বাবার সাথে দিনগুলি ------------
লিখেছেন লিখেছেন আতিক খান ২৫ এপ্রিল, ২০১৪, ১১:৫৫:০৪ রাত
বয়স ১৮ ছুই ছুই। কলেজের ২য় বর্ষে পড়ি। তারুন্যের উষ্ণ রক্ত শরীরে। ফুটবল খেলে অল্প আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে একটু দেরিই হয়ে গেল। সাড়ে ছটায় সন্ধ্যা হয়েছে। এখন বাজে আটটা। বাসার কাছাকাছি এসে পড়েছি। কামিনি আর মেহদি গাছের জন্য বাসার গেটটা দেখা যায় না। দূর হতে চাঁদের আলোয় একটা ছায়াকে হাঁটা হাঁটি করতে দেখেছিলাম। কাছাকাছি হতেই ছায়াটা প্রথমে লুকিয়ে গেল গাছের আড়ালে। আর একটু এগোতেই ছায়াটা বাসার ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝতে বাকি রইল না। রাগ হল প্রথমে। আমি কি এখনো ছোট? এখনো পাহারা দেবার কি আছে? এত দুশ্চিন্তার কি আছে? যত্তসব! এইভাবে গেটের বাইরে অপেক্ষার মানে কি? বন্ধুরা দেখলে কাউকে মুখ দেখানোর উপায় থাকবে? বলবে বুড়ো খোকা! এবারই প্রথম নয়, অগুনতি বার দেখেছি, অগুনতি বার মানাও করেছি। একটু দেরি হলেই বারান্দায় এসে বসা, আরো দেরি হলে বাইরে এসে অপেক্ষা, কবে বাড়ি ফিরব (তখন মোবাইল ছিল না)......।। এখন প্রতিদিন কতবার বাসায় ফিরি, অবচেতন মনেই ছায়াটাকে খুঁজতে থাকি।
ছায়াটা বাবার। যে ছায়াটা মাথার উপর হতে সরে গেছে ১০ বছর হল। আরো কত স্মৃতি ভিড় করছে মাথায়।
১। স্কুল জীবনের কথা। গায়ে জ্বর ১০৫ ডিগ্রি। ভোর ৪ টা বাজে। মাত্র ঘুমটা লেগে এসেছে। “বাবা উঠো। হরলিক্স দিয়ে দুইটা বিস্কিট আর ওষুধ টা খেয়ে নাও।“ আমি মহা বিরক্ত। “পারব না”। না খাওয়া পর্যন্ত পাশে বসে রইলেন। এই রুটিন চলল সুস্থ হওয়া পর্যন্ত। সকাল–বিকাল-রাত অক্লান্ত, সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। সময় হতেই ছায়াটা হাজির। কোন বিরক্তির চিহ্ন নেই মুখে। এখন নিজে অসুস্থ হলে যখন ওষুধের কথা মনে থাকে না- তখন মনে হয় “আহা, ছায়াটা যদি পাশে থাকতো।“
২। বয়স ৮/৯। বাসার করিডোর দিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম, রান্নাঘর হতে কাজের ছেলে বের হতেই আমাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ। ওর হাতে ধরা ফুটন্ত গরম পানির ডেকচি উলটে দিল আমার গায়ের উপর। সারা গায়ে যেন আগুন ধরে গেল। চিৎকার শুনে বাবা লুঙ্গি পরা অবস্থায় বেরিয়ে এলেন। পায়ে স্যান্ডেল নেই। সেভাবেই আমাকে কোলে তুলে নিয়ে অসহায় ছোটাছুটি, দুচোখে জলের ধারা। খালি পায়ে লুঙ্গি নিয়েই সারা হাসপাতাল দৌড়ালেন কেবিন আর ডাক্তারের খোঁজে। হাসপাতালে প্রায় দেড় মাস দিনে অফিস করে রাতে পাহারা দিয়েছেন, রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখেছি অশ্রুসিক্ত চোখ......।। বুকের ছোট্ট চিহ্নটাকে দেখলে আজো ছায়াটাকে অনুভব করি।
৩। ক্লাস ওয়ানে ফলাফল হল মোটামুটি, ৪ নম্বর। টু’তে উঠলাম। আমি পাগলের মত ক্রিকেট খেলি। বাবা আমাকে স্টেডিয়ামের দোকানগুলো দেখিয়ে বললেন – ১ম হতে পারলে পুরো ক্রিকেট সেট কিনে দেব। বাবার তখনকার আয়ের তুলনায় বেশ দামি ছিল। ক্রিকেট সেটের লোভে ১ম হয়ে গেলাম। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভাল ফলাফল হলেই দেখতাম ছায়াটার দুটো ভেজা চোখ, গর্বিত হাসি মুখ, অফিস / পাড়া প্রতিবেশি আর আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে মিষ্টি বিতরন। আজ এতদূর আসার পিছনে ছায়াটার অদৃশ্য হাত মনে হয় মাথার উপর মেলে আছে।
৪। ভাল ছাত্র ছিলাম, তাই মার খেতে হত কদাচিৎ। দু বারের কথা বিশেষ মনে আছে। কাজের ছেলের উপর মহা বিরক্ত হয়ে কাঁচি ছুড়ে মেরেছিলাম। ওর বাহুতে লেগে চামড়া উঠে গেল। অফিস হতে ফিরে ঘটনা শুনে চামড়ার বেল্ট হাতে আমাকে খোঁজা শুরু করলেন। আমি ততক্ষনে খাটের নিচে। ওখান থেকে বের করে বেল্টের মার দেয়ার পর বাধ্য করলেন কাজের ছেলের পা ধরে মাফ চাইতে। এর প্রভাবে আর কখনো কাজের লোকদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা হয়নি। ২য় বার খেলার কোন সামগ্রী কিনতে বাবার পকেটে হাত দিয়েছিলাম। টের পেয়ে বেদম মার। বাবার পকেট দূরে থাক, অন্যের টাকা ধরার সাহস ও আর হয়নি। সেটা ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রথম পাঠ।
৫। ২০০১ সাল। ইদানিং বাবার শরীর ভাল যাচ্ছে না। কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, হাঁটার সময় টেনে টেনে হাঁটা আর খাওয়ার সময় গিলতে কষ্ট। বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা বিভিন্নরকম মতামত দিচ্ছেন। সবার পরামর্শে ব্যাংকক নিয়ে গেলাম। বাবার সাথে আমার শেষ ভ্রমন। কদিনের পরীক্ষার পর আমাকে নিউরলজির বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ডেকে বললেন – আমরা মেডিকেল বোর্ডে আলোচনা করে এই ফলাফলে উপনীত হচ্ছি যে – উনার MND (মোটর নিউরন ডিজিজ) হয়েছে। এই রোগের চিকিৎসা নেই। উনার হাতে আর দুই হতে আড়াই বছর সময় আছে। তাও খুব ভাল চিকিৎসা পেলে। বারান্দায় বেরিয়ে দাঁড়ালাম। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের অসহায়তার কথা ভেবে চিৎকার করে কাঁদলাম। বাবার সামনে যাবার মত আর সাহস নেই। পা টিপে কেবিনে পৌঁছে বুঝলাম সর্বনাশ যা হবার হয়ে গেছে। ডাক্তার উনাকে বলে দিয়েছেন। আমার দিকে একটু শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন – আমার একটু কই মাছ খেতে ইচ্ছে করছে, এনে দিবি? এনে দিয়েছিলাম, আজ আমার আর কই মাছ খেতে ইচ্ছা করে না......।। খাওয়ার পর বললেন আমাকে একটু ব্যাংকক ঘুরিয়ে দেখা, বাইরের দুনিয়া আর যদি দেখা না হয়। শিশুর মত পা টেনে টেনে কষ্ট হলেও ঘুরলেন ক্লান্ত হবার আগ পর্যন্ত। মেট্রো রেলে চড়ে উনি দেখছেন শহরটা, আমি দেখছি উনাকে। খানিক পর পর চোখ জলে ভরে আসে.........। উনি না দেখেন মত মুছে ফেলি।
২০০৩ সাল, বাবা শেষ কমাস হুইলচেয়ারে ছিলেন। ব্যয়বহুল চিকিৎসা খরচ আর আর্থিক কারনে জাহাজে যেতে বাধ্য হলাম। ব্যাগ গুছাচ্ছি আর বাসায় ঘোরাঘুরি করছি। বিদায় নিতে উনার সামনে যাবার সাহস আমার নেই। মনে মনে দুজনেই জানি এটাই হয়ত আমাদের শেষ দেখা। অবশেষে যখন শেষ সালাম করতে কাছে গেলাম, দুজনেরই আবেগ আর বাঁধ মানল না। আমাদের ছাড়াতে বাকিদের বেশ কষ্ট হয়েছিল। উপরের ছবিটাই আমার মাথায় ছায়াটার শেষ ছোঁয়া আর আশীর্বাদ। দুজনেরই উপলব্ধি, আকুলতা আর অশ্রুবান হার মানল বাস্তবতার কাছে। ছায়াটাকে আর দেখিনি। আজ আর্থিক অনটন নেই। সব টাকার বিনিময়েও বাবার শেষ দিনগুলো কিনতে চাইব। যদি কিনতে পারতাম...............।
ঈদের দিন ফোনে কথা হয়েছিল। উনার কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমি অনর্থক আশার বানী শুনাচ্ছিলাম, আর উনি কাঁদছিলেন আর আমার গলা শুনছিলেন। কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন। এখন বুঝি - বলতে চাইছিলেন " আমার হাতে সময় কম, তোমাকে একটু শেষ বারের মত দেখতে খুব ইচ্ছা করে"।
ঈদের দুদিন পর জাহাজে বসে মৃত্যুর খবরটা আমার জীবনে কানে শোনা সবচেয়ে কষ্টের সংবাদ। শেষ দেখা দেখিনি, তাই আজো ছায়াটা ঘুরে বেড়ায় আমার অবচেতন মনে।
অসম্ভব মায়া আর গুনের অধিকারী লোকটার কিছু গুন হল – কারো অসুস্থতার কথা শোনা মাত্র সব কাজ ফেলে পৌঁছে যাওয়া, কারো জানাজা মিস না করা আর অন্যকে সাহায্য করার সাধ্যের অতীত চেষ্টা করা।
আজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় – না পেরেছি বাবার মত বাবা হতে, না পেরেছি উনার যোগ্য সন্তান হতে.....................।।
বিষয়: Contest_father
১৯৭১ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ফেলে আসা জীবনের ধুসর স্মৃতিগুলো যদি ফ্রেমে বাঁধতে পারি..ক্ষতি কি? আসলেই।
অভিনন্দন আপনাকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন