"মায়ার বাঁধন"
লিখেছেন লিখেছেন লুকোচুরি ২৭ আগস্ট, ২০১৪, ০১:০৩:১৯ দুপুর
- কানের সামনে এত ঘ্যান ঘ্যান করিস নাতো। একবার নিষেধ করেছিতো।
= প্লিজ মা, এই প্রথম আর এই শেষ। আর কখনো এই আবদার করব না। এইবারের মত ভাবির জন্মদিন টা পালন করতে দাও। বিয়ের পর এটাই আমাদের বাসায় প্রথম জন্মদিন ভাবির।
- প্রশ্নই আসে না অনুমতি দেয়ার। যা ইসলাম অনুমোদন দেয় না তার অনুমতি আমি কিছুতেই দিব না।
ততক্ষনে রাইসার আগমন। এসেই জিজ্ঞেস করছে,
~ কি ব্যপার? ওকে বকছেন কেন মা?
- দেখনা বউমা, ও কথাই শুনতে চায় না। ইসলামে যার অনুমতি নাই তা আমি ওকে কি করে করতে বলি।
~ আচ্ছা আমি ওকে বুঝিয়ে বলছি আর এমন করবে না।
রাইসা বলল, মুনমুনি চল আমরা কফি খেতে খেতে গল্প করি। মুনমুনি গাল ফুলিয়ে মায়ের কাছ থেকে চলে গেল। কফি নিয়ে দুইজন বাড়ির বাগানে গিয়ে বসল।
~ কিরে মুনমুনি, তুই মায়ের সাথে জেদ করছিস কেন? মা নিশ্চয়ই তোর ভাল হয় যেটায় সেটাই করতে বলছেন।
= মিষ্টি ভাবি শোন না, আমি একজনকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাইছি কিন্তু কিছুতেই মা অনুমতি দিচ্ছে না।
~ এটা কি ইসলামিক বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক? কিংবা এটার অনুমতি কি ইসলামে আছে?
= না নেই।
~ তাহলে? তুই কেন জেদ করছিস? তুই কি এমন কিছু করতে চাস যাতে আল্লাহ্ নারাজ হন? আল্লাহকে নারাজ করে তুই আরেকজনকে খুশি করতে চাস? এটা কি করে হয়? তুই কি মনে করিস এতে কল্যাণ রয়েছে?
= এটাতো মাথায় আসেনি।
~ মাথায় আনতে হয়রে পাগলী। শোন যাই কিছু করিস না কেন আগে দেখবি যে এতে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হন কিনা? যদি এমন হয় তো সেটা কখনই করবি না।
= আচ্ছা ঠিক আছে।
~ আর সারপ্রাইজ তো অন্যভাবেও দেয়া যায় তাই না? যাতে আল্লাহ্ও সন্তুষ্ট থাকেন আর সেই মানুষটিও খুশি হয়।
= হুম... বুঝেছি। এমনি এমনি আমি তোমাকে মিষ্টি ভাবি ডাকি না, তুমি এত মিষ্টি করে কথা বল যে কেউ তোমার কথার জাদুতে বিমোহিত হয়ে পড়বে। এরপর তুমি যাই করতে বলবে তাই করবে। অনেকটা হিপ্নোটাইজ করার মত।
~ হয়েছে হয়েছে... আর তেল দিতে হবে না। তোর দেয়া তেলে তেলায়িত হয়ে গেলে আবার তেলের জন্য যুদ্ধ বাঁধাবে মানুষ।
মুনমুনি তার ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। ভাইয়া বাসায় এলে দুই সদস্য বিশিষ্ট একটা রুদ্ধ দ্বার বৈঠক ডাকতে হবে।
ভাইয়ার সাথে মুনমুনির বৈঠক চলছে....
- কিরে গাধা হঠাৎ তোর মিটিং। মিটিং এর হেতু কি?
= আর বোল না, আমি চাইলাম ভাবির জন্মদিনে কিছু করতে কিন্তু আমার মাথায় ছিল না যে এতে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হবেন। এখন কি করি বলতো... আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
- আচ্ছা বল কি করেছিস? আগে শুনি তারপর দেখা যাবে।
= আমি ভাবির জন্য কিছু বই কিনেছিলাম আর ভেবেছিলাম ভাবির জন্মদিনে ভাবিকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। আর ভাবিকে ভাবির পছন্দের একগুচ্ছ গোলাপ ফুল কিনে দেব। আর সন্ধ্যায় একটা কেক নিয়ে এসে সবাই মিলে খাব।
- আর কিছু?
= আপাতত না।
- ব্যাস এটুকুই। তাই এত অস্থির হচ্ছিস... তুই আসলেই গাধা। তোর উচিত ঘাস খাওয়া।
= আমি গাধা হলে তুমি গাধার বড় ভাই। তুমি বড় গাধা। হেহেহে... :D
- প্রশ্নই আসে না। শুধু তুই গাধা এই বাসার মধ্যে।
= জি না।
- কোন ডাউট আছে নাকি? তুই মহা গাধা। নাহয় তুই এই প্ল্যান কিছুতেই করতি না, তুই কি ওই হাদিস টা ভুলে গেছিস? - রাসুল(সাঃ) বলেন,” যে ব্যাক্তি তার কাজে ও কর্মে অন্য জাতির অনুকরণ করবে, সে তাদেরই একজন বলে গণ্য হবে।“ আর এ হাদিসের কারনে জন্মদিন পালন নিষেধ করা হয়। জন্মদিন পালন তো অন্য সংস্কৃতি থেকে এসেছে। এটা মুসলিমদের পালন করতে বলেন নাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ)।
= তাহলে বল না ভাইয়া এখন কি করব?
- আরে বোকা মেয়ে, জন্মদিনেই যে উপহার দিতে হবে এমন কোন কথা নেই। তুই বইগুলো জন্মদিনের আগে অথবা পরে যেকোনো সময় দিতে পারিস। আর ঘুরতে যাওয়া, ফুল কিনে দেয়া সেটাতো যেকোনো দিনই যাওয়া যায়। আর কেকও পরে অথবা আগে আনলেই হবে। তবে জন্মদিনকে উপলক্ষ করে করা যাবে না, এমন নিয়তও করা যাবে না যে তুই জন্মদিন উপলক্ষে এসব করছিস।
= ওরে কত সহজে তুমি সমাধান দিয়ে দিলে। তুমি আসলেই আমার সুপার হিরো। আই লাভ ইউ ভাইয়া।
- আর ন্যাকামো করতে হবে না। চল মা খেতে ডাকছে।
হাসি মুখে মুনমুনি খাওয়ার টেবিলের দিকে গেল। তার সব সমস্যার সমাধান হয়েছে। ২৭ আগস্টে ভাবির জন্মদিনেই সব করতে হবে এমন কোন কথা নেই। আগে বা পরে একসময় করলেই হল। শুধু মাত্র একটি দিনকে কেন্দ্র করেই আনন্দ করতে হবে এমন কোন নিয়ম নাই, প্রতিটি দিনকে আনন্দের করা যায়। স্পেশাল করা যায় সব দিন। আর মুসলিমদের জন্য তো আল্লাহর পক্ষ থেকে দিন নির্ধারণ করাই আছে যে কোন দিন আমরা উদযাপন করব... এসব যখন ভাবছিল মুনমুনি তখন ওর এই হাদিস টা মনে পড়ল, হজরত আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনা এসে জানতে পারলেন, মদিনা বাসির দুটো উৎসবের দিন আছে। সেই দুই দিন তারা আমোদ-ফুর্তি, খেলাধুলা প্রভৃতি করত। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন : এই দিন দুটো কিসের জন্য? তারা বলল : এই দুই দিন আমরা অন্ধকার যুগে (আইয়ামে জাহিলিয়্যাতে) নানা রকম ক্রীড়া-কৌতুকের মধ্য দিয়ে কাটাতাম। এ কথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: আল্লাহ এ দু'টি দিনের পরিবর্তে অন্য দু'টি দিন তোমাদের উৎসব করার জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তার একটি হল 'ঈদুল ফিতর', অন্যটি ঈদুল আযহা। তোমরা পবিত্রতার সাথে এ দু'টি উৎসব পালন করবে।" [আবু দাউদ ও নাসায়ী]।
২৫ তারিখ রাতে মুনমুনি তার ভাবির জন্য কেনা বইগুলো উপহার দিয়ে দিল। আর ভাবিকে একরকম হুমকি দিয়েই রাজি করাল যে তারা পরদিন বিকেলে ঘুরতে যাচ্ছে। রাইসা এত কিছুর কারণ খুঁজে পাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করায় মুনমুনি বলল যে, সে প্ল্যান করেছিল এবারের মত সে ভাবির জন্মদিন পালন করবে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিল না। এতে আল্লাহ্ অসন্তুষ্ট হতেন। রাইসা ততক্ষনে বুঝে গেছেন সেইদিন তাহলে মা এইজন্যই রাজি হচ্ছিলেন না। হঠাৎ উপহার পেয়ে রাইসা বেশ খুশিই হল। একটু পর লুকিয়ে রাখা কিছু একটা বের করতে লাগল মুনমুনি। সেটা দেখে মাহমুদ (মুনমুনির ভাই) আর রাইসা অবাক হল। তারা একসাথে বলে উঠল, এটা আবার কি? তখন এক গাল হেসে মুনমুনি বলল, এটা তোমাদের দুইজনের জন্য। জানো মিষ্টি ভাবি, ভাইয়া দেশের ৩৫ টা জেলা ঘুরেছে, বান্দরবানেও গিয়েছে, কিন্তু নীলগিরিতে যায়নি কখনো। এর কারণ সেখানে তার বউএর সাথে যাবে বলে ঠিক করে রেখেছে। এখন তো তুমি এসেছ। তাই এখন ভাইয়া আর তুমি মিলে যাবে।
মাহমুদ অবাক হয়ে বলল, তুই এটা ম্যানেজ করলি কিভাবে? তখন মুনমুনি বলল, আমি আব্বুকে বলে রেখেছিলাম। আব্বুর বন্ধু আশরাফ আঙ্কেল কয়দিন আগে একটা কাজে বান্দরবান গেলে আব্বু তাকে দিয়ে নীলগিরি রিসোর্ট বুকিং করিয়েছিলেন। আর বুকিং এর ডকুমেন্ট আমাকে দিয়েছেন। রাইসা কিছু বলতে যাবে আর তখনই মুনমুনির মা এসে ওদের ডেকে নিয়ে গেলেন ইসলামিক আলোচনার জন্য।
ঘুমোতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন মুনমুনিদের বাসায় ইসলামিক আলোচনা করা হয়। একেকদিন একেকজন আলোচনা করে থাকে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। পরেরদিন কি আলোচনা করা হবে তা আগেরদিন ঠিক করে দেয়া হয়।
তখনও মুনমুনির বাবা আসেন নাই আলোচনার জন্য। এই ফাঁকে মাহমুদ তার মায়ের কাছে মুনমুনির কাণ্ড বলছে। তাদের মাও উত্তরে বলছেন, তোকে তো মনে হয় পাগলীটা একটা কথা বলে নাই যে সে এবার ঈদে জামা না নিয়ে টাকাটা বাবার হাতে দিয়ে বলেছে নীলগিরি রিসোর্ট বুকিং এর জন্য এর সাথে আরও কিছু টাকা যোগ করে যেন। তোদের বাবা নিষেধ করলেও পাকনা বুড়ি কথা শোনে নাই, সে একটু হলেও কন্ট্রিবিউট করবেই এই জেদ করছিল। পরে তোর বাবা বাধ্য হয়ে টাকাটা নিয়েছে। সব কিছু শুনে মাহমুদ অবাক না হয়ে পারল না। আনন্দে রাইসার চোখ ছল ছল করে উঠল। তখন মাহমুদ মুনমুনিকে বলল, তুই এত ভাল কেন পাঁজি মেয়ে। মুনমুনি হেসে বলল, তোমরা ভাল মানুষ বলেই আমাকে ভাল বল।
.................... ...................
এমনি করে হাজারো মুনমুনি আর রাইসারা প্রতিদিন অসংখ্য পারিবারিক বন্ধনের গল্প রচনা করে যাচ্ছে। যা কোনদিন প্রকাশিত হবে না। ধর্মীয় অনুশাসন, পারিবারিক মূল্যবোধ, মা-বাবার আদর সোহাগ আর ভাইবোনের মায়ায় জড়ানো খুনসুটি সব মিলিয়ে তাদের ভালবাসার গল্প। পৃথিবীতে মানব জাতির আবির্ভাবের পর থেকে অসংখ্য অলিখিত পারিবারিক বন্ধনের গল্প রচিত হয়েছে যার কোন ইয়ত্তা নেই। আগের সেই মানুষগুলো আর নেই, একদিন আমরাও থাকব না কিন্তু এই মিষ্টি মধুর ভালবাসাগুলো শেষদিন পর্যন্ত রয়ে যাবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই ভালবাসা হস্তান্তরিত হতে থাকবে। পরিবার থেকে পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে এই একই গল্প। শুধু গল্পের চরিত্র আর প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটে কিন্তু গল্পের মূল কাহিনী একই থাকে। অটুট থাক এই মায়ার বাঁধন। মৃত্যুর পর জান্নাতেও ছড়িয়ে পড়ুক এই ভালবাসার সুবাস।
[বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ এই গল্পে যে ধর্মীয় অনুশাসন বা জন্মদিন পালন না করার কথা বলা হয়েছে এটা অনেকের ভাল নাও লাগতে পারে। তাদেরকে বলছি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে এমন হাজারো পরিবার আছে। আর এটা তেমনি একটা পরিবারের গল্প। তাদের বিশ্বাসকে ছোট করবেন না দয়া করে, আপনি ধর্মীয় বিধান মানতে নাই পারেন তাই বলে আপনাকে কেউ অধিকার দেয় নাই অন্যের বিশ্বাসকে হেয় করার]
উৎসর্গ - রাইসা ভাবি।
বিষয়: বিবিধ
২২৩১ বার পঠিত, ৫৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাকককক .... আগে ফার্স্টু হই....... অনেক দিন এভাবে প্রথম হতে পারতিছি না ...... পড়ে আবার মন্তব্য করবো ......কেমন?
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ অংশটা এক্কেবারে আমারই কথা। যথার্থই বলেছেন আপনি। যাজাকিল্লাহু খাইর
..............জায়গার কথাটা লিখেদাও তো কি বলতে চাচ্ছো....
মুনমুনি আমাকে খুন কর্পে তোমাকে বল্লে
তোমাকে কে খুন কর্পে
তারাতারি বলো বলছি....
এখন কি ভুলে গেছো....
আচ্ছা...... মাছের রহস্য কি ঠিক বুঝলুম না
একটা মাছের পিস লুকোচুরির জন্য আর একটা তুমি চাইলে নিতে পারো....তবে ছোটা নিও...ছোচা হারিকেন।
ওয়াক থু...খাও।
আপনার কেমন লাগে দেখেন তো
মন্তব্য করতে লগইন করুন