কে? (ছোটগল্প)
লিখেছেন লিখেছেন তরিকুল হাসান ১১ মে, ২০১৫, ০৬:১১:৫০ সন্ধ্যা
আমি আগে কখনো এদিকে আসিনি, তবে নোমান এসেছিল। রাস্তায় লোক চলাচল নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে দুয়েকটা সাইকেল ছাড়া আর তেমন কোন যান চলাচল নেই। বাড়ী গুলো বেশ দুরে দুরে। মানুষগুলোও সহজ সরল। মাটির তৈরি ঘরের একপাশে বসত ঘর আর রাস্তার দিকে গ্রাম্য মনিহারি দোকান। আজিজ বিড়ি, কাবলী বুট আর পানের সাথে সাথে চাল-ডালও পাওয়া যায় কোন কোন দোকানে। আমি আর নোমান বসলাম একটাতে। দোকানীর গায়ে একটা সাদা গোলগলা গেঞ্জি আর একটা ময়লা লুংগী। ঘাড়ে একপাশে একটা গামছা। হাতে তালপাতার পাখা। মুখের কাচা দাড়ির কয়েকটাতে পাক ধরেছে। হাসি আর কথা বলার ঢং এ অকৃত্রিম আন্তরিকতার সুর।
দোকানদার বলল,
'এই দুফুর বেলা, কই যাইতাছুইন।'
'গাইবি মসসিদ।'
'অ, ঘুরবার আইছুইন।'
আমরা কিছু কাবলী বুট কিনলাম। কাবলী বুট খেতে কেমন কটর কটর করে শব্দ হয়। এরপর দাত দিয়ে একটু পিশে নেওয়ার পর মনে হয় ,এখনি না গিলে ফেলে আর কিছুক্ষন রাখি। টিনের গ্লাসে পানি এনে দিল দোকানদারের ছেলে। এই মাত্র টিউবওয়েল চাপা ঠান্ডা পানি। এই তপ্ত রোদের মাঝে গাছের ছায়ায় মাদুর বিছিয়ে শুয়ে থাকতে পারলে ভাল লাগত, কিন্তু আমাদের তাড়া আছে। দ্রুত না চললে ফিরতে গভীর রাত হয়ে যাবে। এই বিজন পথে গভীর রাতে ফেরা? খাইছে আমারে।
এখানকার মাটির রং লাল। এই মাটি শুকনো অবস্থায় প্রচন্ড শক্ত। আবার একটু বৃষ্টিতে পানির ছোয়া পেলে বেশ আঠালো হয়ে যায়। একবার জুতায় লাগলে ছাড়ানো মুশকিল। আমরা বলি মায়াবী লাল মাটির এই দেশ। পথের ধারে মাঝে মাঝে কাঠাল কিংবা বাশ গাছের সারি। আমরা ধীরলয়ে চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে চলতে থাকলাম। পথে একটা নদী পড়ল। নদীটির স্রোত খুব বেশি। এখানে এককালে একটা সেতু ছিল। কথিত আছে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় এ রাস্তা দিয়ে গোপনে মিত্র বাহিনীর সৈন্য চলাচল করত। এরপর কালের বিবর্তনে সেতুটি ভেংগে পড়ে। এখন কয়েকটি পিলার ছাড়া আর কিছু নেই। পুরনো পিলারগুলোতে বুনো আগাছায় ঘিরে রেখেছে। মাঝি নৌকায় নদী পার করে দিল। নদীর পাড়ে মাঝিই ছোট্ট দোকান বসিয়েছে। সেখান থেকে চিড়া আর খেজুরের গুড় কিনে খেয়ে নিলাম। এখানে গুড়ের চা পাওয়া যায়। একগ্লাস গুড়ের চা ও খেয়ে নিলাম। বেলা গড়াতে শুরু করেছে, আমরাও এগিয়ে চললাম। বাশ-কাঠালের ঝোপ পেরিয়ে গজারী বন শুরু হল। লম্বা লম্বা গাছের সবুজ পাতার ফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসছে পড়ন্ত বিকেলের আলো। আনমনে গেয়ে চলেছে বউ কথা কও পাখি। একটা কাঠ বিড়ালি গাছের আড়াল থেকে মাঝে মাঝে উকি দিচ্ছে। একটা কাঠাল চাপা ফুলের গাছ দেখলাম। মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে চারপাশটায়। বুকের গভীরে কোথায় যেন ঝিম ঝিম করে ওঠে। বনের ফাকে ফাকে মাটি কেটে জমি নিচু করে ফসলী জমি বানানো হয়েছে। এ জমিতে এক মৌসুমে ধান ফলানো হয় আরেক মৌসুম ফাকা পড়ে থাকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার হয় তখন। কাবাডি,ডাংগুলি, গোল্লাছুটের পাশাপাশি এখন ক্রিকেটও খেলা হয়। তালগাছের ডাল দিয়ে ব্যাট বানিয়ে কিংবা জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল বানিয়ে হৈ হৈ করে তারা নেমে পড়ে।
গায়েবী মসজিদে যখন পৌছলাম তখন সবে সন্ধা নেমেছে। জরাজীর্ন একটা মসজিদ। এই নিবিড় বনের মাঝে কাঠ কাটতে গিয়ে গ্রামবাসীরা একদিন এ মসজিদ খুজে পায়। তাদের বিশ্বাস বহু আগে জীনেরা এ মসজিদ বানিয়েছিল। লাল ইটে বানানো মসজিদের চারপাশে ঝোপঝাড়ে ভর্তি হয়ে আছে। ভাংগা ইটের ফাক থেকে মাঝে মাঝে বের হয় বিষাক্ত গোখরা সাপ। মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়ে দেখি, শুধু ঈমাম সাহেব আর পাড়ার এক বয়স্ক লোক এসেছেন নামাজ পড়তে। নামাজ শেষে ঈমাম সাহেব চলে গেলেন। বয়স্ক লোকটা বলল, আসো কবর জিয়ারত করে যাই।
মসজিদের পাশে বাধানো কয়েকটা পাকা কবরের সারি। জায়গাটা একদমই ছিমছাম আর নীরব। এক সারিতে লম্বা কয়েকটা কবরের পাশে ছোট্ট একটা কবর। কার কবর? কেউ জানে কিনা বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি মুচকী হাসলেন। আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে গুনগুনিয়ে আবৃত্তি করলেন ,
"হুওয়াল্লা হুল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা হুওয়া ‘আলিমুল্ গাইবি আশ্শাহা-দাতি . .
. . তিনিই আল্লাহ, যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই; দৃশ্য- অদৃশ্যের জ্ঞাতা; তিনিই পরম করুণাময়, দয়ালু।
. . তিনিই আল্লাহ; যিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই, তিনিই বাদশাহ, মহাপবিত্র, ত্রুটিমুক্ত, নিরাপত্তাদানকারী, রক্ষক, মহাপরাক্রমশালী, মহাপ্রতাপশালী, অতীব মহিমান্বিত, তারা যা শরীক করে তা হতে পবিত্র মহান।
. . তিনিই আল্লাহ, স্রষ্টা, উদ্ভাবনকর্তা, আকৃতিদানকারী; তাঁর রয়েছে সুন্দর নামসমূহ; আসমান ও যমীনে যা আছে সবই তার মহিমা ঘোষণা করে। তিনি মহাপরাক্রমশারী, প্রজ্ঞাময়।"
বিষয়: বিবিধ
১১৪৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন