অলৌকিক শূন্যে ভাসা পাথর প্রতারণা !
লিখেছেন লিখেছেন হেলাল আলনুর ২৫ মার্চ, ২০১৩, ১২:১৯:০৩ দুপুর
অলৌকিক শূন্যে ভাসা পাথর প্রতারণা !
মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন আমাদের এই বিশ্ব জগত সৃষ্টি করেছেন। ছয় দিনে সৃষ্ট এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন তার নিজের স্বকীয়তা প্রমাণের জন্য আমাদের জন্য অনেক নিদর্শন সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি এমন অনেক অলৌকিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন এই পৃথিবীতে যাতে আমরা তার পরিচয় ও ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারি এবং তার উপর বিশ্বাস এনে সঠিক পথের সন্ধান লাভ করি।
তিনি মানব জাতির মুক্তির জন্য পৃথিবীতে অনেক নবী ও রসূল প্রেরণ করেছিলেন এবং তাদের প্রদান করেছিলেন অনেক অলৌকিক ক্ষমতা। যেমন মুসা (আঃ) এর লাঠি সাপে পরিণত হওয়া, সাগর এর মাঝে রাস্তা তৈরি হওয়া, ইউনুস (আঃ) এর মাছের পেট থেকে মুক্তি পাওয়া, ঈসা এর ঊর্ধ্বগমন, মোহাম্মদ (সাঃ) এর হাতের ইশারায় চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত হওয়া ইত্যাদি। এই সকল অলৌকিক নিদর্শন দ্বারা মুসলমানদের ঈমান মজবুত হয় এবং অমুসলমানরা সঠিক পথের সন্ধান লাভ করে। তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে এই সকল অলৌকিক নিদর্শনগুলো মানুষেরা একে অপরকে শেয়ার করে থাকে। কিন্তু অতি উৎসাহী প্রতারক এক শ্রেণীর মানুষেরা এই সকল নিদর্শনগুলো ব্যতিরেকে নিজেরা কারসাজি করে বিভিন্ন অলৌকিক নিদর্শন প্রচার করে। মুসলমানরা এই কারসাজি করা নিদর্শনগুলো দেখে সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ইত্যাদি পাঠ করে তবে আবার এগুলোর মিথ্যাচার জানতে পারলে হতাশ হয়ে পড়ে। তেমনি অমুসলমানরা এই কারসাজি করা নিদর্শনগুলো দেখে প্রথমে ইসলামের প্রতি কিছুটা আকৃষ্ট হলেও পরে মিথ্যাচার জানতে পেরে ইসলাম থেকে আরও পিছিয়ে যায়। আর এমনই একটি ধর্মীয় প্রতারণার নাম অলৌকিক ঝুলন্ত পাথর বা শূন্যে ভাসা পাথর।
প্রচারিত ঝুলন্ত পাথর
বিভিন্ন ওয়েব সাইট, ছবি ও ভিডিওতে আমরা প্রায়ই বৃহদাকার একটি ঝুলন্ত পাথর দেখতে পায়। বলা হয় যেটি আল্লাহর একটি নিদর্শন। আল্লাহর হুকুমে পাথরটি শূন্যের উপর দাড়িয়ে আছে। এটা দেখে আমরা অনেকেই খুশি হয় কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না এই বিষয়টি সম্পূর্ণ প্রতারণা। শূন্যে ভাসমান এই পাথর সম্পর্কে কয়েকটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। যথা:
১. বলা হয়, ৬২১ খ্রিষ্টাব্দের এক মধ্যরাতে সর্বশেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) যখন সৌদি আরবের মসজিদুল আকসা থেকে মিরাজ গমন করছিলেন তখন তিনি এই পাথরের উপরে দাড়িয়ে তার যাত্রা শুরু করেন। রসূল (সাঃ) এর ঊর্ধ্বগমনের সাথে সাথে পাথরটিও জান্নাতে যাওয়ার জন্য তাকে অনুসরণ করে শূন্যে ভাসা শুরু করে। পাথরটি মাটি থেকে সামান্য উপরে উঠার পর রসূল (সাঃ) তাকে থামিয়ে দেন। সেখান থেকে আজ পর্যন্ত সেই পাথরটি রসূল (সাঃ) এর আদেশ মোতাবেক মাটি থেকে উপরে শূন্যে দাড়িয়ে আছে।
২. জেরুজালেমে হযরত সুলাইমান (আঃ) একটি উপাসনালয় নির্মাণ করেছিলেন। এই উপাসনালয় নির্মাণ কাজ চলার সময় নবী এই পাথরটির উপর দাড়িয়ে নির্মাণ কাজের তদারকি করেছিলেন। নবীর উপর সম্মান রেখে সেখান থেকে পাথরটি শূন্যে দাড়িয়ে আছে। বর্তমানে সুলাইমান (আঃ) এর সেই উপাসনালয়টিকে ঘিরে ৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আব্দুল মালিক কুব্বাতুস সাখরা নির্মাণ করেছেন।
প্রকৃত পাথর
৩. অন্য বর্ণনা মতে সৌদি আরবের পূর্ব দিকে আল হাসসা নামক এক গ্রামে এই পাথরটি অবস্থিত। সেখানে পাথরটি মাটি থেকে ১০ সেমি শূন্যে ভাসমান অবস্থায় দাড়িয়ে থাকে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে এটি শূন্যে ভাসে আবার মাটির সাথে লেগে যায়।
৪. আরেক বর্ণনা মতে, এই পাথরটি একজন মুজাহিদকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিল। মুজাহিদ শহীদ হলে তার শরীরের কয়েক ফোটা রক্ত এই পাথরের উপরে পড়েছিল তার পর থেকে পাথরটির এই অবস্থা।
এই সকল গল্প সাজানো হয়েছে এই পাথরটিকে ঘিরে। বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা উল্লেখ করে এই পাথরটিকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এখন জানা যাক পাথরটি কি আসলেই অলৌকিক নাকি এটি নিছক একটি প্রতারণা।
পাথরের ছবিটি বিশ্লেষণ করে ও বর্ণিত এলাকার সূত্র ধরে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, ঝুলন্ত পাথরের এই বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা, বানোয়াট এবং প্রতারণা। তবে ঠিক এই আকারের পাথরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে সৌদি আরবে। সেখানে এমনই একটি পাথর আছে যেটি গোলাকার, তবে সেটি শূন্যে ভাসমান নয় বরং এই পাথরের নিচের সামান্য কিছু অংশ মাটির সাথে মিশে আছে। পাথরটি শূন্যে ভাসমান নয়, তবে দূর থেকে পাথরটি দেখলে শূন্যে ভাসা মনে হয়। পাথরটির প্রতারণা সম্পর্কে প্রমাণ স্বরূপ আরও বলা যায়;
(১) অলৌকিক এই পাথর সম্পর্কে আল কুরআন ও আল হাদিসে কোনও তথ্য নেই। এমনকি কোনও সাহাবী, তাবেঈন, তাবে-তাবেঈন কেউ পাথরটি সম্পর্কে কিছু বর্ণনা করেন নি। ইসলামী কোনও প্রসিদ্ধ গ্রন্থেও এই পাথর সম্পর্কে কোনও আলোচনা নেই।
(২) পাথরটির নিচের কিছু অংশ মাটির সাথে মিশে আছে, কিন্তু সেই অংশগুলো সফটওয়ারের সাহায্যে সম্পাদনা করে মুছে ফেলা হয়েছে। যাতে পাথরটি শূন্যে ভাসা মনে হয়।
(৩) পাথরটির যে ভিডিও গুলো পাওয়া যায় সেগুলোতে পাথরটির কোনও চলমান ছবি নেই বরং স্থির চিত্র দ্বারা ভিডিও গুলো তৈরি করা হয়েছে।
কুব্বাতুস সাখরার ভিতর
(৪) এই পাথরটি কুব্বাতুস সাখরার ভিতরে অবস্থিত বলা হলেও অনেক দর্শনার্থী কুব্বাতুস সাখরা ভ্রমণ করলেও এর ভিতরে কেউ শূন্য ভাসমান কোনও পাথরের সন্ধান পান নি। কোনও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এমন পাথর সম্পর্কে কোনও বর্ণনা প্রদান করেন নি।
মোট কথা সৌদি আরবের কোনও একটি স্থান থেকে এই পাথরের ছবিটি তুলে সেটির নিচে মাটির সাথে লেগে থাকা অংশটুকু প্রযুক্তির সাহায্যে মুছে দিয়ে সবাইকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে। আর অলৌকিক এই ঘটনা দেখে অনলাইনে ছবিটি এতো বেশী প্রচারিত হয়েছে যে, সেটি সবার কাছে সত্যি মনে হয়েছে। আর প্রতারক শ্রেণীর লোকেরা এই ছবিটিকে ঘিরে বিভিন্ন রকম গল্প পরিবেশন করেছে। মুসলমান ধর্মীয় লোকেরা এই পাথরের ছবি প্রথমে দেখে খুবই খুশি হন তবে তাদের জানার মধ্যে থেকে যায় প্রতারণা। অমুসলমানরা এই মিথ্যা বিষয় সম্পর্কে জানার পর ইসলাম সম্পর্কে তাদের মনে খারাপ ধারনা জন্মে।
প্রত্যেক ধর্মের মধ্যে কিছু অতি উৎসাহী লোক থাকে, যারা নিজ ধর্মকে মহিমান্বিত বা বড় দেখানোর জন্য সীমা লঙ্ঘন করে থাকে। সত্যকে মিথ্যা এর মিথ্যাকে সত্য করে এরা নিজেদেরকে মহিমান্বিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই সকল ব্যক্তিরা নিজ ধর্মকে বড় করতে গিয়ে নিজের অজান্তে নিজের ধর্মকে আরও বেশী ছোট ও হেয় করে থাকে। আর তাই মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন যে, তিনি সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।
বিষয়: বিবিধ
১৮৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন