গণতান্ত্রিক সমাজে ইসলামী রাজনীতি
লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১০:০৩:৫৮ সকাল
পূর্ব প্রকাশের পর-
আমাদের দেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবেও যে সকল ইসলামী দল গণতান্ত্রিকভাবে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় তাদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ভেতরগত অভিমত হচ্ছে,
- গণতন্ত্রের মাধ্যমে যে ইসলামী হুকুমাত কায়েম হবে না তা আমরা জানি। কিন্তু বর্তমান সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে রাজনীতি করতে হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা ও ব্যাপক সুযোগ গ্রহণ করে সহজে মানুষের কাছে পৌঁছতে হলে আপাতত: গণতান্ত্রিক কর্মসূচীর বিকল্প নেই। যদিও আমরা মূল গণতন্ত্রের মৌলিক আকীদাগত সমস্যা গুলোকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করতে পারছি না বা আমরা এর সাথে একমতও নই, কিন্তু তদুপরি পরিস্থিতির চাপে আপাতত: আমরা একে গ্রহণ করে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছি। কোনোভাবে অবস্থার উন্নতি হলে কিংবা নির্বাচনে একাধিক আসন পেয়ে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারলে তখন আমরা গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়ের যেগুলোর সাথে ইসলামের সাংঘর্ষিকতা আছে তা পরিহার করবো এবং পর্যায়ক্রমে সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েম করবো।
আসলে ইসলামের মৌলিক আকীদা-বিশ্বাসের ব্যাপারে নূন্যতম ধারণা আছে এবং মুসলিম হিসেবে সরাসরি হারামকে হালাল হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেন না -নূন্যতম এতোটুকু বিবেকবান ইসলামিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের প্রায় সকলেরই আন্তরিক অভিব্যক্তি এমনই। আমাদের দেশে ইসলামী রাজনীতির অন্যতম পুরোধা শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক সাহেব রহ. এর থেকে সরাসরি এমন অভিব্যক্তি আমরা অনেক শুনেছিলাম।
চরমোনাইর মরহুম পীর সাহেব পীর-মুরিদীর বাইরে এসে রাজনৈতিক দল গঠন করে বাহ্যিকভাবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও নিজের সংগঠনের নাম কিন্তু ঠিকই রেখেছিলেন ‘ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলন।’ ইসলামি শাসন আর গণতান্ত্রিক শাসন যে সম্পূর্ণ দুই মেরুর বিষয় সে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ইসলামী নেতৃবৃন্দ বুঝেও আপাতত: এর চাইতে উত্তম কোনো বিষয় না পাওয়ায় ‘মন্দের ভালো’ হিসেবে এভাবেই রাজনৈতিক ময়দানে নিজেদের কর্মতৎপরতা চালাচ্ছিলেন।
কিন্তু গণতন্ত্রের মূল হোতারা যখন ইসলামিক দলগুলোর এই আন্তরিক অভিব্যক্তি সম্পর্কে ধারণা পেলো তখন তারা এ বিষয়ে সরাসরি আপত্তি তুললো। তারা হয়তো গণতন্ত্র অথবা ইসলামের একটি সুস্পষ্ট দেয়াল তুলে দিলো ইসলামী দলগুলোর সামনে। নির্বাচন করতে হলে দলের নাম থেকে ‘শাসনতন্ত্র’ শব্দটি বাদ দিতে হবে বলে জানিয়ে দিলো। কারণ ইসলামী শাসন আর গণতান্ত্রিক শাসন যে আলাদা দু’টি বিষয় তা তো তাদের কাছে আর অজানা নয়। তারা যেনে শুনেই মহান আল্লাহর শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে মানুষের শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছেন সুতরাং তারা কি জন্য আল্লাহর শাসন কামনা করা ইসলামিক দলগুলোকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচনের সুযোগ দিবেন?
ফলে যা হবার তাই হলো। ইসলামিক শাসনতন্ত্র আন্দোলনের নাম থেকে ‘শাসনতন্ত্র’ শব্দটি বাদ দিতে হলো। গণতান্তিুক নির্বাচনে অংশগ্রহণের স্বার্থে শেষ পর্যন্ত চরমোনাই পীর সাহেব প্রতিষ্ঠিত ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন বাংলাদেশ’ শেষপর্যন্ত নিজেদের দলের নাম পরিবর্তন করে শুধুমাত্র ‘ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ’ হিসেবে আবির্ভূত হলেন। যদিও তারা এখনও নিজেদের ছাত্র সংগঠনের নাম ‘ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন’ রেখে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ তাদেরকে ‘ছাত্রদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রয়োজন হলেও বড়দের জন্য কি আর তা দরকার নেই’ -জাতীয় তীর্যক মন্তব্যবাণে জর্জরিত করলেও আসলে তাদের ইসলামের ব্যাপারে তাদের আন্তরিক অবস্থা, গণতন্ত্রের ব্যাপারে মৌলিক উপলব্ধি ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনীতির ময়দানে কাজের জন্য তাদের অপারগতার বিষয়টি নিজেদের মতো বুঝে চুপ করে থাকেন।
এর চাইতেও বড় ধরণের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিষয় সৃষ্টি হয় এদেশে ইসলামী রাজনীতির পক্ষে সর্ব প্রথম ও সবচাইতে বেশি অবদান রাখা জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাথে। বাহ্যিকভাবে ও প্রকাশ্যে তারা গণতান্ত্রিকভাবে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের প্রায় সকলেরই আন্তরিক ইচ্ছা এদেশে ইসলাম কায়েম করা। তারা সব সময় এটিই বলে থাকেন। ইসলাম কায়েমের জন্য তাদের সাংগঠিনক ত্যাগ ও পরিশ্রমও এদেশে কাজ করে যাওয়া অন্য অনেক সংগঠনের চাইতে অনেক বেশি।
কিন্তু এই সংগঠনটির গঠনতন্ত্র ও শ্লোগান ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই’ এবং তাদের লোগো ও মনোগ্রামের মধ্যে বিদ্যমান
أقيموا الدين
‘দীন কায়েম করো’
বিষয়টির দিকে দৃষ্টি পরে গণতন্ত্রের বান্দাদের। তারা আপত্তি তুলে হয়তো আল্লাহর আইন চাইবেন অথবা গণতান্ত্রিকভাবে মানুষের আইন। হয়তো আল্লাহর দীন কায়েমের জন্য আন্দোলন করবেন অথবা গণতান্ত্রিক দীনের জন্য সংগ্রাম করবেন। কোনটি করবেন সেটি আগে নির্ধারণ করুন। আল্লাহর আইন চাইলে, আল্লাহর দীন চাইলে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রার্থীতার সুযোগ দেয়া হবে না। নির্বাচন কমিশন থেকে দলের নিবন্ধনও বাতিল করা হবে।
উদ্ভুত এই পরিস্থিতিতে অবশেষে দলটি নিজেদেরকে একটু আপডেট ও আধুনিক করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তারা তাদের গঠনতন্ত্র ও মৌলিক শ্লোগান ‘আল্লাহর আইন চাই, সৎ লোকের শাসন চাই’ কথাটিকে বাদ দেয়। এর পরিবর্তে তারা ‘কল্যাণময় সমাজ ও রাষ্ট্রের’ একটি নতুন আকর্ষণীয় শব্দ ও বাক্য সামনে নিয়ে আসেন। দলের লোগো থেকেও পূর্বের সেই أقيموا الدين ‘দীন কায়েম করো’ কথাটি বাদ দিয়ে দেন। এতে সাময়িকের জন্য তাদের নিবন্ধন টিকলেও সামান্য সময়ের ব্যবধানে তাদের গঠনতন্ত্রের আরেকটি সম্ভাব্য ধারা যেখানে ‘আল্লাহর স্বার্বভৌমত্বের’ কথা বলা হয়েছে এর অপরাধে তাদেরকে সর্বশেষ আদালতের রায় এবং নির্বাচন কমিশনের যৌথ উদ্যোগে অবশেষে দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়।
এছাড়াও আমাদের সমাজের গণতন্ত্রের বান্দা এবং অনুগত সেবকদের অনেককেই মাঝে মধ্যে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যায় যে, (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহর আইন চলবে না।
মানুষের স্বার্বভৌমত্বের গণতন্ত্রের সুফল নিবেন আবার আল্লাহর স্বার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন -তা হবে না।...
এতোগুলো ঘটনা গণতন্ত্র এবং তার সেবকদের এমন প্রকাশ্য দম্ভোক্তি ও তাদের স্বরূপ প্রকাশ্যে তুলে ধরার ফলে ইসলামের ধারক-বাহকদের বুঝমান অংশের মধ্যে এতোদিনকার ‘গণতান্ত্রিক ইসলামের’ কাল্পনিক অসম্ভব মেলবন্ধনের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরতে পেরেছে এবং তাদের বিবেকের অস্পষ্টতা অনেকাংশেই কাটিয়ে দিতে পেরেছে বলে আমি মনে করি। এরপরও যদি কেউ গণতান্ত্রিকভাবে ইসলাম কায়েমের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে যান, তবে তার ক্ষেত্রে আমার একথা বলা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই যে তিনি ‘ইখলাসের সাথে গুনাহ করে যাচ্ছেন।’
পূর্বের লেখা:
বর্তমান বিশ্বপ্রেক্ষাপটে ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম কর্মপদ্ধতির সন্ধানে
http://lighthouse24.org/blog/post/viewPost/?postid=341
রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম কায়েমের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পরিশুদ্ধি ও গণতন্ত্র
http://lighthouse24.org/blog/post/viewPost/?postid=344
চলবে...
বিষয়: বিবিধ
১৮২৫ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আসলে আমি চেষ্টা করেছিলাম সংক্ষিপ্ত একটি মন্তব্য করবো। কিন্তু বিষয়টা বেশ জটিল ও ব্যায়াপক আলোচনা সাপেক্ষ মনে হচ্ছে বিধায় বিস্তারিত আর এগোনো ঠিক হচ্ছে না। ইনশায়াল্লাহ এ ব্যাপারে আমিও কিছু চিন্তা করছি যা পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করার আশা করছি। ওমা তাইফীকি ইল্লা বিল্লাহ।
যদি ডিকশনারীতে আমরা মানবাধিকারের আক্ষরিক ও পারিভাষিক সংজ্ঞা খুজতে যাই তবে সেখানে পাওয়া যাবে কিছু কাগুজে লিখিত কালো কালির নীতি বাক্য। আর বাস্তবে যদি এর প্রেক্টিক্যাল সংজ্ঞা আমরা ধার করাতে চেষ্টা করি তবে তারতম্য হতে বাধ্য। বলতে পারেন তখন বিষয়টি আপেক্ষিক হয়ে যাবে দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে। মালালা ইউসূফজাইয়ের ক্ষেত্রে মানবাধিকার আমরা দেখতে পাচ্ছি এক ধরণের সংজ্ঞা তৈরী হচ্ছে। আবার বার্মার রহিঙ্গা অজানা অচেনা অপরিচিত মুসলিম শিশুদের ক্ষেত্রে মানবাধিকারের সংজ্ঞা অন্যভাবে তৈরী হচ্ছে। আমি মন্তব্যের শেষেই ইংগিত দিয়েছিলাম বিষয়টি ব্যায়াপক আলোচনা সাপেক্ষ। তাই সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে। ইনশায়াল্লাহ সময় সুযোগ পেলে এ বিষয়ে আমার নিজের মতামত শেয়ার করবো।
আপনার এ মন্তব্যটি যথার্থ মনে হয়না-
এরপরও যদি কেউ গণতান্ত্রিকভাবে ইসলাম কায়েমের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা-প্রচেষ্টা করে যান, তবে তার ক্ষেত্রে আমার একথা বলা ছাড়া আর কিছুই বলার নেই যে তিনি ‘ইখলাসের সাথে গুনাহ করে যাচ্ছেন।’
আরো ব্যাখ্যা প্রয়োজন!
অথবা
অভিযোগটি সুপ্রীমকোর্টে [আদালতে আখেরাত] রেফার করা যেতে পারে [যতদূর জানি- এ ধরণের মন্তব্যে স্যুয়োমোটো(স্বয়ংক্রিয়ভাবে) রীট হওয়ার কথা)
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম!
[অ.ট.: জটিল বিষয়ে একজন আলিম-পরিচিতি ব্যক্তির অপর্যাপ্ত গবেষণার সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য মুসলিম উম্মাহর জন্য যতটা ক্ষতিকর হতে পারে, লক্ষাধিক দুস্কৃতিকারীও তা পারেনা!
কারণ দুস্কৃতিকারীদের ক্ষতিটা বস্তুগত, অনায়াসেই সারিয়ে তোলা যায়! কিন্তু আলিমের রায় বিশ্বাসগত- জনসাধারণে এর প্রভাব কয়েক শতাব্দী থেকে যায়!]
এ লেখাটি আপনার কাজে লাগতে পারে
ভোট ও নির্বাচন পদ্ধতি : ইসলামের দৃষ্টিকোণ
লিখেছেন অনুসন্ধান ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১১:৫৭ সকাল
তবে আপনার উপসংহার এর সাথে কোনভাবেই একমত নই। মানুষের মধ্যে ইসলামি জীবন বোধ পুরোপুরি না আসা পর্যন্ত ইসলাম কায়েম করা সম্ভব নয়। দৃষ্টান্ত আফগানিস্তানের তালিবান সরকার। ইসলামি শাসন কে যারা কড়াকড়ি ভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে বিশ্ব মুসলিম থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। ইসলাম কে যুগোপযুগি নয় বরং আধুনিক আবিস্কার সেটা সামাজিক বা প্রযুক্তি যেভাবেই হোক তাকে ইসলাম সম্মতভাবে ব্যবহার করতে হবে। আরকেটি বিশেষ বিষয় অনেকেই গনতন্ত্র ইসলাম সম্মত নয় বলে বলেন কিন্তু এর বিকল্প ব্যবস্থা কি তা নিয়ে আলোকপাত করেননা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন