মন রাঙাতে এলো বইমেলা

লিখেছেন লিখেছেন সুহৃদ আকবর ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৮:৪৯:১৮ রাত

আবার এলো বইমেলা। মন রাঙাতে এলো বইমেলা। পাঠকদের ঘুম ভাঙাতে এলো বইমেলা। শুরু হলো আমাদের ঐতিহ্যের মেলা। বইমেলা আমাদের আমাদের আবেগের, আমাদের উচ্ছ্বাসের, অমাদের প্রাণের, আমাদের পুলকের, আমাদের ভালবাসার, আমাদের যত্নের। বইমেলার সাথে আমাদের হাজার বছরের সাহিত্য, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের নির্যাস মিশে আছে। বইমেলার প্রতিটি অক্ষরের সাথে আমাদের একুশের শহীদদের রক্ত মিশে আছে। বইমেলার বইয়ের মলাটের সাথে শহীদ সালাম, রফিক, জব্বার,শফিউরের বুলেটবিদ্ধ জামার স্মৃতি চিহ্ন লেগে আছে। আর সেই ভাষা শহীদদের স্মৃতি বিজড়িত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বইমেলা। আমাদের দেশের কতিপয় লেখক-প্রকাশকের যুগ যুগান্তরের চেষ্টা সাধনার ফল আজকের এই বইমেলা। সেই মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহার স্মৃতি বিজড়িত বইমেলা। একুশের অম্লান স্মৃতি স্মারক আমাদের বইমেলা। বইমেলা আমাদের জাতি সত্তার এত বেশি অংশ জুড়ে দখল করে আছে যে একে অস্বীকার করার কোনোই সুযোগ নেই। বর্তমানে বইমেলা আমাদের চেতনার জানালায় পরিণত হয়েছে।

একুশের বইমেলা নিতান্তই বইমেলা নয়। এটি একাধারে লেখক-পাঠক আর দর্শকদের মিলনমেলা। এ মেলায় মেধা আর মননের অপরূপ এক সম্মিলন ঘটে। দেশের বইপ্রেমী রুচিশীল, সুপন্ডিত, স্ব-শিক্ষিত, পরিমার্জিত, উচ্চমাপের ভদ্র পরিবার সর্বোপরি সকল সৃষ্টিশীল মানুষের প্রাণের সমাবেশ এটি। বইপ্রেমী মানুষ সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন কখন বইমেলা শুরু হবে তার জন্য। ভক্ত পাঠককুল বুকভরা আবেগ আর প্রাণভরা উচ্ছ্বাস নিয়ে ছুটে আসেন এ বইমেলা প্রাঙ্গণে। বইয়ের ঘ্রাণে বইপ্রেমীরা আমোদিত হয়। তারা ছুটে যায় বইয়ের বাগানে। কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, স্বামী-স্ত্রী, নব দম্পতিরা এ থেকে বাদ পড়ে না। বইপ্রেমী মানুষ বুকভরা আশা প্রাণভরা চাওয়া চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে এ বইমেলায় হাজির হয়। তারা বইমেলায় এসে নতুন বই নেড়ে ছেড়ে দেখে, নাক দিয়ে বইয়ের গন্ধ শুকে, চোখ ভরে অনিন্দ্য সুন্দর কারুকার্যময়ী বইয়ের প্রচ্চদ দেখে তাদের মন-ভরিয়ে তোলে। বইয়ের সৌন্দর্যে পাগলপারা হয় তাদের মন। তাই তো বন্যার পানির মতো এতো মানুষ দলেবেঁধে বইমেলায় আসে। তারা প্রিয় লেখকের বই কেনে। প্রিয় মানুষের জন্য বই কেনে। বইয়ের পৃষ্ঠায় লেখকের অটোগ্রাফ নেন। লেখকের সাথে ছবি তোলে। এ যেন ভিন্ন এক অনুভূতি অপরূপ প্রাণে পুলক লাগানে অপরূপ এক পরিবেশ।

বইমেলার সময় পুরো বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণ জুড়ে কেবলই প্রাণের ছড়াছড়ি থাকে। কন্ঠে বাজে উঠে উচ্ছ্বাসের সুর। হৃদয়ে খুশির ঢেউ খেলে যায় মনে। বইমেলা বইপ্রেমী মানুষের আবেগ অনুভূতি আর শিহরণের মাত্রাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। বইমেলার মূল মঞ্চ থেকে শুরু করে লেখক কুঞ্জ, মিডিয়া কর্ণার, নজরুল মঞ্চ সর্বত্রই কেবল বইপ্রেমী মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়। নজরুল ইন্সস্টিটিউট এর স্টলে নজরুল প্রেমী, নজরুল সাহিত্যামোদী পাঠকদের অগণিত ভিড় লক্ষ্য করা যায়।

এ বছর ২৬টি প্রকাশনা সংস্থা ছাড়াও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৮টি সরকারি প্রতিষ্ঠান, দুটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও একটি পত্রিকার স্টল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বর্ধমান হাউজের পাশের বহেড়া তলায় ৪৮টি ছোট কাগজের ‘লিটল ম্যাগ কর্ণার’ স্টল বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে।

মেলার সম্প্রসারকৃত ভেন্যু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে চার ইউনিটের ১১টি, তিন ইউনিটের ৪১টি নতুন, দুই ইউনিটের ৮৩টি এব এক ইউনিটের ৯৫টি স্টল। সব মিলিয়ে এবার ২২৭টি প্রতিষ্ঠান মেলায় অংশ নিয়েছে। মেলাটি সদ্য প্রয়াত বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে উৎসর্গ করা হয়েছে। যিনি সারা জীবন একটা আদর্শের জন্য লড়ে গেছেন। তাই সরকার এ গুণীজনকে যথার্থ সম্মান দিয়েছে বলে আমি মনে করি।

১ ফেব্রুয়ারী এ মেলার উদ্বোধন করেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পর সর্ব সাধারণের জন্য এ মেলার দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। মাসব্যাপী প্রতিদিন এ মেলা বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলছে। মেলায় কোনো প্রবেশ মূল্য ধরা হয়নি।

মেলায় স্টল বরাদ্ধ পেতে একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে এক বছরে অন্যূন ২৫টি নতুন বই প্রকাশ করতে হয়। যদিও বোদ্ধা মহলসহ অনেকেই এটিকে এক ধরণের ক্রটিপূর্ণ ব্যবস্থা বলে মনে করেন। তাদের মতে সংখ্যা নয় মান সম্পন্ন বইকেই গুরুত্ব দেয়া উচিত।

মেলায় বই প্রকাশের সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালার প্রয়োজন পড়ে না। মেলাকে একটি সুনির্দিষ্ট সুশৃঙ্খলিত পরিমার্জিত রূপ দেবার জন্য বইমেলায় বই প্রকাশের ক্ষেত্রে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। তবে তা যেন লেখক বান্ধব নীতিমালা হয়। কেননা আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে লেখকরাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, অধিকার বঞ্ছিত। তাদের ভাগ্যে শুধু বাহবাই জুটে পেটে ভাত জুটার জন্য অর্থ জুটে ক’জন লেখকেরই ভাগ্যে। তাই লেখকদেরকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা করার করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটা সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা প্রয়োজন; যাতে লেখকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে।

একুশের বইমেলায় প্রতি বছর হাজার হাজার নতুন বই বের হয়। হিসেব করলে মান সম্মত বইয়ের সংখ্যা খুব একটা বেশি দেখা যায় না। লেখকরা জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বটে; তবে একটা কথা স্বরণে রাখতে হবে যে, দূরদর্শী, নৈতিক, প্রাজ্ঞ, মননশীল এবং প্রকৃত গভীর চেতনার লেখক খুব কমই আছে। তারাই আসল লেখক যারা জাতিকে পথ প্রদর্শন মূলক লেখা উপহার দিতে পারেন। এমন জাত-স্বভাবী লেখকরাই জাতির চেহারা পাল্টাতে পারেন। লেখক হওয়া কোনো চাট্টিখানি কথা নয়; যারা লেখক হওয়াকে ফ্যাশনের ব্যাপার বলে মনে করেন, তারা প্রকৃত লেখক নন। মনে, মননে, অস্থি, মজ্জার, রক্তে, মাংশে, প্রতি ফোট রক্ত কণিকায় লেখক সত্ত¡া খেলা করে তারাই আসল লেখক। প্রকৃত লেখকের ধ্যান-জ্ঞান হচ্ছে কেবলই লেখালেখি করা। মানুষকে নিয়ে ভাবা। সমাজকে নিয়ে চিন্তা করা। পথহারা জাতিকে সঠিক পথের দিশা দেবার কথা তাদের সার্বক্ষনিক চিন্তা হয়। তারা যখন যেখানে যে অবস্থায় থাকেন প্রতি মুহূর্তে লেখালেখির চিন্তায়ই নিমগ্ন থাকেন তিনি। সমাজের অন্যায় অনাচার জাতির বিকাশ ও উন্নয়ণের জন্য তারা লেখেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নগদ প্রাপ্তি তাদের প্রত্যাশা থাকে না। কিছু ফেলেও তারা লেখেন না ফেলেও তারা লেখেন। লেখকেরা কোনো বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন সরকার দলীয় লোকের রক্ত চক্ষুকে ভয় পায় না। কোনো হুমকি-দমকিকে তারা পরোয়া করে না।

বাংলাদেশী জাতির ইতিহাস, সভ্যতা, সংস্কৃতি, জ্ঞানবত্তা, বিজ্ঞান ও সাহিত্য চেতনা যে কত বেশি প্রখর একুশে ফেব্রুয়ারী এলে তা আমাদের চোখে পড়ে। একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে তা দেশ থেকে দেশান্তরে মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশের তথ্য মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশেষ ভূমিকা পালক করতে হবে।

পরিশেষে, বইমেলাকে ঘিরে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি আবর্তিত হোক। বইয়ের সাথে কাটুক আমাদের সকাল-বিকাল, উদাস দুপুর, গোধূলির বিকেল, জোছনা রাত। বই পাঠে বর্ষার বৃষ্টির জলে স্নানের মত অমাদের মন থেকে সকল পাপ পঙ্কিলতা মুছে যাক। সকালের সোনারোদের মত আমাদের হৃদয়ে খেলা করুক সত্যের শিখা। বই পড়ার আনন্দে আমাদের মন নেচে উঠুক। ভরে উঠুক আমাদের হৃদয়ের উঠোন। আসুন, বই পাঠ করে পলাশ, অশোকের মত রাঙিয়ে তুলি আমাদের জীবন। তাইতো মন রাঙাতে আবারও এলো বইমেলা।

বিষয়: বিবিধ

১০৩২ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

175714
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ রাত ১২:১৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার পোষ্টটির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
এই বইমেরা কিন্তু আমাদের প্রকাশনা জগতের একটি ক্ষতিও করছে যে সৃজনশিল প্রকাশনা কে এখন একটি নির্দিষ্ট সময়ে বেধে ফেলা হয়েছে্। যার ফলে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বই মেলার পরিসর আরো বৃদ্ধি করাও প্রয়োজন এবং প্রকাশক ব্যতিত অন্যান্য সংগঠনকে ষ্টল দেয়া বন্ধ করা প্রয়োজন।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File