সম্পর্কের গল্পটা
লিখেছেন লিখেছেন শুকনোপাতা ২৯ জুন, ২০১৬, ০১:২৮:৩৩ দুপুর
শীতের বিকেলটা বড্ড দ্রুত ফুরিয়ে যায়,সন্ধ্যে টা হুট করে কখন নেমে আসে টের ই পাওয়া যায় না। ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আবার কাজে মনোযোগ দেয় নিতু। দ্রুত হাতে টাইপ শেষ করে প্রিন্টে দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। এক টানা অনেক ক্ষন বসে আছে,এক কাপ কফির জন্য মনটা ভীষন ছুটছে কিন্তু উপায় নেই। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে নিজেই সুধায়
– কেবল কফি খাওয়ার জন্যই জীবন না,জীবনে রিপোর্ট ও লিখতে হয়,একটা দুইটা না অনেক গুলো!
পেপার গুলো হাতে নিয়ে স্যারের রুমের সামনে যেয়ে দেখলো দরজা বন্ধ,চলে গেলেন নাকি! হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো,আহহ… ৫টা বাজতে দেরি বসের অফিস ছাড়তে দেরি না কিন্তু অন্যদের বেলায় ৭টা বাজলেও অফিস আওয়ার আর ফুরায় না!
সেকশন ইনচার্জের কাছে রিপোর্ট গুলোা বুঝিয়ে দিয়ে ব্যাগ গুছাতে লাগল, 6.25 বেজে গেছে,বাসে উঠা যাবে কি না কে জানে! দ্রুত পায়ে হেঁটে সায়েন্স ল্যাবের মোড়ে এসে দাঁড়ালো। বাস আসার নাম গন্ধও নেই,কানে হেড ফোন গুজে রাস্তার এক পাশে দাঁড়ালো। চোখ থেকে চশমটা খুলে টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে ঝাপসা চোখে একবার চারপাশে তাকালো,আহ! কি ব্যস্ত জীবন সবার,কেউ বাড়ি ফিরছে তো কেউ এক কাজ ছেড়ে আরেক কাজে কেউ বা আবার বেরিয়েছে অন্য কোন গন্তব্যে। ফুটপাথের ফেরিওয়ালা হিসেব কষছে দিনের আয় কেমন হলো,রাতে বাকী টাকা উসূল হবে তো? ব্যাগে বাজার নিয়ে হাটতে হাটতে কেউ বা আবার হিসেব কষছে কতো খরচ হলো,বাজেট ঠিক আছে তো?
– চশমা নিলি কবে?
পরিচিত কারো কন্ঠ শুনে ঘাড় ফেরালো,চশমাটা চোখে দিয়ে তাকিয়ে মুখটা দেখলো কিন্তু কোন কিছু বলল না।
– বাসের জন্য অপেক্ষা করছিস? কেমন চলছে চাকরী? তোর লেখা পড়ি মাঝে মাঝে,ভালোই তো লিখিস,তোদের পোর্টালটা ও বেশ ভালোই পপুলার দেখি।
অনেকক্ষন মুখের তাকিয়ে থেকে আবারো রাস্তার দিকে চোখ ফেরালো।
– তোকে দেখে বেশ সুখী মানুষ মনে হচ্ছে,ভালো আছিস তো?
নিতুর কথায় হেসে ফেলল নবনী।
– চেহারায় সুখী সুখী ভাব রাখাটা খুব কঠিন কাজ না,আর আমি মানুষটাকে আল্লাহ সুখী চেহারার করে পাঠিয়েছেন তাই ভেতরে সুখ না থাকলেও মুখ দেখে সুখীই মনে হয়। তোর বাসা কি এখনো আগের জায়গাতেই আছে?
-হুম! তোর?
-বদলেছে।
নিতু আর কিছু বলল না। অথচ অনেক প্রশ্ন করার ছিলো,কিছু প্রশ্নের জবাব জানার ছিলো কিন্তু ইচ্ছে করলো না কিছু বলতে। হাঁটবে কিনা ভাবতে লাগল,আবার মনে হলো হেঁটে কতোদূর ই বা যাওয়া যাবে? তারচেয়ে এখান থেকেই রিকশা পাওয়া যায় কি না।
– নবনী,আমার বাসে আজকে আর যাওয়া হবে বলে মনে হয় না,রিকশা নিবো ভাবছি।
-ওহ! ঠিক আছে যা তাহলে।
রিকশায় বসে নিতুর মনে হলো,এতোটা কাঠখোট্টা না হলে পারতো!
একটা সময় ছিলো যখন নবনীর সাথে গল্প করতে করতে সময় ফুরাতো না,ক্লাস-ক্যান্টিন কিংবা রিক্সা ,ইনবক্স কতো জায়গায় কতো শতো কথা যে বলার থাকতো,আর আজ?কিছু সময়ের জন্যে কথাই যেনো খুঁজে পাওয়া গেলো না!
অনেক ভেবেও মাঝে মাঝে খুঁজে পায় না,আসলে কি এমন হয়েছিলো যার কারণে দু’জনের মাঝে এতো দূরত্ব হয়ে গেলো! নিতুর এখনো মনে পড়ে,ক্যাম্পাসের সেই দিন গুলোর কথা। যথেষ্ট ভীতু টাইপের মেয়ে ছিলো নবনী,পলাশী থেকে শাহাবাগ আসতেও সাথে কাউকে তার লাগতো, সারাটা সময় নিতুর সাথে আঠার মতো লেগে থাকতো! নিতু সবচেয়ে বেশি ভয় পেতো নবনীর সাথে শপিং এ যেতে। একটা কাপড় পছন্দ করতে যে কি পরিমাণ সময় লাগতো নবনীর সেটা চিন্তা করলে এখনো মাথা ঘুরায় নিতুর! আচ্ছা,এখন ও কার সাথে যায় শপিং এ? ওর বরের সাথে নাকি একা?
দোকানের খাবার নিয়ে হাই লেভেলের এলার্জি ছিলো নবনীর,অন্য দিকে নিতুর জন্য রাস্তা-গলির সব খাবারই সুস্বাদু ছিলো, এ নিয়ে কতো খুঁনসুঁটি! এসাইনমেন্টে-প্রেজেন্টেশনের কাজ গুলো কিংবা সার্ভে রিপোর্ট সময় গুলো সব মিলিয়ে দু’জনের জন্য কি বর্ণিল ই না ছিলো। এখনো কি এতো ব্যস্ত থাকে মেয়েটা?
আসিফ কে বিয়ে করার ব্যাপারে নিতুর কোন রকম সায় ছিলো না বলে নবনী যথেষ্ট বিরক্ত ছিলো ওর উপর। কিন্তু নিতু অনেক চেষ্টা করেও পারেনি মন থেকে ওদের বিয়েটা মানতে। আসিফ কে লিমিটলেস মানুষ বলে মনে হতো,আর নবনীর মতো নাকওয়ালা কেউ আসিফের সাথে এডজাস্ট করতে পারবে এটা কেন জানি বিশ্বাস হয়নি কিন্তু কি করার?
নবনীর পরিবারের ধারণা,অনার্স শেষ করার মধ্যে মেয়ের বিয়ে না হলে আর বিয়ে হবে না,বয়স বেড়ে যাবে চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে ইত্যাদি! তাই ফোর্থ ইয়ারে উঠতেই বিয়ের জন্য প্রস্তুত নবনী। আর অন্য দিকে ফাইনাল পরিক্ষা,বিসিএস প্রিপারেশন নিয়ে মহা ব্যস্ত নিতুর জন্য নবনী কাকে বিয়ে করছে,কেন এখন বিয়ে করছে এসব নিয়ে অতো ভাবার সময় নেই।
আসিফের ব্যাপারে যখন নবনী নিতুর মতামত চাইলো,তখন সব কিছু শুনে একবার কথা বলেই নিতু না করে দিয়েছিলো!লোকটাকে দেখে,তার সম্পর্কে শুনে নিতুর মনে হয়েছে,বাহিরে অনেক কিছু থাকলেও ভেতরটা একেবারেই ফাঁকা কিন্তু এরচেয়ে বেশি কিছু নবনীকে বোঝাতে পারেনি। আর তাই বিয়ের পর থেকে নবনী যোগাযোগ কমিয়ে দেয়,আর অন্যদিকে খানিকটা অভিমান আর ব্যস্ততার ভারে নিতুও যোগাযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করেনি! জীবনের ঐ এক সিদ্ধান্তই যেনো বদলে দিয়েছিলো প্রায় সাড়ে ৪ বছরের বন্ধুত্ব। শুধু মাঝে মাঝে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে স্ট্যাটাস-ছবি দেখে আর গেট টুগেদারে টুকটাক কথার মাঝেই আটকে যায় কয়েক বছর।
‘পাঠক সমস্যা’ বিভাগে কাজ করতে নিতুর বরাবর ই এলার্জি! মানুষের ভয়াবহ রকমের সমস্যা গুলো পড়তে পড়তে মনে হয় মানুসিক রোগী হয়ে যেতে হবে কিন্তু এই সেকশনে নিয়মিত ইনচার্জ না থাকায় প্রায়ই ঘুরে ফিরে ওর কাছেই কাজ গুলো আসে। ইনবক্স চেক করতে যেয়ে ছদ্মনামের একটা ম্যাসেজে চোখ আটকে যায়,ম্যাসেজটা একবার না কয়েকবার পড়ল ভাষা গুলো খুব বেশি পরিচিত। একটা সময় খেয়াল করলো দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
রাতে সব কাজ শেষ করে এক মগ কফি নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো,রাত দীর্ঘ হবার এই এক শান্তি সব কাজ শেষ করে অনেকটা সময় হাতে থাকে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে নবনী কে কল দেবার কথা ভাবলো কিন্তু নাম্বারটা ডায়াল করা হলো না,খুব কাছের সম্পর্ক থেকে যখন কেউ দূর সম্পর্কের হয়ে যায় তখন কেন যেনো আর চাইলেও তাকে কাছে ভাবা যায় না,মানুষটার ভেতর বাহির সব জানা সত্ত্বেও তাকে অনেক বেশি অচেনা মনে হয়। ল্যাপটপ টা অন করে নবনীর প্রোফাইলে গেলো, অনেকটা সময় ঘুরাঘুরি করল তারপর আবারো ব্যালকনিতে এসে বসল।
এক সময়কার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটা এখন ভালো নেই জেনেও তাকে কিছু বলতে পারছে না,জিজ্ঞেস করতে পারছে না কি হয়েছিলো?এখন কেমন আছে সে? প্রতিনিয়ত কি করে কষ্ট সহ্য করে বেঁচে আছে? এতোদিনের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও একটাবার ও কি ওর সাথে শেয়ার করতে পারতো না?
সংসার-চাকরী,ঘরে-বাইরে নিজ নিজ অবস্থান আর ভালো থাকার ব্যস্ততা গুলো অজান্তেই কতো কিছু বদলে দিয়েছে। নবনী ভাবছে এখন হয়তো নিতু তাকে মূল্যহীণ ভাবছে কিংবা সে যে ভালো আছে এটা জানলে এখন খারাপ লাগবে! আর নিতুর মনে হচ্ছে,তার কঠিন সময়টা তে নবনী স্বার্থপরের মতো পাশে থাকেনি এখন কি করে সে দাঁড়াবে? এখন তার হাসিটাও হয়তো নবনীর কাছে আগের মতও আপন মনে হবে না!
আমিত্ব কিংবা অপরাধবোধ আর সাথে সময়ের চলে যাওয়া অনেক দিনের চিরচেনা সম্পর্ক গুলো বদলে দেয়। মাঝে শুধু থেকে যায় কিছু সুখ স্মৃতি আর অপ্রকাশিত দুঃখ! এক সময়কার মজবুত বন্ধুত্বের সম্পর্কটা তাই খুব বেশিই ঠুনকো হয়ে যায়। চাইলেও তখন আর জানা যায় না,আমার এক সময়কার সুখ-দুঃখের নিত্য সাথী বন্ধুটা এখন কেমন আছে?
বিষয়: সাহিত্য
১৪৮০ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
Click this link
মন্তব্য করতে লগইন করুন