করে উঠলাম, সবে তো মধ্যরাত। এই যে শুধু তুমি আর আমি, কেউ আমাদের চেনে না। অজানা গন্তব্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি, কি রোমান্টিক তাই না’। রাগ নেমে হাসি ফুটে উঠল। যাক এযাত্রা রক্ষা, বাসা পৌঁছালাম ঘড়ির কাঁটা প্রায় ১ টার ঘর ছুঁই ছুঁই।
(২য় পর্বে সমাপ্য)
বিষয়: বিবিধ
২০০১ বার পঠিত, ৩০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
১ম মন্তব্যের জন্য আলাদা শুভেচ্ছা।
অনেক ভালো লাগলো। তবে নিজ দেশের বিমানের করুন দশা জেনে খুব ব্যথিত হলাম। :(
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
ইনশা আল্লাহ।
তোমার সাথে নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে পরবর্তীতে আলাপ হবে।
ভালো থেকো।
ভাল লাগল। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন মেরিনা বে স্যান্ডস এর কাজ চলছিল। সেন্টোসা,বার্ড পার্ক আর নাইট সাফারি যান নাই? হালাল খাবার পেতে এত কষ্ট হলো কেন? সিঙ্গাপুর এ তো প্রচুর মালয়িদে এবং পঞ্জাবি রেষ্টুরেন্ট আছে।সেখানে হালাল খাবার পাওয়া যায়। এছাড়া চাইনিজ রেস্টুরেন্ট ছাড়া চেইন গুলিতেও হালাল খাবার পরিবেশন করা হয়। মুস্তাফা সেন্টার এর পাশে অনেক বাংলাদেশি রেষ্টুরেন্ট ও আছে। ছোট্ট দেশটায় কোন জায়গা ঘুরেই ঘন্টা খানেক এর মধ্যেই সেখানে আসা যায়।
আমার ইচ্ছা আছে আগামী যখন দেশে যাব, ম্যালেশিয়া,সিঙ্গাপুর ঘুরে আসব ।ইনশা আল্লাহ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন