সরকার যখন দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের পক্ষ নেয়

লিখেছেন লিখেছেন ফরীদ আহমদ রেজা ০৩ মে, ২০১৩, ০৩:৩৩:৫০ রাত

গতকাল সারা বিশ্বে মহান মে দিবস পালিত হয়েছে। বাংলাদেশের ভবন-ধ্বসে হতাহত শ্রমিকদের পরিবারে এখনো চলছে আর্তনাদ ও মাতম। শাহীনা এবং আরো অনেকে হয়তো রানা প্লাজার ধ্বংসস্তুপে কয়েকদিন বেঁচে ছিলেন। শেষ মুহূর্তে সর্বনাশা আগুন ছাই করে দিয়েছে তাদের বাঁচার স্বপ্ন। এখন ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পুরো রানা প্লাজা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। শাহীনা দেশের লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকদের একজন। বাংলাদেশে মুনাফাখোর মালিক এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অবহেলার কারণে শ্রমিকরা ভবন-ধ্বসে এবং আগুনে পুড়ে মরছে। আরো অসংখ্য শ্রমিক মরছে দুর্ঘটনায়। মরে গেলে কেউ হয় বেওয়ারিশ লাশ, আর বেঁচে থাকলে আধমরা ও পঙ্গু হয়ে দেশ ও জাতিকে অভিশাপ দিয়ে দিন কাটায়। ১২৭ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিকদের মিছিলে পুলিশের গুলি করার পর বিশ্বসম্প্রদায় শ্রমিকদের ন্যুনতম একটা সম্মান ও অধিকার দিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকরা তা থেকে এখনো বঞ্চিত। বাংলাদেশ শিল্পোন্নত দেশ নয়, তবে দেশের উৎপাদনশীল জনশক্তির অধিকাংশ শ্রমিক শ্রেনীর অন্তর্ভূক্ত। গার্মেন্টস কর্মী, চা-শ্রমিক, কৃষক, দিনমজুর, রিকসাচালক, সুইপার-ঝাড়–দার, গৃহকর্মী প্রভৃতি শ্রমিকশ্রেনী বাংলাদেশের সবচেয়ে নির্যাতিত ও নিগৃহীত জনগোষ্ঠী। আমার যতটুকু মনে পড়ে, স্বাধীনতার পর থেকে সরকারের পক্ষ থেকে মে দিবস উদযাপনের প্রচলন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও সভা-সমাবেশের আয়োজন করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্যে দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ, খাওয়া-থাকার উপযোগি ন্যুনতম মজুরি, স্বাস্থ্য-সেবা, পেনশন, মেটারনিটি লিভ, ইনস্যুরেন্স প্রভৃতি সুবিধার কথা কল্পণা করা যায় না। শ্রমিক-কল্যাণ ইস্যুটি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কারো অগ্রাধিকার আছে বলে মনে হয় না। তারা শ্রমিক শ্রেনীর কাছে শুধু যায় ভোটের সময় এবং জনসভা বা মিছিলের প্রয়োজনে। বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলেরও অভাব নেই। তাদের ভাব-সাব দেখে মনে হয়, মানুষের জীবনমান উন্নত করা বা শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি কাজে অবদান রাখা অনৈসলামিক কাজ। বিদেশী মিশনারীরা বাংলাদেশের উপজাতিদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার, কর্মদক্ষতা তৈরি এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির কাজ করছে। ইসলামপন্থীরা তাদের কঠোর সমালোচনা করেন। দুঃখের বিষয়, তাদের নিজেদের পক্ষ থেকে এমন কোন কর্মসূচী পালনের কথা আমাদের নজরে পড়েনি যার মাধ্যমে তারা শ্রমিক-কৃষক বা মেহনতি মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে চান।

আসলে বাংলাদেশে যারা যখন সরকার চালায় তারা সব সময় দুর্নীতিবাজ ও লুটেরাদের পক্ষ অবলম্বন করে। আর রাজনীতিবিদরা মনে করেন, ক্ষমতায় না গেলে জনসেবা করার আর কোন উপায় নেই। স্বাধীনতার পর থেকে একই অবস্থা বিরাজ করছে। ফলে সরকার বদল হলেও মেহনতি মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয় না। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শোষণ ও বৈষম্য করেছে, তাই আমরা লড়াই করে তাদের তাড়িয়ে দিয়েছি। মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা অনুসারে সাম্য, মানবাধিকার এবং ন্যায়বিচার ছিল মুক্তিযুদ্ধের মৌলচেতনা। স্বাধীনতার পর দেশে ধনীদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং সুরম্য অট্টালিকা দেখে অনেকে মনে করেন দেশের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হচ্ছে। বিত্তহীন ও ভূমিহীনদের সংখ্যা যে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সে দিকে তাদের দৃষ্টি পড়েনা। মানবাধিকার লংঘনের সংখ্যা বছরে বছরে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশে ন্যায় বিচার বা আইনের শাসন নেই বললেই চলে। পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুঁজির শোষণকে বৈধতা দিলেও কমপক্ষে ভোট ও রাষ্ট্রের স্বার্থে দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিতে সরকার বাধ্য হয়। এর প্রধান কারণ পাশ্চাত্য সমাজে আইনের শাসন ও জনসচেতনতার উপস্থিতি। বাংলাদেশে আইনের শাসন নেই, জনগণও ততটা সচেতন নয়। এ কারণে দেশটা দুর্নীতিবাজ এবং শোষকদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে সাম্প্রতিক রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনা। দেশের শ্রমিক শ্রেনীকে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কি ভাবে মূল্যায়ণ করে, এ ঘটনা তারও কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। রানা প্লাজা ধ্বসে পড়ার আসল কারণ দুর্নীতি এবং তা হয়েছে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের সহযোগিতায়। শাসকগোষ্ঠী এবং প্রশাসনের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া কলুর মালিকের ছেলে সোহেল রানার পক্ষে এতো সম্পদ এবং ক্ষমতার মালিক হওয়া সম্ভব হতো না। শাসকগোষ্ঠী এবং প্রশাসনের আশীর্বাদ আছে বলেই বিল্ডিং-এ ফাটল দেখার পরও গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খোলা রেখে হাজার হাজার শ্রমিককে সে মৃত্যুকূপে ঠেলে দেয়ার সাহস দেখিয়েছে।

সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশে ‘সোহেল রানা’ হয়ে উঠা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জেলায় জেলায়, থানায় থানায় এ রকম অসংখ্য সোহেল রানার সন্ধান জনগণের কাছে আছে। সোহেল রানারা কোন্ সংগঠনের ছত্রছায়ায় দুর্নীতি ও লুন্ঠন করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর। তাদের আসলে কোন দল নেই। সব সময় অথবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের দলের নাম পিজিপি, প্রেজেন্ট গবার্ণমেন্ট পার্টি। যে দল যখন ক্ষমতায় আসে, তখন সে দলের আশীর্বাদ পেয়ে তারা ধন্য হয়। স্বাধীনতার পর থেকে তারা এ ভাবেই দল বদল করে করে দুর্নীতি এবং লুন্ঠন করে আসছে। তৌহিদ জংদের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে তারা বেড়ে উঠে, থানা থেকে নিয়ে সেক্রেটারিয়েট পর্যন্ত সকল প্রশাসনিক বিভাগ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হালুয়া-রুটির বিনিময়ে তাদের সহযোগিতা করে। কেউ প্রতিবাদ করলে প্রতিবাদকারীদের তারা মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠায় অথবা বা ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করে দেয়। কখনো বা প্রতিবাদকারী গোষ্ঠীর প্রভাবশালী কাউকে গুম করে ফেলা হয়। থানা-পুলিশ, আদালত, ডিসি-এসপি তাদের কথায় উঠে-বসে। অবশ্য আল্লাহর ওয়াস্তে নয়, নগদ নারায়ণের বিনিময়ে। স্বাধীনতার পর থেকে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি - এ তিনটি দল সরকার পরিচালনা করেছে। সকল দলের নিকট থেকেই ‘পিজিপি’ ওয়ালারা সমান সুযোগ-সুবিধা লাভ করেছে।

রানা প্লাজা গড়ে উঠেছে সংখ্যালঘু এক পরিবারের সম্পত্তির উপর। এটাও কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্ষমতাসীনরা সব সময়ই সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল করে আসছে। পাকিস্তান আমলে করেছে মুসলিম লীগ এবং এখন করছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার জোরেই সোহেল রানা রবীন্দ্রনাথ সাহার সম্পত্তি দখল করেছে। দেশে যদি আইনের শাসন থাকতো তা হলে কি সোহেল রানা তা করতে পারতো? রবীন্দ্রনাথ সাহা আদালতের আশ্রয় নিয়েও সম্পত্তি রক্ষা করতে পারেননি। কেন পারেননি তা বুঝতে আইনজ্ঞ হতে হয় না। সোহেল রানা গ্রেফতার হওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথ সাহা মুখ খুলতে সাহস পাননি। কারণ তিনি জানেন, সোহেল রানাদের জেলে আটক করে রাখা যায় না। মুখ খুললে জেল থেকে বেরিয়ে এসে সে এর প্রতিশোধ নিবে। আটক অবস্থায় সোহেল রানার হুমকি পত্রপত্রিকায় আমরা দেখেছি। পুলিশি রিমান্ডে থাকা অবস্থায় চারজন গার্মেন্ট মালিকের গায়ে সে হাত তুলেছে। গার্মেন্ট মালিকদের দেখে সে রেগে গিয়ে বলে, ‘তোরা আমার বিরুদ্ধে কথা কইতাছস? বাইর হইয়া লই। তহন বুজবি। তোগো সবগুলারে দেইখ্যা লমু। কয় দিন আটকাইয়া রাখব আমারে?’ কথা বলার একপর্যায়ে সে গার্মেন্ট মালিকদের চড়-থাপ্পড়ও মেরেছে। জেল হাজতে বাস করে যারা এ রকম দাপট দেখায় বা দেখাতে পারে তাদের ক্ষমতার সীমানা কতটুকু তা আমাদের ধারণার বাইরে। এ জন্যেই রবীন্দ্র সাহারা সব সময় সোহেল রানাদের সব সময় ভয় করে চলেন। আজ এখানে আমরা রবীন্দ্র সাহার কথা জেনেছি, দেশে আরো অনেক রবীন্দ্র সাহা, আব্দুল করিম বা রমজানের মা গডফাদারদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। তাদের খবর সাধারণ মানুষ জানে, কিন্তু মুখ খুলতে সাহস পায় না। দেশে আইনের শাসন থাকলে, দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন যদি সরকারে ব্রত হতো তা হলে মানুষ সত্য কথা বলার সহাস পেতো। দেশের রাজনীতি এ ভাবে দুর্বৃত্তদের কবলে জিম্মি হয়ে আছে।

সোহেল রানার বিরুদ্ধে মামলা করেছে রাষ্ট্র। চার শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু, সহস্রাধিক শ্রমিক আহত এবং সহস্রাধিক শ্রমিক নিখোঁজ হয়েছে সোহেল রানার কারণে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারী মামলা হয়নি। পত্রিকায় এসেছে, যে ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাতে বড় জোর ৫ বছরের জেল হতে পারে। বেকসুর খালাসও পেতে পারে। আমাদের আদালত এবং রাষ্ট্রপতির মন দয়ার প্রতিমুর্তি। সন্ত্রাসী এবং খুনের আসামীরা সেখানে সহজেই দয়া লাভ করে ধন্য হয়।

আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সোহেল রানারা মূল্যবান সম্পদ। মিছিল, বোমাবাজি টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদির জন্যে তাদের প্রয়োজন। সরকার আইনের অপপ্রয়োগ করে এদের সুবিধা প্রদান করে। এমপি মুরাদ জং বলেছেন তিনি রানাকে চিনেন না। অথচ ছবি বেরিয়েছ, তিনি সোহেল রানাকে চুমু দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছেন, সে যুবলীগের কেউ নয়। সাংবাদিকরা পোস্টারের ছবি ছাপিয়ে তা মিথ্যা প্রমাণ করেছেন। এ ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী আরো মিথ্যাচার করেছেন। রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হবার পর পর জাতিকে অভয় দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ঘটনার ব্যাপারে আমরা আগে থেকেই সতর্ক ছিলাম। লোকজনকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সকালে কিছু লোক মূল্যবান মালামাল সরাতে গিয়েছিল।’ পরে যখন তাঁর এ কথা ভুল বলে প্রমাণিত হলো তখনও তিনি তা সংশোধন বা এর জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেননি। আমরা দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে এ রকম দায়িত্বহীন আচরণ আশা করি না। রানার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার এজহার এতো হালকা করে লেখার কারণ কি? এর কারণ হচ্ছে, আমাদের রাজনীতি দুর্বৃত্তায়নের কবলে আপতিত। বিরোধী দলের ১৫০ জন নেতাকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে কোর্টে নেয়া হয়। রানাদের ঢাকায় আনা হয় হেলিকপ্টারে চড়িয়ে এবং কোর্টে নেয়া হয় শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে। কারণ রানারা সাধারণ খুনি নয়, তারা গডফাদার। বিরোধী দলের হরতাল প্রতিরোধ বা নির্বাচনের সময় ভোটবাক্স দখলের জন্যে রানাদের প্রয়োজন। বড় বড় সমাবেশ এবং মিছিল করার জন্যে শ্রমিক সংগ্রহে রানারা অত্যন্ত দক্ষ এবং চৌকস।

রানা প্লাজা ভেঙে পড়ার কারণ ‘আল্লাহর গজব’ নয়, গডফাদারদের লোভ এবং দুর্নীতি। আল্লাহর গজব বললে দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দেয়া হবে এবং নির্যাতিত শ্রমিকদের অসম্মান করা হবে। এ দুর্ঘটনা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের ফসল। পুকুরে মাটি ভরাট করে দালান তৈরির যে নিয়ম আছে তা এখানে মানা হয়নি। কেন মানা হয়নি? কার অনুমোদনে তিন তলা বিল্ডিংকে নয় তলা করা হলো? এগুলো দেখাশোনার দায়িত্বে যে প্রকৌশলী ছিলেন তিনি কেন তা দেখেননি? এ সংক্রান্ত ফাইলটি চালাচালি যারা করেছেন তারা সবাই এ জন্যে দায়ী। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঢাকার অধিকাংশ বিল্ডিং তৈরির সময় বিল্ডিং কোড মানা হয় না। এটা প্রধানমন্ত্রী কেন বলছেন? এটা কি দোষীদের পক্ষে সাফাই নয়? সবাই বলছেন, রানা প্লাজা তৈরির সময় বিল্ডিং কোড মানা হয়নি। এ জন্যেই কি তিনি এ কথা বলছেন? প্রধানমন্ত্রীর এ কথা কি রানাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা? এ বক্তব্য যদি সোহেল রানা আদালতে দাখিল করে তা হলে বিল্ডিং কোড ভঙ্গের কারণে আদালত কি তাকে শাস্তি দিতে পারবে? আমাদের দেশে কি এ রকম কোন সাহসী বিচারক আছে?

আশার কথা যে, সাভারে হাজার হাজার শ্রমিক মৃত্যুপুরীতে আটকে আছেন, এ খবর শোনার পর দেশের সাধারণ মানুষ তাদের উদ্ধারের জন্যে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে এসেছেন। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, ফায়াস-সার্ভিস, স্বেচ্ছাসেবক, ডাক্তার, নার্স সবাই জীবন পণ করে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছ। জাতির এ সকল সাহসী সন্তানদের অভিবাদন। শুরুতে সমন্বয়হীনতার কারণে কিছুটা অসুবিধা হলেও পরে তা সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে সুষ্ঠুভাবে চলেছে। কিন্তু আমরা ভেবে পাই না, কি কারণে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী বা রাষ্ট্রপতির দুর্ঘটনাস্থলে আসতে পাঁচ-ছয় দিন সময় লাগলো? একজন ব্লগার রাজিব নিহত হবার পর প্রধানমন্ত্রী সাথে সাথে তার বাসায় ছুটে গেলেন। আর হাজার হাজার শ্রমিক যখন মৃত্যুপুরীতে তখন সেখানে আসতে প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দিন অতিবাহিত হলো। এর কারণ কি এ জন্যে যে এরা শ্রমিক?

আমরা জানি, উদ্ধারকাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে বাংলাদেশে উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাব রয়েছে। এর আগে সংঘটিত দুর্ঘটনার পর বিশেষজ্ঞরা কিছু যন্ত্রপাতি ক্রয় করার সুপারিশ করেন। কিন্তু সরকার সে সুপারিশ বাস্তবায়ন করেনি। সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে, নিজেদের উপযুক্ত যন্ত্রপাতির অভাবে উদ্ধারের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে সাহয্যের কোন আবেদন করা হয়নি। ভারত ও জাপানে উদ্ধার কাজের উন্নততর প্রযুক্তি রয়েছে। ২০১০ সালের আগস্টে চিলির মাত্র ৩৩ জন খনি শ্রমিককে উদ্ধারের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসার সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। অথচ বাংলাদেশে কয়েক হাজার শ্রমিককে উদ্ধার করার জন্য বিদেশি সাহায্যের কথা ভাবাই হলো না। আরো ক্ষোভের বিষয় হচ্ছে, বিদেশ থেকে সাহযোগিতার প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। শ্রমিকশ্রেনীর প্রতি অবহেলার কারণে কি এমনটি করা হলো? সরকারের কেউ-কেটা যদি দুর্ঘটনাস্থলে আটকা পড়তেন তা হলে অবশ্যই বিদেশী সহযোগিতা চাওয়া হতো। বড় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার আগে সেখানে জীবিত বা মৃত কেউ আছে কি না তা নির্ণয় করার উন্নত প্রযুক্তি ইউরোপ-আমেরিকার কাছে আছে। সে ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করলে হয়তো যাদের নিখোঁজ বলা হচ্ছে ধ্বংসস্তুপের মধ্যে তাদের সংজ্ঞাহীন অবস্থায় বা তাদের লাশ পাওয়া যেত। নিখোঁজ হিসেবে চিহ্নিত শ্রমিকদের স্বজনরা কি এ জন্যে সরকারকে আমৃত্যু দায়ী করে ফিরবে না?স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী উদ্ধার তৎপরতার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। উদ্ধার কর্মীদের সাহস এবং ত্যাগ অবশ্যই জাতি চিরদিন স্মরণ রাখবে। কিন্তু বৈদেশিক উন্নত প্রযুক্তির সহায়তা নিলে হাত কেটে, পা কেটে, শরীর ক্ষত-বিক্ষত করে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষগুলোকে উদ্ধার করতে হতো না। তাঁদের অনেককে এখন সারা জীবন পরনির্ভর হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এর দায়ও সরকারকে বহন করতে হবে।

লন্ডন ২ মে ২০১৩

বিষয়: বিবিধ

১২৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File