@@@@@ "তৌহীদে আমলী" @@@@@
লিখেছেন লিখেছেন শেখের পোলা ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫, ০৪:৪৪:৩০ রাত
তৌহীদে আমলী৷
(মূল বক্তব্য মরহুম জনাব ডাঃ ইসরার আহমদ রঃ)
https://www.youtube.com/watch?v=yRQlihE0cX4
নাহমাদুহু অয়ানু সাল্লেআলা রাসুলিহীল কারিম৷ আউজু বিল্লাহে মিাশ শাইতুয়ানির রাজীম, বিস মিল্লাহির রহমানির রাহীম৷
১১১/وَقُلِ الْحَمْدُ لِلّهِ الَّذِي لَمْ يَتَّخِذْ وَلَدًا وَلَم يَكُن لَّهُ شَرِيكٌ فِي الْمُلْكِ وَلَمْ يَكُن لَّهُ وَلِيٌّ مِّنَ الذُّلَّ وَكَبِّرْهُ تَكْبِيرًا
অর্থ;-বলুন, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি কোন সন্তান গ্রহন করেন নি৷ যার আধিপত্যে কোন শরিক নেই৷ তিনি ঠেকায় পড়েন না তাই তার কোন সাহায্যকারীরও প্রয়োজন নেই৷ সুতরাং আপনি তার উচিৎ শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখুন৷ (বণী ইস্রাঈল)
১১০/قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَى إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاء رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
অর্থ;-বলুন; আমিও তোমাদের মতই একজন মানুষ৷ আমার প্রতি ‘ওহী’ প্রেরীত হয় যে, তোমাদের ‘ইলাহ’ই একমাত্র ‘ইলাহ’৷ অতএব যে ব্যক্তি তার রবের সাক্ষাত কামনা করে সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার রবের ইবাদতে কাউকে শরিক না করে৷ (সুরা কাহাফ)
দ্বীন সম্পর্কে সচেতন প্রত্যেক মুসলীম জানে যে, দ্বীন ইসলামের মূল বিষয়বস্তুকে যদি একটি শব্দে একত্রীভূত করা হয় তবে তা হবে তৌহীদ৷ ইসলাম তৌহীদের দ্বীন৷ যদিও তৌহীদের বিষয়ে মানুষের ধ্যান-ধারণা, মূল্যমান, ও তার কার্যকারীতা, ফলপ্রসূ করার প্রচেষ্টা অত্যন্ত নগন্য৷ সাধারণ ভাবে বলা হয়, তৌহীদের ধারণা বিশ্বাসের সাথে যুক্ত৷ এ বিষয়েই আমার ব্যাক্তিগত ধ্যান-ধারণা যা সাধারণ মানুষের সংষ্পর্শে এসে উপলব্ধি হয়েছে, তাকেই তুলে ধরার প্রয়াশ করব৷
তৌহীদ দুই রকম, প্রথমটি হল, ইলমী, ফীকরী বা আকিদাগত তৌহীদ৷ ও ২য়টি আমলী তৌহীদ৷ ইমাম তাইমিয়া রঃ আকিদাগত তৌহীদকেই প্রাধান্য দিয়েছেন৷ মানুষের স্বভাবে যে তৌহীদ প্রতিফলিত হতে পারে তাই তৌহীদ ফিল আকিদা৷ এই আকিদাগত তৌহীদও আবার দুই রকম৷ তৌহীদে জাত ও তৌহীদে সিফাত৷ তৌহীদে জাত, যা আল্লাহর সত্তার সাথে মিশে আছে ও তার একত্ববাদকে প্রকাশ করে৷ যেমন, তার না আছে কোন সঙ্গী, না আছে মাতা পিতা, না কোন সন্তান বা কোন অংশীদার৷ তার প্রমান পবিত্র কোরআনের সুরা ইখলাস৷ এ জন্যই রসুল সঃ কোরআনের সুরাগুলির মাঝে একে সর্দার বা তিন আয়াতের এ সুরাটিকে কোরআনের এক তৃতীয়াংশ আখ্যা দিয়েছেন৷ আকিদাগত তৌহীদের অপর অংশটি হল সীফাতী৷ তাঁর সত্তা যেমন একক তাঁর সীফাত বা গুনাবলীও একক৷ তাঁর কোন গুনের সাথেও কারও কোন অংশীদারিত্ব নেই৷ তাঁর একত্ববাদ যেমন ছিল আছে থাকবে, তেমনই তাঁর গুনাবলীও চির কাল ছিল আছে থাকবে৷ এ গুলি কারও দান নয় সম্পূর্ণ নিজস্ব৷ এ বিষয়টিতে যদি মানুষ সতর্ক না থাকে তবে ভ্রমে পড়ার সম্ভাবণা প্রচুর৷ কেননা, তাঁর সীফাতের শব্দগুলি ‘মুশ্তারাক’ তাঁর জন্য ও তাঁর মাখলুকের জন্য৷ যেমন, আল্লাহ আছেন আমিও আছি৷ উভয়ের ‘অজুদিয়ত’ বা স্থায়িত্বে যোজন যোজন তফাত৷ আল্লাহ জ্ঞাণী, মানুষও জ্ঞাণী৷ শুধু তাই নয় মানুষ মহাজ্ঞাণীও হয়৷ কিন্তু দুজনার জ্ঞানে যোজন যোজন তফাৎ৷যদিও একই সীফাতী শব্দ উভয়ের জন্য ব্যবহার হচ্ছে৷ আজ আমার বক্তব্য তৌহীদে আকিদা নয়, তবুও সামান্য ইশারা দিতে চাই৷ যেমন ‘সুরা ইখলাস’ তৌহীদে আকিদার শীর্ষ উদাহরণ তেমনই ‘আয়াতুল কূর্ষী’ হল তৌহীদে সীফাতের শীর্ষ উদাহরণ৷ সেখানেই রয়েছে আল্লাহ তায়ালার শেষ্ঠ গুনাবলীর শ্রেষ্ঠ বর্ণনা৷ তাঁর গুনের কোন সীমা পরিসীমা নেই৷ অপর পক্ষে তাঁর ‘মাখলুক’ হোকনা তিনি ফেরেশ্তা বা আম্বিয়া তাঁর গুনাবলী সীমাবদ্ধ৷
‘তৌহীদে আমলী’রও রয়েছে দুইটি ভাগ৷ প্রথমটি ব্যাক্তি পর্যায়ের আর দ্বিতীয়টি সমষ্টিগত পর্যায়ের৷ বললে অত্যুক্তি হবেনা যে, কয়েক শতাব্দী ধরে আমরা তৌহীদে আমলী থেকে দূরে সরে এসেছি, সে বিষয়ে পরে আসছি, এখানে শুধু তার কিছু ধারণা দিতে চাই মাত্র৷ বর্তমানে তৌহীদের যেখানে যত আলোচণা, বাহাশ, ওয়াজ, মুনাজেরা, বিবৃতি যাই হয়না কেন, তা শুধুই আকিদাগত তৌহীদেরই উপর হয়ে থাকে৷ আল্লামা ইকবাল বলেছেন, ‘জিন্দা কুওয়ত থি জামানামে এ তৌহীদ কভি, আওর আব হ্যায় ফকদ এক মাশালায়ে ইলমে কালাম’-একদা এ তৌহীদই ছিল জীবন্ত জীবনী শক্তি আর আজ তা কেবলই আলোচণার কথামালা মাত্র৷ আর এ ধারণা এতই বদ্ধমূল হয়েছে যে, আমাদের ধরণাই হয়েগেছে যে তৌহীদ শুধুই আকিদা বা বিশ্বাসের বিষয়, আমলে বা আচার আচরণে তার কোন দখল নেই৷
আমার টপিকে ফিরে আসি তা হল তৌহীদে আমলী৷ সেখানেও দুটি পর্যায়ে আলোচণা হবে ইনশা আল্লাহ৷ ব্যাক্তি পর্যায়ে এ তৌহীদের চাহিদা হল, শুধুই আল্লাহর বান্দা হওয়ায় বিশ্বাস করে নেওয়া যে তিনিই আমার এক মাত্র উপাস্য৷ আর মুখে বলা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’৷ যখন এই স্বীকারোক্তি মানুষের অন্তরে আস্তানা গাড়বে তখন তার কাজ হবে সার্বক্ষনিক সেই আল্লাহর গোলাম হয়ে যাওয়া আর নিজের সমগ্র জীবন তাঁর বন্দেগীতে ব্যায় করা৷
যেহেতু আমি কোরআনের ছাত্র, তাই কোরআনেরই বিশেষ বিশেষ কিছু আয়াতের মাধ্যমেই আমার বক্তব্য প্রদান করব৷ যদি আয়াত সম্পর্কে আপনাদের কিছু মাত্র জ্ঞান থেকে থাকে আর তা সামনে থাকে, তবে আমার বক্তব্যের সাথে মিলিয়ে হৃদয়ঙ্গম করা সহজ হবে৷ (এই লক্ষ্যেই আপনাদের মাঝে লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে৷) শুরুতেই বলে রাখি যে, কোরআনে এমন কোন সুরা নেই যেখানে তৌহীদের কোন কথা নেই৷ আর এমন কোন সুরাও নেই যেখানে আখেরাত ও কেয়ামতের কোন কথা নেই৷ বলা বাহুল্য যে এ দুটি বিষয়ই বান্দাকে অনুপ্রানিত করে সেই লক্ষ্যে যেখানে ইসলাম মানুষকে নিতে চায়৷
বিষয়টি বিশেষ করে মক্কী সুরাগুলিতে বিস্তারিত ভাবে আলোচিত হয়েছে; সেখান থেকে আমি চারটি সুরা উপস্থাপন করব, যা আমার কাছে ‘তৌহীদে আমলীর’আলোচনায় শীর্ষে অবস্থানকারী মনে হয়েছে৷ সুরা ‘যুমার, সুরা ‘মু’মিন’, সুরা ‘হা মিম সাজদাহ’ ও সুরা ‘শুরা৷ আমি সুরা ‘যুমার’ ও সুরা শুরা থেকে কিছু আয়াত কোট করেছি, যাতে করে প্রমান হবে যে, তা ব্যাক্তি পর্যায়ের কোন্ স্তর বয়ান করে৷
১/تَنزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ
অর্থ;-কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে পরাক্রমশালী পজ্ঞাময় আল্লাহ তরফ থেকে৷
২/إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَّهُ الدِّينَ
অর্থ;-আমি আপনার প্রতি কিতাব যথার্থ রূপেই অবতীর্ণ করেছি, অতএব, আপনি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন৷
কিতাব নাজিল হয়েছে এমন আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি মহা পরাক্রমশালী ও মহা প্রজ্ঞাময়৷ এটি হক বা উচিৎ মতই নাজিল করা হয়েছে৷ অতএব, আপনি পূর্ণ আনুগত্যের সাথে ইবাদত করুন৷ আনুগত্য যেন আংশিক না হয়৷ অর্থাৎ কোন ক্ষেত্রে অনুগত হলাম আর কোন ক্ষেত্রে হলাম না এমনটি না হয়৷ পরের আয়াতের শুরুতে বলা হয়েছে, জেনে রাখ, আল্লাহর চাই ‘খালিস’বা নিঃস্বার্থ ইতায়াত৷ ১১-১৫ আয়াতেও এ বিষয়েরই পুণরাবৃত্তি লক্ষ্য করা যায়৷ ওয়াহেদ সীগা বা এক বচনে রসুল সঃ কে খেতাব করা হলেও আসলে তা সমস্ত নও মুসলীমদের তথা সমগ্র মুসলীম উম্মার জন্যই প্রযোজ্য৷ মাদানী সুরায় থাকলেও প্রাথমিক মক্কী সুরায় কোথাও ‘ইয়া আইয়ুহাল্লাজিনা আমানু’ নেই৷ প্রধানতঃ রসুল সঃ কেই খেতাব করা হয়েছে৷ বলা হয়েছে;-‘ক্বুল ইন্নি উমিরতু আন আ’বুদাল্লাহা মুলিসীনা লাহুদ্বীন’৷-বলুন, আমিতো আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি, পূর্ণ আনুগত্যের সাথে আল্লাহ ইবাদত করার৷ আনুগত্যের মাঝেও একত্বের কথা এসেছে৷-উমিরতু লে আন আকুনা আউয়ালাল মুসলিমীন,- আমি আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি যেন আমিই হই প্রথম আনুগত্যকারী৷
১৩/قُلْ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
অর্থ;-বলুন, যদি আমি আমার রবের অবাধ্য হই, আমি অবশ্যই ভয় করি মহাদিবসের শাস্তির৷
এখানে লক্ষ্যনীয় যে, স্বয়ং আল্লাহর রসুলের জন্য ও আনুগত্যের আদেশ দেওয়া হয়েছে, অন্যথায় আখেরাতে ক্ষতীর মাঝে পড়ার আশংকা তাঁরও রয়েছে৷ আদেশ নবী ও তাঁর উম্মতের জন্য সমান প্রযোজ্য৷
১৪/قُلِ اللَّهَ أَعْبُدُ مُخْلِصًا لَّهُ دِينِي
অর্থ;-বলুন, আমি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ তায়ালারই ইবাদত করি৷ (আবারও ‘মুখলাস’ শব্দটি ব্যবহার করে পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল৷)
১৫/فَاعْبُدُوا مَا شِئْتُم مِّن دُونِهِ قُلْ إِنَّ الْخَاسِرِينَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنفُسَهُمْ وَأَهْلِيهِمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَلَا ذَلِكَ هُوَ الْخُسْرَانُ الْمُبِينُ
অর্থ;-অতএব, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার ইচ্ছা ইবাদত কর৷ বলুন, কেয়ামতের দিন তারাই বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হবে যারা নিজেদের ও পরিবার বর্গের তরফ থেকে ক্ষতিগ্রস্থ হবে৷ সাবধান হও, এটাই সস্পষ্ট ক্ষতি৷
এর পরও যদি তোমরা সাবধান না হও তবে যাও, যার খুশী যেমন খুশী ইবাদত কর৷ সে স্বাধীনতা তোমাদের আছে৷ তবে সাথে সাথে এটাও জেনে রাখ কেয়ামতের দিন নিজেরা এবং তোমাদের পরিবার বর্গ সকলেই ক্ষতিগ্রস্থ হবে৷ সুরা ‘যুমারে’ আবারও বলা হয়েছে;
৬৪/قُلْ أَفَغَيْرَ اللَّهِ تَأْمُرُونِّي أَعْبُدُ أَيُّهَا الْجَاهِلُونَ
অর্থ;-বলুন, হে মূর্খরা তোমরা কি আমাকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের ইবাদত করতে আদেশ করছ!
৬৫/وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
অর্থ;-আর আপনার প্রতি ও আপনার পূর্ববরতীদের প্রতি প্রত্যাদেশ দেওয়াই হয়েছে যে, যদি আল্লাহর শরিক স্থির করেন, তবে আপনার কর্ম নিষ্ফল হবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্থদের একজন হবেন৷
এখানেও ইবাদতে অংশীদারিত্বকে নাকচ করা হয়েছে যা তৌহীদেরই নামান্তর৷ সাথে সাথে তার কূফলও বলে দেওয়া হয়েছে৷ অতএব,-
৬৬/بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِينَ
অর্থ;-বরং আল্লাহরই ইবাদত করুন ও কৃতজ্ঞদের অন্তরর্ভূক্ত থাকুন৷
অতএব, বন্ধুগন কোরআনের সাথে যাদের সম্পর্ক ও আস্থা আছে, যা মুসলীম হিসেবে অবশ্যই থাকা উচিৎ, আসুন চিন্তা ভাবনা করে দেখি আমাদের ইবাদতে ইখলাস ও ইতায়াত আছে কিনা এবং তা পূর্ণাঙ্গ কিনা৷ যদি না থাকে বা আংশিক হয়্ তবে সেই ইবাদত মূল্যহীন, পণ্ডশ্রম মাত্র৷
‘রহ গেয়ী রসমে আজাঁ রূহে বিলালী না রহী, ফালসাফা রহ গিয়া তালকীনে গাজ্জালী না রহী’ আজান যথারীতি বিলালী (রাঃ) নিয়মে আজও চালু আছে কিন্তু দুঃখের বিষয় তাতে বিলালের মত আন্তরিকতা নেই৷ ফিলোসফী আজও আছে কিন্তু গাজ্জালীর রঃ মত অনুসন্ধানী দৃষ্টি নেই৷ আমাদের বর্তমান ইবাদত কয়েকটি আচার আচরণে শুধু সীমাবদ্ধই নয় বরং বদ্ধমূল ধারণায় স্থায়ী হয়ে পড়েছে৷ যাতে না আছে আনুগত্য আর না আছে তাতে মোহব্বত৷ আর তা আমাদের জীবন জীবিকা, সমাজ ও অর্থনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ আজ তিরিশ লাখ মুসলীম আরাফাতের মাঠে হাত তুলে দোওয়া করে, সে দোওয়ার কোন প্রতিক্রীয়া নেই৷ যে দেশ থেকে বছরে চল্লিশ হাজার লোক হজ্জ করে, দশ বছরে সে দেশের অবস্থা যেমন হওয়া উচিৎ তা হয়না৷ কারণ একটাই আমাদের সকল ইবাদত জীবন থেকে আলাদা হয়ে গেছে, তা হোকনা ব্যাক্তি জীবন বা সামাজীক জীবন৷ নামাজ রোজা জাকাত প্রভৃতি সার্বক্ষনীক আনুগত্যের জন্য নিজেকে তৈরী করার উপাদান মাত্র৷ এজন্যই নামাজ কায়েম করতে বলা হয়েছে৷ যদি তা খাড়া না থাকে তবে তাকে খাড়া কর, আর যদি খাড়া থেকে থাকে, তাকে বজায় রাখ৷ আর রোজা হল ক্ষুধা থেকে নিজেকে সংযত রাখার প্রশিক্ষন, যাতে হালাল হারাম বিবেচনা না করে হামলে না পড়৷ আর জাকাত খয়রাত হল সম্পদের মহব্বত থেকে অন্তরকে সরিয়ে আনা৷ আর রোজা অবস্থায় সূদ ঘূষ ও মিথ্যা কথনের মাঝে ডুবে থাকা; রসুল সঃ সে রোজাকে শুধুই ক্ষুধা তৃষ্ণায় কষ্ট ভোগ করাই বলেছেন৷
আশার কথা বিভিন্ন ওলামাগনের নসিহত, তাবলীগ, ওয়াজ ও কোরআন হাদীশের জ্ঞান সহজলভ্য হওয়ায় মানুষের মাঝে ব্যপক সাড়া ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ একদিন মানুষ সত্যই বুঝবে যে ‘জীন্দেগী আমদ বরায়ে বন্দেগী, জীন্দেগী বে বন্দেগী শরমেন্দেগী’- জীবন এসেছে শুধুই ইবাদতের জন্য, ইবাদত বিহীন জীবন হল লজ্জ্বার৷ মানুষের মাঝে যারাই এ ধারণার বীজ বপন করেছেন, তাদের অনেককেই আমরা চিনিনা৷ চেনাদের মধ্যে দুজন বিশেষ ব্যাক্তি হলেন, আল্লমা ইকবাল ও জনাব মৌলানা মওদূদী৷
অনেক ইতায়াতী ইবাদত বুঝলেও কমতি রয়ে গেছে যা তা হল মুহব্বত বা আন্তরিকতা৷ উদারণ হিসেবে বলা যায় ভারতবাসী ইংরেজের ইতায়াত বা আনুগত্য অবশ্যই করত, কিন্তু সে আনুগত্যে ছিল বাধ্য বাধকতা৷ সেখানে মুহব্বত ছিলনা৷ মদীনার মুনাফেক গন রসুলের অনুগত ছিল, তাও ছিল মুহব্বত বিহীন আর তারা ছিল বাধ্য৷
ইমাম হাফিজ ইবনে কাইইম ইবাদতের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে-‘আল ইবাদাতো তাজমাউ আসনাইনে, আল গায়াতিল হুব্বে মা’য়া গায়াতিজজুল্লে ওয়াল খুজু৷’--প্রতি স্তরে মুহব্বত ও বিনয়ের সাথে নত হওয়াই ইবাদত৷ যেমন আমার শরীর, যার ওজন আছে ও দেখা যায়৷ কিন্তু আমার ভিতরে যে জীবন আছে তা দেখা যায়না আর ওজনও নেই৷ অথচ সেই ওজন বিহীন অদৃশ্য জানটিই আমার শরীরের প্রধান৷ জান বিহীন শরীর পরিত্যাজ্য৷ ঠিক তেমনই ইতায়াত সহ ইবাদত দেখা যায় কিন্তু তার জান মুহব্বত কে দেখা যায়না৷ মুহব্বত বিহীন ইবাদতও পরিত্যাজ্য৷
এখন আসি তৌহীদ ফিল ইতায়াতে৷ যার প্রধান অংশ হল ‘মুখলেসান লাহুদ্বীন’৷ মাতা পিতা, ওস্তাদ, অফিস বস, শাসক প্রভৃতি কারোরই ইতায়াতে বাধা নেই৷ তবে সে আনুগত্য কখনই আল্লাহর আল্লাহর আনুগত্যের সমান বা উচ্চতর হবে না৷ যদি হয় তবে হবে ‘শির্ক ফিল ইতায়াত’৷ রসুল সঃ বলেছেন; ‘লা তায়াতা লে মাখলুকীনা ফি মাশিয়াতিল খালেক৷’ সবার আগে আনুগত্যের দাবী নিয়ে যা সামনে আসে তা হল নিজের নফ্স৷ রুমী বলেছেন. ‘নফ্সে মা হাম কমতরাস্ত ফেরাউন নিস্ত, লেকীন উঁরা আওন ইঁরা আওন নিস্ত৷-আমার নফ্সও ফেরাউনের চাইতে কম নয়৷ ফেরাউনের ছিল সাহায্যকারী (বাহিনী) আমার নেই৷ কে মুসা হারুণ (আঃ) কে আল্লাহ তাদিয়ে তার প্রয়োজন ছিলনা, বলত, মিশর আমার, এখানে আমার হুকুমই সব৷ আমার নফ্সও বলে, হারাম হালাল ন্যায় অন্যায় বুঝিনা, আমার চাহিদা পুরণ হওয়া চাই৷ যখনই মানুস নফ্সের অনুগত হল, যেন সে আপন নফ্সকে আল্লাহ উপরে স্থান দিল৷ কোরআনের দু জায়গায় আল্লাহ এ বিষয়ে সতর্কবাণী দিয়েছেন, ‘আরাআইতা মানিত্তাখাজা ইলাহাহু হাওয়াহু, আ ফাআনতা তাকুনু আলাইহে ওয়াকীলা?’- আপনিকি তাদের দেখেছেন, যারা নিজের নফ্সকে মাবুদ বানিয়েছে! আপনিকি তাদের দায়িত্ব নেবেন? লক্ষ্যনীয় এখানে নফ্সকে ‘ইলাহ’ বা মাবুদ বলা হয়েছে৷ এটিও শির্ক ফিল ইতায়াত৷
তেমনই মুহব্বতেও বাধা নেই, বরং আল্লাহ তা সকলের অন্তরে দিয়ে দিয়েছেন৷ কিন্ত কোন অবস্থাতেই তা আল্লাহর সাথে মুহব্বতের সম পর্যায়ের কিংবা উচ্চতর হবেনা৷ আর যদি হয় তবে তা শির্ক ফিল মুহব্বত হয়ে যাবে৷ এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী হল সম্পদের লালসা৷ আর এ বিষয়ে মুশরীক হিন্দুদের সাথে তফাৎ শুধুই লক্ষ্মীর প্রতিমা৷ হিন্দুরা লক্ষ্মী পূঁজা করে ঐ প্রতিমার নয় বরং অর্থ সম্পদের৷ সামনে রাখে প্রতিমা৷ আমরাও অর্থ সম্পদের লালসার পূঁজা করি প্রতিমা বিহীন৷ রসুল সঃ বলেছেন, ‘তায়েশা আব্দুদদীনার ওয়া আব্দুদদিরহাম’৷ দীনার ও দিরহামের বান্দা ধ্বংস হয়েছে বা হবে৷(মাজীর সীগা দু অর্থে ব্যবহার হয়৷) নাম আব্দুর রহমান হলেও তার ধ্যান ধারণায় জেঁকে বসেছে দীনার আর দিরহাম৷ সুরা তওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন;-
২৪/قُلْ إِن كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَآؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُم مِّنَ اللّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُواْ حَتَّى يَأْتِيَ اللّهُ بِأَمْرِهِ وَاللّهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ
অর্থাৎ;-আপনি বলেদিন, তোমাদের কাছে যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের জোড়া (spouse), তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যার মন্দা পড়ার ভয় কর, এবং তোমাদের পছন্দের বাস গৃহ, আল্লাহ, তার রসুল, এবং তার পথে জিহাদ করার চেয়ে অধিক প্রীয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর নির্দেশ আসা পর্যন্ত৷ আল্লাহ ফাসেক লোকদের পছন্দ করেন না৷
অত্যন্ত কঠোর নির্দেশ৷ যার হৃদয় না কেঁপে উঠবে তার প্রকৃত মুমিন হওয়া সুদূর পরাহত৷ একদিকে মুমিনের পার্থিব দুনিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আটটি জিনিষ, যথা;- আপন পিতা, সন্তান, ভাই, স্বামী বা স্ত্রী, বংশ, যে অর্থ সম্পদ তীলে তীলে অর্জন করে সঞ্চয় করা হয়েছে, যে ব্যবসা কে শূন্য হতে মেধা পরিশ্রম দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, প্রতি পদে যাতে লোকসানের ঝুঁকির আশংকা রয়েছে৷ সুরম্য প্রাসাদ, যা ঘাম ঝরানো কামাই দিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে, একদিকে এই গুলি আর অন্য দিকে মাত্র তিনটি জিনিষ, যথা;- আল্লাহ ও তার রসুল এবং আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম৷ এ তিনটির মোকাবেলায় পার্থিব আটটির কোনটি যদি প্রীয়তর হয়ে যায়, তবে ইমানের দাবীদার মুমিন ওয়েটিং লিষ্টে অপেক্ষা করতে থাক, আল্লাহর পরবর্তী নির্দেশের জন্য৷ তার পরেই বলা হয়েছে, আল্লাহ ফাসেকদের পছন্দ করেণ না৷ পারত পক্ষে তাদের ফাসেকই বলা হল। এতো গেল নেতি বাচক উদাহরণের আয়াত৷ এখন দেখা যাক ইতিবাচক আয়াতে কি বলা হয়েছে৷ সুরা বাক্বারার ১৬৫ আয়াতে এরশাদ হয়েছে;-
১৬৫/وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللّهِ أَندَاداً يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللّهِ وَالَّذِينَ آمَنُواْ أَشَدُّ حُبًّا لِّلّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُواْ إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلّهِ جَمِيعاً وَأَنَّ اللّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ
অর্থাৎ;-আর মানুষের মাঝে এমন লোকও রয়েছে যারা, অন্যান্নকে আল্লার সমকক্ষ্য সাব্যস্ত করে, এবং তাদের প্রতি এমন ভালবাসা পোষন করে, যেমন আল্লাকে দেখানো উচিত, আর যারা প্রকৃত ঈমান এনেছে, আল্লার প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তম, আর যদি জালিমরা প্রত্যক্ষ করত, দেখতে পেত যাবতীয় ক্ষমতা শুধু মাত্র আল্লাহ তায়ালার, এবং আল্লার শাস্তিই সর্বাপেক্ষা কঠিনতর।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া রঃ মানুষের লক্ষ্য বস্তুর জন্য ‘মতলুব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন৷ প্রত্যেকেরই জীবনে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তু থাকে, যাকে কেন্দ্র করেই তার দৌড়-ঝাঁপ, প্রচেষ্টা, ধ্যান-ধারণা গড়ে ওঠে৷ এটিই তার ‘মতলুব’ এটিই গন্তব্য৷ এরই আবর্তে গড়ে ওঠে সম্পদ প্রেম, জাতী প্রেম, দেশ প্রেম, ক্ষমতা প্রেম প্রভৃতি৷ সৃষ্টী হিসেবে মানুষের আসল প্রেম স্রষ্টার প্রেম বা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রেম, যার মাঝেই রয়েছে প্রকৃত সফলতা৷ কিন্তু অন্য সকল প্রেমকে অতিক্রম করা মোটেও সহজ নয়৷ তারাই পারে যাদের মনোবল দৃঢ়৷ যেমন পেরেছিলেন আল্লামা ইকবাল৷
মাতৃ ভূমীর জয়, দেশের পতাকায় সালাম দেশ প্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ৷ এখানেও দেশকেই অন্যান্ন বিষয়ের উপর প্রাধান্য দেওয়াই লক্ষ্য৷ অতএব শির্ক ফিত্তৌহীদ৷
ডঃ রফিউদ্দীন সাহেব লিখেছেন যে, মানুষ কোন না কোন বিষয়কে ভালবাসতে বাধ্য হয়৷ এবং তার জন্যই সে বড় থেকে বড় ত্যাগ এমনকি আপন জীবন দিতেও প্রস্তুত হয়ে যায়৷ সর্বাপেক্ষা প্রীয় জিনিষ হল নিজ জীবন৷ কল্পনা করুন সেই জাপানীদের কথা, যারা জানতো জাহাজের চিমনীর ভিতরে যাওয়া মাত্রই তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তার পর ধ্বংস হবে জাহাজ৷ চিন্তা করুন সেই আত্মঘাতী বোমাবাজদের কথা৷ তাদের পিছনে রয়েছে এমনই কোন প্রেম, যার জন্য তার এই আত্মাহুতি৷ এদের কাছে এই প্রেমের আধারটিই ‘মতলুব’৷ সুরা হজ্জের শেষ আয়াতে বলা হয়েছে;- ‘কাইফাত্তালেবু ওয়াল মতলুব’, যারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছুকে ‘মতলুব’ বানালো, সেই মতলুব যেমন হতভাগা তারা তার চাইতে আরও বড় হতভাগা৷
সুফী সমাজের মাঝে প্রচলিত আছে সাধারণ্যে যা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ,’ কিংবা ‘লা মাবুদা ইল্লাল্লাহ’৷ এটির উচ্চতর স্তরে গিয়ে হয়, ‘লা মাকসুদা ইল্লাল্লাহ’ ‘লা মাহবুবা ইল্লাল্লাহ’৷ যদি এ মনোভাব ধ্যান ধারণায় আসন গেড়ে থাকে তবে এটিই হল সেই তৌহীদে আমলীর স্তর৷ অতএব, সকল মাতলুবের শ্রেষ্ঠ মাতলুব আল্লাহ তায়ালা হওয়াই বাঞ্ছনীয়৷ বিষয়টি মোটেও সহজ নয় কারণ আপন নফ্সের উপর প্রভুত্য করা বড়ই কঠিন৷ শেখ সাদী রঃ বলেছেন, ‘কারিমা ব বখশায়ে বর হালেমা, কে হাশ্তুম আসীরে কামান্দে হাওয়া’,হে দয়াল আমার প্রতি দয়া কর কেননা আমি আমার নফ্সের চাহিদার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছি৷ ‘তৌহীদে আমলী’র ব্যাক্তি পর্যায়ের আলোচনা এখানে শেষ করতে চাই৷ খাঁটি মুসলীম বা আল্লাহর প্রকৃত বান্দা হতে হলে সর্বক্ষন সর্বাবস্থায় তাঁর যাবতীয় আদেশ নিষেধের প্রতি আনুগত্যের বিকল্প নেই৷
চলবে-----
বিষয়: বিবিধ
১৬১৫ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আজ আমরা দুনিয়ার পেছনে পড়ে সত্যিই আখিরাত বিমুখ হয়ে গেছি। আল্লাহ আমাদের হেদায়েত দান করুন।
জাযাকাল্লাহ খাইর
সুন্দর পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
তওহিদ বুঝতেই আমরা এখন সবচেয়ে বেশি ভুল করি।
সূরা তোওবার আয়াতটি পড়লে বরাবর অনেক ভয় কাজ করে! আল্লাহ আমাদের হিফাজত করুণ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন