‘অমূল্য স্বাধীনতা এবং যেখানে আমরা’
লিখেছেন লিখেছেন আমি মুসাফির ২২ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৪:২৯:০২ বিকাল
সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকারনাইন ভায়ের লেখাটি আমার দেশে প্রকাশিত পড়ার জন্য অনুরোধ রইল ।
পাঁচ বছর চার মাস ধরে শুধু ভেবেছি কথাগুলোর অর্থ কী? ২০০৭ সালের ৪ অক্টোবর। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। অফিসে যাওয়ার ঠিক এক ঘণ্টা ৩০ মিনিটের মাথায় ‘সিজা নাজিমুদ্দীন’ বসধরষ-এর মাধ্যমে Demonstration-এর ছবিটি পাঠায়। Poster-এ লেখা কথাগুলো এ রকম : Imprison me & call it ‘Security Measure’. Ges Rob my resources, invade my land, alter my leadership & call it ‘Democracy’. সেদিন খুব না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি সেই লেখার অর্থ।
ভয়ে আতঙ্কে তটস্থ আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে শুধু ভাবি, ’৫২ সালে যারা শহীদ হয়েছিলেন ভাষার স্বাধীনতার জন্য, ’৬৬ সালের ৬ দফা আর ’৬৯ সালের ১১ দফা যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার জন্য, সর্বোপরি ’৭১ সালের যুদ্ধ যে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য, তার অবস্থা আজ কোন পর্যায়ে। ক্ষত-বিক্ষত সমাজ আর বিপর্যস্ত দেশ নিয়ে আর কত দশক পার করতে হবে জানি না। তবে ভয় ও আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে।
ইতিহাসের অন্যতম রাষ্ট্রচিন্তক ইবনে খালদুন তেরো শতকে বলে গেছেন, রাষ্ট্রের উত্পত্তি হয় সামাজিক সংহতিতে আবার ধ্বংসও হয় সংহতির অভাবে। ঐক্যবদ্ধ জনগোষ্ঠীর অভাবে রাষ্ট্র দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে পারেনি বলে আজ ধীকৃত, লজ্জিত জাতি হিসেবে আমরা বেঁচে আছি। স্বাধীনতা হয়েছে বিপন্ন। পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের মাতৃভাষার ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে, আমাদের ব্যাপারে মর্যাদাহানিকর ভাষায় মন্তব্য করেছে, পাঁচ টাকা ১০ টাকা বৈষম্য সৃষ্টি করেছে দ্রব্যমূল্যে, শিক্ষা ক্ষেত্রে অনগ্রসর করে রাখার চেষ্টা করেছে, বিজয়ের পরও ’৭০ সালে ক্ষমতায় বসতে দেয়নি।
কিন্তু স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার পরের অবস্থা এমন হলো কেন। এটা একটি কার্যকর স্বাধীনতা না হয়ে আক্ষরিক স্বাধীনতায় পর্যবসিত হয়েছে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুদ্ধরত অবস্থায় মানুষ যখন অসহায়-নিরুপায় ছিল, তখন ভারত শরণার্থী ক্যাম্প করে অনেক মানবিক সাহায্য দিয়েছে। আমরা সত্যিই ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। মানবিক সাহায্যের বিনিময় নেই এটুকু জেনেও ভারতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতা একটি অনন্য উদাহরণ। অথচ হতবিহ্বল হয়ে যাই যখন আমাদের প্রবাসী সরকারের বাংলাদেশকে স্বীকৃতির আবেদনটি দ্বিতীয় বারও ভারত সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়। মহাকালের গর্ভে মিলিয়নস দিন বিলীন হয়েছে, কিন্তু আমার স্বাধীনতা নিয়ে যারাই ছিনিমিনি খেলার বা যখনই ছিনিমিনি খেলার চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকটি এবং প্রতিটি বিদ্ধ হয়েছে আমার মননে, মগজে, চিন্তায়।
ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা ’৭১ সালের ২৪ এপ্রিল, ১৫ অক্টোবর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দরখাস্ত ফিরিয়ে দেয় স্বীকৃতি না দিয়ে। কিন্তু তৃতীয় বার রাষ্ট্রীয় নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা রাখার অঙ্গীকার করলে ২৩ নভেম্বর স্বীকৃতি দেয়। সেই থেকে আমাদের ওপর আধিপত্ত বিস্তার, আমলা-রাজনীতিবিদদের চোখরাঙানি, পানি আগ্রাসন, Border Killing অর্থনৈতিক চাপ ভারতসহ বিদেশিরা অব্যাহত রেখেছে।
আসলেই কি আমরা বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রতটবর্তী বলে চণ্ডাল জাতি? যেটি ১৯০৭ সালে রজনীকান্ত চক্রবর্তী ‘গৌড়ের ইতিহাস’ বইতে লিখেছিলেন। কোথায় আমাদের স্বকীয়তা? বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে। ফারাক্কা, তিস্তা ও বরাক নদীতে বাঁধ এবং আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে উজানে পানি প্রত্যাহার করায় বাংলাদেশের ১৭টি নদীর মৃত্যু ঘটেছে। শুকিয়ে গেছে ৮০টি নদী। ব্রহ্মপুত্রের পানি ১০ থেকে ২০ ভাগ সরিয়ে নিলে বাংলাদেশের ১০০টিরও বেশি নদী শুকিয়ে যাবে।
কিন্তু ভারতীয় পরিকল্পনা হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র থেকে ৪০ ভাগ পানি সরানো হবে। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে মাত্র ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলক গঙ্গা ব্যারাজের ফিডার ক্যানেল চালু হলেও আজ অবধি বন্ধ হয়নি। খ্যাতনামা পানি বিশেষজ্ঞ বিএম আব্বাস লিখেছেন, মনু, মহুরি, খোয়াই, গুমতি ও ধরলা দুধকুমার নদীতেও বাঁধ দিয়ে ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করছে। তাতে শুষ্ক মৌসুমেও বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তির শর্তানুসারে বাংলাদেশী ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় যাতায়াতের সুবিধার্থে তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশকে হস্তান্তর করা হবে এবং তার পরিবর্তে বাংলাদেশ সরকার এক বর্গমাইল এলাকার বেরুবাড়ী মৌজা ভারতকে হস্তান্তর করবে। চুক্তি স্বাক্ষরের তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশ সংসদে বিল পাস করিয়ে বেরুবাড়ী দিয়ে দেয়, কিন্তু ভারত আজ অবধি হস্তান্তর করেনি তিনবিঘা করিডোর। এখন ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে ছিটমহলবাসী নির্দিষ্ট সময়ের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধা পাচ্ছে, কিন্তু ৮৫ মিটার প্রস্থ ও ১৭৮ মিটার করিডোরের পরিবর্তে ৯ ফুটের একটি সরু রাস্তা দিয়ে। যে সংবিধান সংশোধন না করে ভারত বাংলাদেশকে এখনও তিন বিঘা জমি দিতে পারছে না, ঠিক তার উল্টোটা দেখি আমাদের দেশে ভারতীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সাহারার ক্ষেত্রে। সংবিধান অনুযায়ী দেশের নাগরিক, সমবায় প্রতিষ্ঠান ও সরকার ছাড়া কেউ এক ইঞ্চি জমির মালিকানা পেতে পারে না।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কোন জায়গার মালিক কে হবে, তা নিয়েও বিদেশিদের চক্রান্ত। লন্ডনভিত্তিক প্রভাবশালী সাময়িকী ইংরেজিতে লিখেছিল দিল্লির কাছে, যাতে শেখ হাসিনাকে নিবৃত্ত করতে যেন বাংলাদেশ সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা পায়। ভারত বাংলাদেশকে কতখানি নিয়ন্ত্রণ করে তার নমুনা এখানে সুস্পষ্ট। ভারতের প্রচারমাধ্যমে আমাদের রাষ্ট্রপতিকে রাজ্যপাল এবং প্রধানমন্ত্রীকে মুখ্যমন্ত্রী সম্বোধন করা হয়। টিপাইমুখ নিয়ে আমাদের বুদ্ধিজীবী বিশেষজ্ঞদের তত্কালীন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করেছেন। ২০১১ সালের ১৬ জুলাই ভারতীয় জনতা পার্টির সুব্রাহ্মনিয়াম স্বামী মুম্বাইয়ের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় তিনি বলেছেন, সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত ভারতের দিকের অংশটি দখল করে নিতে হবে। এ ধরনের কোনো কিছুর প্রতিবাদ সরকারিভাবে আমরা দেখি না। তবে সাহারা গ্রুপকে বাংলাদেশের জমি দেয়ার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ বলেছেন, ভারতই দক্ষিণ এশিয়ার বড় বাধা।
ভারত সবচেয়ে বড় আগ্রাসী পুঁজি, সবচেয়ে গরিব মানুষের দেশ, উগ্র সাম্প্রদায়িক দেশ ও নাগরিক অত্যাচারের জাতি। আর বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ভারত এ ধরনের সাহস কখনোই করত না। অনেক বিষয়ে তিনি ভারতের বিপরীতে সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি ছিলেন স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী। যেমন পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দূত পাঠানো, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, ’৭৪ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ও আইসি সম্মেলনে যোগদান প্রভৃতি।
Click this link
বিষয়: বিবিধ
১০৩৯ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন