বাবাঃ শূণ্যতার হাহাকার!
লিখেছেন লিখেছেন ক্লান্ত ভবঘুরে ১০ মে, ২০১৪, ০৪:১০:৫৩ বিকাল
ভার্সিটিতে যাবার জন্য রেডি হচ্ছে শাওন। আজকে ভার্সিটিতে একটা প্রেজেন্টেশন আছে। ক্লাসের সিআর হিসেবে রেস্পনসিবিলিটি অন্যেদের চেয়ে একটু বেশিই। হঠাৎ করেই ফুফির ফোন। বের হতে হতে ফোন ধরলো সে।
সালামের পর ফুফি বলল- শাওন! তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আয়!
-কিন্তু কেন? আজকে আমার ইম্পোরট্যান্ট ক্লাস আছে...
-তোর আব্বু খুব অসুস্থ। এক্ষুনি চলে আয়।
কিছু বলার আগেই ফোন কেটে দিল ফুফি। কন্ঠটা কেমন জানি ভেজা মনে হলোনা- ভাবল সে! নাকি মনের ভুল! আবার ফোন দিতে গিয়েও থেমে গেল। কেন জানি মনে হল বাড়ি যাওয়া দরকার, ফোন দিয়ে লাভ নেই।
যাওয়ার পথে বাড়ি থেকে আরো অনেকের ফোন পেল। কিন্তু ফোন ধরার কোন ইচ্ছে হলোনা তার। কেমন অচেনা একটা অনুভূতি প্রকট হয়ে আসছে ভেতরে। মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আসতে চাইছে। আবছা আবছা বাবার কথা মনে পড়ছে। আসলে বাবার সাথে কোন সুখস্মৃতি নেই তার। ক্লাস সেভেন থেকেই বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশুনা করেছে সে। মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়িতে যাওয়া হত। তাই ফ্যামিলির সাথে গভীর কোন ইন্টারেকশন তৈরি হওয়ার সুযোগ ছিলনা। আর বাবার সাথে বলতে গেলে সে সময় থেকে দুরত্বই তৈরি হয়েছে শুধু। এমনিতে ও চুপচাপ স্বভাবের ছেলে, নিজেকে নিয়েই কাটতো সারাটাদিন। তবে বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে ফ্যামিলিতে অনেক আদর ছিল, আশেপাশের মানুষের কাছ থেকেও ভালোবাসা পেয়ে এসেছে শান্ত স্বভাবের ফলে। তবে বাবা যেন কেন বরাবরই নিস্পৃহ ছিলেন। ছেলের প্রতি আলাদা কোন টান বা ভালোবাসা কখনোই তাঁর মাঝে দেখা যায়নি। এক্ষেত্রে নিজেকে কিছুটা আড়াল করেই রেখেছিলেন। হয়ত ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছেন বলেই তাঁর নিজের ভেতরে ভালবাসার প্রকাশটা প্রকট হয়ে উঠতে পারেনি। তবে ছেলের পড়ালেখার প্রতি বরাবরই কেয়ারিং ছিলেন। অনেকটা স্কুলের শিক্ষকদের মতই। এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। ছোট কোন ভুলের জন্যও শাস্তি অবধারিত ছিল।
সারাটা পথ এরকম অগোছালো চিন্তা করেই কেটেছে তার। বাড়িতে পৌঁছার আগেই সে ঘটনা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলো। কিছুটা শূণ্যতাবোধ এসে তাকে জেঁকে ধরেছিলো। বাড়ির কাছে পৌঁছেই বাড়ির উঠানে লোক সমাগম দেখে সন্দেহ সত্যি হল তার। চিন্তাভাবনাগুলো তার জড়িয়ে আসছিলো। বাড়ি পৌঁছে কারো সাথে কোন কথা হলোনা তার। সোজা নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসেছিলো। তারপর বাকি ঘটনাগুলি একধরনের বোধশূণ্যতার মাঝেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কিছুটা শূণ্যতা, কিছুটা চিন্তার জড়তা আর কিছুটা ঘোর লাগা অনুভূতি মিলিয়ে একধরনের মিশ্র অনুভূতির মাঝেই বাবাকে মাটিতে শুইয়ে আসতে হয়েছে। অনেকেই তাকে স্বান্তনা দিতে চেয়েছেন আবার অনেকেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। রাতের দিকে খুব কাছের আত্মীয় স্বজন ছাড়া মানুষগুলো বিদায় নিলেন। আর কেমন জানি শুণ্যতাবোধটা আরো ভারি হতে লাগলো তার। ধোঁয়াটে অনুভুতির মাঝেই পার হলো একদিন।
পরদিন বিকেলে আসরের নামায শেষ করে বাবার টেবিলে গিয়ে বসলো শাওন। চুপচাপ কিছুক্ষণ বাবাকে মনে করার চেষ্টা করলো। বাবার সাথে গুটিকয়েক স্মৃতিগুলোকে মনের ভেতর আউড়ালো। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। সেই সাথে সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলি বলে এলাকায় গণ্যমান্য ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু ফ্যামিলিতে অনেকটাই চাপা আর রাগী স্বভাবের। ফ্যামিলিতে তাঁর ভয়ে সবাই চুপচাপ থাকতো। সেই কারণেই বাবার সাথে ভালভাবে মেশা হয়নি তার। বাবার হাত ধরে কখনো স্কুলে যাওয়া হয়নি তার। ছোটবেলায় তাকে স্কুলে দিয়ে আসার জন্য একজন ছেলে ছিলো। তবুও মাঝে মাঝে অন্যন্য ছেলেদের বাবা বা মায়ের সাথে বাড়ি ফিরতে দেখলে কষ্ট হতো তার। ক্লাস থ্রি এ পড়ার সময়কার একটা ঘটনা মনে পড়লো তার। সেবার সাংস্কৃতিক সপ্তাহের প্রেজেন্টেশান সিরোমনিতে প্রতিটা ছেলেমেয়ের সাথে তার বাবা অথবা মায়ের কেউ একজন এসেছিলেন। শুধুমাত্র সে-ই ছিল একা। যখন ম্যাম তাদের ক্লাসের সব স্টুডেন্টদের গার্ডিয়ানসহ গ্রুপ ফটো তোলার জন্য একত্রিত করলেন, তখন সে একা কোণায় দাঁড়িয়েছিল। প্রতিটা ছেলেমেয়ের পেছনে বাবা-মা দাঁড়িয়ে আছে, সে ই শুধু আলাদা। হঠাৎ ম্যাম এসে জিজ্ঞেস করেছিল, শাওন! তোমার আব্বুম্মু আসেনি? তখন সেদিনকার ছোট্ট ছেলেটা সবার সামনে কেঁদে দিয়েছিল।
সে প্রায় সময় কল্পনা করতো, বাবার সাথে সে হেঁটে যাচ্ছে। বাবার বড় হাতের মুঠোয় তার ছোট্ট হাতটা শক্তভাবে আটকে আছে। আর বাবা সেই হাতটা পরম মমতায় জড়িয়ে আছেন, যেন শত ঝড়ের ভেতরেও তিনি এই হাতটা ছাড়তে রাজি নন। এসব ছিল শুধুই কল্পনা। ক্লাস ফাইভে যখন সে ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ পেয়েছিলো, সেদিনও তার বাসা থেকে কেউ যায়নি তার স্কুলে। ক্লাস সেভেনে যখন সে দূরের একটা আবাসিক স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, প্রথম প্রথম সেখানে থাকতে তার খুব কষ্ট হতো। একবার বাড়িতে গেলে আর আসতে চাইতো না। ফলে প্রতিবারই বাবার বকা শুনতে হত, এমনকি মাঝে মাঝে সেটা মার পর্যন্তও গড়িয়েছে। পড়ালেখার ক্ষেত্রে বাবা বরাবরই কঠোর ছিলেন। ক্লাস এইটে উঠার পর একবার বাবা এসে তাকে হোস্টেল থেকে দুদিনের জন্য বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন, বাড়িতে মেহমান আসবে বলে। সেই একবারই এরকম কারণ ছাড়া ছুটি কাটিয়েছিলো সে। সেদিন যে কি আনন্দ হয়েছিল তার!
এসব ভাবতে ভাবতে চোখের কোণ ভারি হয়ে আসছিল শাওনের। তারপর সে তার বাবার টেবিলে রাখা একটা ডায়েরি হাতে নিলো। ফ্রন্ট পেইজে লেখা ছিলঃ "ছেলের প্রতি -একজন ব্যর্থ বাবা"। তার বাবার তেমন একটা লেখার অভ্যাস ছিলোনা। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে আস্তে আস্তে পৃষ্ঠা উল্টাতে লাগলো সে। তিন নম্বর পেইজটায় তার চোখ আটকে গেলো। সেখানে লেখা ছিলঃ
"গতকাল ছেলেটাকে দেখতে হোস্টেলে গিয়েছিলাম। ছেলেটার অনেক জ্বর এসেছে। বাড়িতে আসার জন্য ছটফট করছিল। কিন্তু ছুটি পাওয়া যায়নি। তাই আমি তার হোস্টেলে থেকে গিয়েছিলাম, সে অসুস্থ বলে অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। সারাটা রাত ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছিল। এই প্রথম ছেলেটা আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। আমি সারাটা রাত একটুও ঘুমাইনি। আমার মনে হচ্ছিল এটা আমার জীবনের অন্যতম সেরা একটা রাত! আমি ছেলেটাকে ভালোবাসি অনেক।" ৭ মে, ২০০৬ এ লেখা।
আস্তে আস্তে শাওনের চোখে সেই রাতটার কথা পরিষ্কার হতে লাগলো। সত্যি সে দিনটা তার জন্যও অনেক স্মরণীয়ে একটা দিন ছিলো। অনেকদিন সে এইরকম একটা রাতের কথা কল্পনা করেছে। বাবার কোলে মাথা রেখে নির্ভার একটা রাত।
আরো কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টালো সে। ৩৭ নম্বর পৃষ্টার লেখাটা ভাল করে দেখলো সে!
"আজকে আমার ছেলেটা আমার জন্য একটা কবিতা লিখেছিল। মেয়েটা আমাকে সেটা আমাকে সেটা দেখিয়েছিল। দেখার পর আমার আনন্দিত হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার বদলে আমি ছেলেটাকে ইচ্ছেমত বকাঝকা করলাম। পড়ালেখা ফেলে কি সব কবিতা লেখে! এসব যেন আর কোনদিন না দেখি। কিন্তু কেন আমি এভাবে বকেছিলাম জানিনা! এখন মনে হচ্ছে তাকে আমার জড়িয়ে ধরে একটু আদর করা উচিত ছিল! একটু উৎসাহ দেয়া দরকার ছিল। আমায় ক্ষমা করে দিস বাবা!" ফেব্রুয়ারী ১৮, ২০০৭।
আর এগুতে পারলো না শাওন। তার চোখের কোণ বেয়ে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। চিন্তাভাবনাগুলো জ্যাম হয়ে গেলো তার। একি আনন্দাশ্রু নাকি বেদনার জল? তাহলে এরকম শূণ্যতাবোধ হচ্ছে কেন? ভালবাসার কথা জানতে পারার আনন্দ এটা? নাকি এটা কাউকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার কষ্ট? আচ্ছা! আনন্দের পরেও কি শূণ্যতা গ্রাস করে কাউকে?
চারপাশে ভয়াবহ এক অভাব! মনে হচ্ছে পৃথিবীতে তাকে একা ফেলে চলে গেছেন বাবা। আর কখনো বকা খাওয়া হবেনা তার! আড়াল থেকে ভালোবাসার কথা লিখে রাখবে কেউ তার জন্য। চারপাশের পৃথিবীটা গভীর এক অন্ধকারে পতিত হয়েছে, আর সেখানে সে কেবল একাই হেঁটে চলেছে অদ্ভুত আনন্দমাখা এক শূণ্যতা নিয়ে... ইশ! বাবাটা যদি এখন থাকতো পাশে, তাঁর হাত ধরে পাড়ি দেয়া যেত এই অন্ধকার!
বিষয়: Contest_father
১৫৬৭ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাইয়া ।
তবে এটা একটা গল্প।
আমন্ত্রণ......
সুন্দর! অভিনন্দন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন