বাগী ও শাহবাগীদের পরাজয় : ফিরে দেখা অতীত
লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ০৯ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:০২:২৬ দুপুর
পূর্ব প্রকাশের পর-
ক্রুসেড যুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা বাগী'দের পরাজয়ের আরেকটি ঐতিাসিক উদাহরণ পেতে পারি। ক্রুসেডাররা মুসলিমদের থেকে তাদের প্রথম কিবলা, পবিত্র ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাসকে দখল করে সেখানে এমন নির্বিচার গণহত্যা চালায় যে পুরো ফিলিস্তিন জুড়ে শুধু মুসলিমদের লাশ আর লাশের স্তুপ জমে যায়। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহ আকার নিয়েছিলো যে, নিরীহ আপামর জনতার জমাট বাঁধা রক্তের ক্রুসেডারদের ঘোড়াগুলোও চলতে পারছিলো না। ধর্ষণ, লুটপাটের তো কথাই নেই।
১১৬৯ খৃষ্টাব্দের এমনই এক সঙ্গীন মূহুর্তে ফিলিস্তিনের মজলুম মানবতাকে মুক্ত করার জন্য, স্বাধীনতা সংগ্রাম ঘোষণা করে দিগ্বিজয়ী মুসলিম সেনাপতি সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী রহ.। আগ্রাসী ক্রুসেডার ও বাগীদের বিরুদ্ধে তিনি আপোষহীন যুদ্ধের ঘোষণা দেন। শুরু হয় এক কঠিন সংগ্রাম। একদিকে সহায়-সম্বলহীন একজন সেনাপতি, অপরদিকে পুরো ইউরোপের ফিৎনাবাজ ক্রুসেডার বাগী ইহুদী ও খৃষ্টান। এমনকি মুসলিমদের মধ্যকার অনেকে সালাহ উদ্দীন আইয়ূবী’র সামনে খৃষ্টানদের চাইতেও বেশি বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে থাকেন। নাম সর্বস্ব মুসলিম আমীর-উমারা আর দুর্নীতিবাজ শাসকরা নিজেদের সামান্য স্বার্থেরহানী ঘটনার শংকায় প্রবল আপত্তিও বিরোধীতা শুরু করেন।
ঘরে বাইরের এমন হাজারো বিরোধীতার মাঝেও সালাহ্ উদ্দিন আইউবী রহ. নিজ অভিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তীঁর তীব্র গতিতে। শুরু হলো ক্রুসেডারদের সাথে যুদ্ধ। তুমুল যুদ্ধ। এই খবর যখন ক্রুসেডাররা শুনলো তখন তারা বিষয়টিকে খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করলো। কারণ তারা জানতো যে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব কে দিচ্ছে।
এদিকে মুসলমানদের মধ্যকার কিছু আলিম-উলামা ও নেতৃস্থানীয় লোকেরা আরম্ভ করলো দু:খজনক বিরোধীতা। তারা সালাহ উদ্দীনকে অতি উৎসাহী বলে তাঁর কঠোর সমালোচনা শুরু করলো। রোম সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকে তারা ‘পাগলামো’ বলে সালাহ উদ্দীন আইউবী রহ. কে তিরস্কার করতে লাগলো। তারা বলতে লাগলো যে, রোম এতো বড় এক বিশাল সম্রাজ্য, যাকে বলা যায় কূল-কিনারাহীন সমূদ্র। তারা রোম সম্রাজ্য ও ইউরোপকে এতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলো যে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা তারা চিন্তাই করতে পারছিলো না। তারা চিন্তা করছিলো যে, গোটা ইউরোপ তাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ, আর অন্য দিকে মুসলিমরা হলো শতধাবিভক্ত। অতএব এমন একটি বিভক্ত জাতি নিয়ে বিশাল সামরিক শক্তিধর ঐক্যবদ্ধ ইউরোপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাওয়ার অর্থ হলো মুসলমানদেরকে চরম বিপদের মধ্যে ফেলে দেয়া।
কিন্তু সালাহ উদ্দীন আইউবী রহ. একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা’র উপর তায়াক্কুল করে এগিয়ে চললেন। তিনি ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং তাদের থেকে মুসলমানদের ভূখন্ড পুনরুদ্ধার করার অভিযান আরম্ভ করেন। এই অবস্থা দেখে পোপ গোটা ইউরোপকে আর একটি নতুন ক্রুসেডের জন্য সংগঠিত করতে আরম্ভ করে, যেটা ৪র্থ ক্রুসেড এবং এটা ছিলো সর্ব বৃহৎ ক্রুসেড। কারণ এটি ছিলো সালাহ উদ্দীন আইউবী রহ. এর পুরো ইউরোপের সম্মিলিত যুদ্ধ ঘোষণা।
মুসলিমদের সামরিক নেতৃত্বে এবার সালাহ উদ্দীন রহ. কে দেখে এই যুদ্ধকে খৃষ্টানরা সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিলো এবং তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করলো। এই যুদ্ধে আগ্রাসী বাগী’রা কোনো জেনারেলদের উপর দায়িত্ব না দিয়ে স্বয়ং তাদের শাসক রাজা-বাদশারা নিজেরা যুদ্ধের ময়দানে এসে সরাসরি নেতৃত্ব দেয়া শুরু করেছিলো। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানির রাজা নিজেরা সালাহ উদ্দীন আইউবী রহ. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বেড়িয়ে পড়েছে এবং তারা নিজ নিজ সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছে। ইংল্যান্ড, জার্মানী ও ফ্রান্স যখন একই সাথে মুসলিমদের বিরুদ্ধে এতো সৈন্য প্রেরণ করে যে তখন তাদের সেনাবাহিনীর আকার এতো বিশাল হয়ে দাঁড়ায় যা তৎকালীন সময়ের প্রোপটে অস্বাভাবিক ধরণের এক বিশাল সেনাবাহিনী হিসেবে আবির্ভুত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায় শুধু জার্মান কিং ফ্রেডরিক বার্বারোজ একাই তিন লক্ষ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। তৎকালীন সময়ের প্রোপটে তিন লক্ষ সৈনের কোনো বাহিনীর কথা শুনলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে এমনিতেই যে কোনো মানুষ মূর্ছা যাওয়ার কথা। সম্মিলিত ইউরোপিয়ান বাহিনী এতো বিশাল আকার ধারণ করে যে, তাদের নৌ-বাহিনীর জাহাজ এবং ইউরোপিয়ান বাণিজ্যিক জাহাজগুলো দিয়েও তাদেরকে বহন করে আনা সম্ভব হচ্ছিলো না। তাই ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের সৈন্যরা নৌ-জাহাজে যাত্রা করলেও জার্মান বাহিনীকে স্থল পথে যাত্রা করতে হয়।
একদিকে ইউরোপের বিশাল বাহিনী মুসলিমদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য ধেয়ে আসছিল, আর অন্য দিকে মুসলিমদের মধ্যে চলছিলো ফতোয়াবাজি আর অনৈক্যের প্রচন্ড ঝড়। সবশেষে মুসলমানদের একদল বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পালিয়ে গেলো আর স্বল্প সংখ্যক হলেও একদল আল্লাহর পথে যুদ্ধের জন্য অটল অবিচলভাবে সামনে এগিয়ে গেলো। ঠিক যেমনিভাবে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বনী ইসরাইলদেরকে সমূদ্রের সামনে এনে পরীক্ষা করেছিলেন। এটা ছিলো মুমিনদের জন্য একটি পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা সব সময়ই মুমিনদেরকে এভাবে পরীা করে থাকেন। তিনি কোনো মুমিনের ধ্বংস চান না, তিনি শুধু পরীক্ষার মাধ্যমে সত্যিকার ঈমানদাদেরকে বাছাই করে মুনাফিকদের থেকে আলাদা করে নেন।
সালাহ্ উদ্দীন আইউবীর সময়ও এই একই ঘটনা ঘটলো। এটা ছিলো ঈমানের পরীা। পরীার মাধ্যমে ঈমানদার আর ঈমানের ভূয়া দাবীদারদেরকে আল্লাহ তা‘আলা যখন আলাদা করে নিলেন তখন আল্লাহ তা‘আলা নিজ কুদরতেই মুসলিমদেরকে বিজয় দান করলেন। ফ্রেডরিক বার্বারোজ যে তিন লক্ষ সৈন্য নিয়ে রওয়ানা দিয়েছিলো তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা কিভাবে শায়েস্তা করলেন, আসুন আমরা দেখে নিই।
তাদেরকে পথিমধ্যে এমন একটি নদী পার হতে হলো, যে নদীতে বরফ গলা পানি প্রবাহিত হচ্ছিলো যার কারণে পানি ছিলো প্রচন্ড ঠান্ডা। একদিকে প্রচন্ড গরম আবহাওয়া, অপর দিকে প্রচন্ড ঠান্ডা পানি। সব মিলিয়ে ক্রুসেডার সেনাবাহিনী এক মহা বিপর্যয়কর অবস্থায় পড়লো। আর তাদের সেনাপতি ফ্রেডরিক বার্বারোজ ছিলো সত্তোরোর্ধ বয়সের বৃদ্ধ। লৌহবর্ম দিয়ে তার শরীরের মাথা থেকে পা পর্যন্ত আবৃত ছিলো। ফ্রেডরিক বার্বারোজ ঘোড়ায় চড়ে অল্প পানির একটি খাল পার হচ্ছিল আর হঠাৎ কেন যেন তার ঘোড়াটি অস্বাভাবিক কিছু একটা দেখে ভয় পেয়ে লাফানো শুরু করলো। ফলে ফ্রেডরিক বার্বারোজা ঘোরা থেকে ছিটকে পানির মধ্যে পড়ে গিয়ে হার্ট এ্যাটাক করে সেখানেই মারা গেলো।
ইমাম ইবনে আসীর রহ. তার মৃত্যুর ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, জার্মান কিং ফ্রেডরিক সামান্য হাটু পানিতে ডুবে মারা গেলো। অথচ ফ্রেডরিক বার্বারোজ ছিলো এমন একটি নাম যা শুনলে গোটা দুনিয়ার মানুষের হৃদয়ে কম্পন শুরু হয়ে যেতো। যে ছিলো ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী বীর যোদ্ধা ও প্রতাপশালী শাসক, আল্লাহ তাকে সামান্য হাটু পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করলেন।
জার্মান কিং এর মৃত্যুর পর ক্রুসেডারদের মধ্যে অনৈক্য ছড়িয়ে পড়লো। এছাড়া দীর্ঘ যাত্রা ও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তাদের মধ্যে বিভিন্ন রকম রোগ-ব্যধিও ছড়িয়ে পড়লো। এভাবে তারা যখন শাম দেশে গিয়ে পৌঁছলো তখন তাদের অবস্থা ছিলো এমন যেন, তাদেরকে মাত্র কবর থেকে টেনে বের করা হয়েছে। শুধু তাই নয় পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ আর পলায়ন করতে করতে শেষ পর্যন্ত যখন এই তিন লক্ষ সেনাবাহিনীর বহর ‘আল বাক্কা’ গিয়ে পৌঁছেছিলো, তখন তাদের সংখ্যা অবিশ্বাস্যভাবে তিন লাখ থেকে নেমে দাঁড়িয়েছিলো মাত্র এক হাজারে। তিন লক্ষ থেকে মাত্র এক হাজার সৈন্য শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছলো সালাহ উদ্দীন আইউবী রহ. এর মোকাবেলা করার জন্য।
এই ফ্রেডরিক বার্বারোজা সালাহ উদ্দীনকে অহংকার ও দম্ভের সাথে চিঠি লিখে হুমকি দিয়েছিলো যে, সালাহ উদ্দীন যদি বারো মাসের মধ্যে এই অঞ্চল থেকে তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার না করে, তাহলে তাকে দেখে নেবে, এই করবে সেই করবে...। কিন্তু আল্লাহ চাইলেন অহংকারী বার্বারোজকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত করতে। আর তিনি তা একবারে সহজভাবেই করে ছাড়লেন। বার্বারোজ শপথ করেছিলো যে সে ফিলিস্তিনের পবিত্র মাটিতে পা রাখবেই, কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তাকে তার শপথ পূরণ করতে দিলেন না। ফিলিস্তিনে আসার আগেই যখন সে মারা গেল, তখন পিতার প্রতিজ্ঞা রার্থে তার পুত্র মৃতদেহটি পানিতে সিদ্ধ করে ভিনেগার মিশিয়ে একটি ড্রামে সংরক্ষণ করল। কিন্তু মৃতদেহটি পঁচে গলে ড্রামটি ফেটে বের হয়ে গেলো। আর তার পুত্র অবশেষে বাধ্য হলো তাকে পথিমধ্যে এক জায়গায় মাটি খুড়ে পুঁতে রাখতে। সে তার সামান্য শপথটুকুও পূরণ করতে পারলো না। ইসলামের সাথে 'বাগাওয়াত'কারী মহা শক্তিধর এই সম্রাটের এমন মর্মন্তুদ পরিণতি পরবর্তী সকল বাগীদের জন্য এক ইতিহাস হয়ে রইলো। (তথ্যসূত্র: শায়খ আনওয়ার আল আওলাকী লেকচার।)
চলবে...
পূর্বের লেখা:
‘বাগী’রা কখনো বিজয়ী হয় না -1
http://lighthouse24.org/blog/post/viewPost/?postid=711
যুগে যুগে 'বাগী'দের পরাজয়
http://lighthouse24.org/blog/post/viewPost/?postid=732
বিষয়: বিবিধ
১৪০৬ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইতিহাস মানুষ পড়ে কিন্তু তা থেকে শিক্ষা গ্রহন করে না । এখানেই মানুষের পরাজয় হয়।
কঠিন সত্য।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যেনো নিজেদের বিবেক ও মস্তিস্ককে ইসলামের জন্য, মানবতার জন্য ব্যবহার করতে পারি, লিখে যেতে পারি আল্লাহ সেই তাওফীক দিন আমীন।
ইনশাআল্লাহ জানাবো।
ভালো লাগলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন