উম্মাহর কাছে দাওয়াত পৌঁছাতে আমাদের ব্যর্থতা ও তাবলীগের প্রতি ভালোবাসা
লিখেছেন লিখেছেন মাই নেম ইজ খান ০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৫:০৫:১৮ বিকাল
টানা প্রায় ১২ দিন কাটিয়ে অবশেষে গতকাল টঙ্গী ইজতেমা থেকে আসলাম। আমি যখন ফিরে আসছিলাম তখন লাখো লাখো মানুষ ছুটছিলো আমার বিপরীতে। অর্থাৎ আর কিছুক্ষণ পরই অনুষ্ঠিতব্য (ইজতেমা দ্বিতীয় পর্বের) আখেরী মোনাজাতে শরীক হওয়ার জন্য তুরাগ তীরের দিকে এখন গণমানুষের এক তীব্র স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকা ও গাজীপুরের আশ-পাশের লাখো লাখো মানুষ একত্রিত হচ্ছে টঙ্গী ইজতেমার আশে পাশে। সকলেই চেষ্টা করছে যতোটা কাছে যাওয়া যায়। যতটা নিকটে থেকে আখেরী মুনাজাতে শরীক হওয়া যায়!
উঁচু-নীচু পথ, বেরিবাঁধ, কিংবা পিচঢালা রাজপথের কোথাও কোনো ফাকা নেই। মানুষ যে কিভাবে যাচ্ছে টঙ্গী ইজতেমার দিকে, তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কাউকে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। যদিও এ নিয়েও অনলাইনে অফলাইনে পক্ষে বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা আছে, থাকবে। তাবলীগ, ইজতেমা, আখেরি মোনাজাত, ফাজায়েলে আমল ইত্যাদি বিষয়ে আহলে হাদীস ও সালাফী ভাইদের ঠিক তেমনই জোরদার বিরোধীতা চলছে যেমন তাদের জোড়ালো বিরোধীতা করে থাকেন নির্দিষ্ট মাযহাবের ইজতিহাদকে গ্রহণ করে ইসলামের উপর চলা এই উপমহাদেশের ধর্মপ্রাণ বিশেষত: হানাফী মাযহাবের অনুসারী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারীগণ। (অবশ্য সবাই-ই নিজেদেরকেই সবচাইতে বেশি আহলে সুন্নাত হওয়ার দাবী করে থাকেন। আর তাই যেনো হয়। কারণ কাউকে আহলে সুন্নাত থেকে খারিজ করলে আমার যেমন এক্সট্রা কোনো বোনাস নেই একইভাবে তাওহীদে বিশ্বাসী সকল মুমিন মুসলিম যদি নাজাত পেয়ে যায় তবুও আমার ভাগে মহান রবের অনুগ্রহ কম শট পরা বা কম হওয়ারও যেহেতু কোনো সম্ভাবনা নেই...)
ইসলামের মূল শেকড়ের প্রতি নিজেদের জ্ঞাত বা অজ্ঞাত নাড়ীর টান অনুভবকারী আমার আপামর মুসলিম জনতার যে ব্যকূল আগ্রহ আর উৎসাহ তার কথা কল্পনা করে আবেগে আপ্লুত হচ্ছিলাম। পথের দু'ধার দিয়ে তীর-তীব্রবেগে ধাবমান জনতা বিশেষত: যুব-তরুণদের স্বতস্ফূর্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে চমকিত হচ্ছিলাম, তাদের একে অপরের সাথে বাহ্যিকভাবে অনেক ব্যবধান মনে হলেও আসলে তারা সকলেই তো আন্তরিকভাবে এক ও অদ্বিতীয় মহান আল্লাহকেই সন্তুষ্ট করতে চাইছে। সেই মহান রব্বে কায়েনাতের আন্তরিক সন্তুষ্টির জন্যই তারা মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে যাচ্ছে ইজতেমায়। একইভাবে কখনও তারা হয়তো ভন্ডপীর আটরশির দরবারেও গিয়ে হাজির হয়। আবার এই জনতার অধিকাংশই কিন্তু একইভাবে শামিল হয়েছিলো হেফাজতের লংমার্চ ও অবরোধ কর্মসূচীতেও।
এর কারণ প্রতিটি মানুষের জিন তথা ডিএনএর ভেতরে ইনপুট করে দেয়া সেই ডাটা, যা প্রতিটি মাখলুককে তার স্রষ্টার সামনে ইচ্ছাই হোক বা অনিচ্ছায় হোক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করে। মানুষ সব সময়ই তার চাইতে অধিক শক্তিমান ও প্রভাবশালীর আনুগত্য করে থাকে। কিন্তু দৃশ্যমান প্রভাবশালীর চাইতেও অদৃশ্যমান শক্তি তথা সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার অধিকারী মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি তারা সব সময়ই সমর্পিত। কেউ হয়তো এটি বুঝতে পারে বাকি কেউ বুঝতে পারে না। কেউ হয়তো এটি প্রকাশ করে, বাকি কেউ করতে পারে না বা করতে চায় না। -এই হচ্ছে ব্যবধান।
এটা তো সমগ্র মানবজাতির কথা। শক্তিমানের আনুগত্যের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্যদের চাইতে আমাদের দেশের বিশেষত: আমাদের এই ভারত উপমহাদেশের মানুষের অবস্থা একটু বেশিই অবনত। হিন্দুদের মাঝে এমনিতেই তেত্রিশ কোটি দেবতা আসন গাঢ়তে পারে নি। তাদের প্রত্যেকের মধ্যে অবস্থিত মহান শক্তিশালীর আরাধনা ইবাদতের প্রবৃত্তিগত তাড়নাই তাদেরকে তাদের চাইতে যে কোনো শক্তিমানের সামনে অবনত হতে অনুপ্রাণিত করে থাকে। চাই তা কোনো একটি হাতি হোক বা বড় বটগাছ। শাপ হোক বা বলার অযোগ্য পুরুষাঙ্গ। কি এমন নেই হিন্দুরা যার পূঁজো করে না?
কিন্তু কেন?
কারণ আসলে তারা তাদের ডিএনএর এর কোড অনুসরণ করে তার চাইতে শক্তিমান প্রকৃত রবের ইবাদত করতে চায়। (মানব প্রবৃত্তির আবশ্যকীয় এই ধর্মীয় চাহিদার বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণেই মূলত: কম্যুনিজমমের পতন হয়েছিলো।) কিন্তু না জানা কিংবা না বুঝা, অথবা কারো প্ররোচনা বা বাধ্য করা কিংবা জেনে বুঝেও স্বার্থের মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে যাওয়ায় একটা পর্যায়ে হয়তো আর অনেকেই এই দূর্বল খোদার উপাসনা থেকে আর বের হতে পারে না। -সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যা বলছিলাম। এই দেশ ও এর অধিবাসী গণমানুষের অন্তরে ইসলামের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসা, আকাংখা আর টান যে কতো তীব্র তা মাটি মানুষের একেবারে কাছে না গেলো বোঝা যাবে না। এসির আরাম কেদারায় বসে গরম গরম বক্তৃতা বা খুব সহজেই তাত্ত্বিক আলোচনা ঝাড়া সম্ভব হলেও এই লাখো-কোটি মেহনতি মুসলিম জনতার হৃদয়ের ডাক শুনতে হলে অবশ্যই অবশ্যই তাদের কাছে যেতে হবে। তাদের মাঝে তাওহীদ ও ঈমান-আমলের সত্যিকার মেহনত আসলেই খুব কম হয়েছে। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপট এবং ভারত উপমহাদেশ বিজয়ের প্রাথমিক ও পরবর্তী অবস্থা এর জ্বলন্ত প্রমাণ। মুহাম্মাদ বিন কাসিম রহ. এর সিন্ধু বিজয়ের অল্পসময় পরেই তৎকালীন শাসকের আত্মঘাতি সিদ্ধান্তে তার ফিরে যেতে বাধ্য হওয়া এবং নতুন বিজয় হওয়া এই অঞ্চলে ইসলামের সঠিক আদর্শের অনুপ্রবেশ ও প্রচার বলতে গেলে তখন থেকেই ভাটা পরেছিলো। এর আগে পরে কিছু কিছু পীর ও মুজাহিদ আউলিয়া যেমন শাহ পরাণ ও শাহ জালাল ইয়ামানী রহ. শাহ আলী বাগদাদী রহ. সহ এই বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিখ্যাত মুসলিম মণীষীদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত ব্যক্তিগত পর্যায়ে যতটুকু হয়েছে বাস্তবিক চাহিদা ছিলো তার চাইতে অনেক বেশি। উপরন্তু পার্শ্ববর্তী হিন্দুদের শিরকী বিভিন্ন আচরণ থেকে ইসলামের সকল বিষয়াবলীকে পৃথক করার জন্য যেই পরিমাণ দাওয়াত এখানে হওয়া দরকার ছিলো এবং যেই পরিমাণ দায়ী আবশ্যক ছিলো তার প্রায় কিছুই হয়নি সেই তখন থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত।
এই অঞ্চলের আজকের আপামর মুসলিমগণ ইসলাম সম্পর্কে যতটুকু জানেন আমরা জানা মতে তারা আমল করার চেষ্টা করেন। যদিও আদতে তাদের জানা এবং বাস্তবিক বিষয়ের মাঝে ব্যবধান অনেক। তারা হয়তো আপনার মতো একেবারে পূর্ণাঙ্গ মুওয়াহ্হিদ হিসেবে 'সহীহ শুদ্ধভাবে' আমল করতে পারছে না, তাদের আচার-আচরণ বা ধর্মীয় অনেক ইবাদতের মাঝেই হয়তো আপনি কেবল বিদআত আর শিরকের ছড়াছড়ি দেখছেন, কিন্তু একবারও এটি খেয়াল করছেন যে এই বিশাল জনগোষ্ঠির কাছে হকের কথা, সত্যের দাওয়াত এবং সহীহ বিষয়গুলো পৌঁছে দেয়ার জন্য আমরা নিজেরা কি করেছি? কতটুকু অবদান রেখেছি দাওয়াতের এই মহান ক্ষেত্রে?
আমরা কেবল একে অন্যের সমালোচনা করতেই সিদ্ধহস্ত। কিন্তু আমরা কি কেউ কখনো একটিবারের জন্যও তাদের সামনে কালিমার নু্ন্যতম শব্দগুলো তুলে ধরার চেষ্টাও কি করেছি? নামাজ, রোযা, ইবাদত ইত্যাদির বেসিক নলেজ গুলো অনগ্রসর জনতার কাছে পৌঁছাবার ক্ষেত্রে আমার অবদানই বা কি?
আমাদের সকলের একটি কথা মনে রাখা দরকার যে নেগেটিভ দাওয়া খুবই সহজ। যে কোনো ভালো বা যে কোনো বড় আলেম, নেতা, ইসলামি ব্যক্তিত্ব বা সংগঠনের ব্যাপারে কয়েকদিন ঘাটাঘাটি করলেই তাদের ব্যাপারে সমালোচনা-পর্যালোচনার জন্য বিশাল বিশাল দলীল দস্তাবেজ প্রস্তুত করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু সম্ভব নয় সেই সকল সমালোচিত মানুষ গুলোর মতো মাঠে-ময়দানে নেমে এসে আপামর মানুষের কাছে দ্বীনী বিষয় গুলো পৌঁছে দেয়া। (অবশ্য ব্যতিক্রম যে একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়)
তবে আমি আনমনে ভাবছিলাম কেবল আমার কথা।
আমার পরিচিত মুসলিম ভাইদের কথা। যারা দ্বীন সম্পর্কে নূন্যতম কিছু ধারণা পেয়েছি তারা নিজেরাই বা এর কতটুকু অন্যের কাছে পৌঁছাবার চেষ্টা করেছি?
আমরা একে অন্যের শুধু বিরোধীতা না করে আমরা কি পারি না একে অপরের ভালো ভালো বিষয় গুলোকে সাদরে গ্রহণ করে নিতে? একে অপরের ভালো অর্জন গুলোকে স্বাগতম জানাতে?
রাসূল সা. তো বলেছিলেন,
عن أنس - رضي الله عنه - قال: قال رسول الله - صلى الله عليه وسلم -: ((يسِّروا ولا تعسِّروا، وبشِّروا ولا تنفِّروا))؛ متفق عليه
(হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত) তোমরা মানুষের জন্য সহজ বিষয় ও সহজবোধ্য ভালো দিক গুলোকে তাদের সামনে বেশি বেশি তুলে ধরো। তোমরা মানুষকে বেশি বেশি সুসংবাদ দাও, (পজেটিভ দাওয়ার প্রসার ঘটাও) তোমরা মানুষকে অহেতুক হতাশ করা এবং তাদেরকে কেবল বেশি বেশি ভয় দেখানো বন্ধ করো।" (বুখারী ও মুসলিম।)
এই হাদিসে রাসূল সা. যা বলেছিলেন, আমরা বর্তমানে করছি তার সম্পূর্ণ উল্টো। জানিনা কবে সেদিন আসবে, যখন আমরা আমাদের অপর মুসলিম ভাইদের ব্যাপারে কেবল তুলো-ধুনো সমালোচনার পরিবর্তে ভালো বিষয় ও পজেটিভ দিক গুলো নিয়ে বেশি স্বরব হবো। কবে নাগাদ আমরা আবারও এই অঞ্চলের মুসলিমদেরকে ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়গুলো আবারও সহজবোধ্যভাবে তাদের সামনে তুলে ধরতে পারবো।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে শীঘ্রই সেই তাওফিক দিন, আমীন।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৬ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মানুষকে ব্যাক্তিগতভাবে ইসলামের অনুসারি বানানোতে তাবলীগ জামায়াত এর অবদান কম নয়।
এক এক কারখানা এক এক পণ্য উৎপাদন করে। এক এক ট্রেনিং সেন্টার এক এক বিষয়ের উপর দক্ষ জনবল তৈরী করে। এগুলো আমরা সবাই জানি ও বুঝি। কিন্তু কেনো যেনো ইসলামী দল ও সংগঠনের প্রশ্ন আসলে আমরা সব কিছু একটি দলের মধ্যেই অপরিহার্য্য মনে করে অভিমান করে বসে থাকি!
মহান আল্লাহ আমাদেরকে শীঘ্রই সেই তাওফিক দিন ।
আল্লাহুম্মা আমীন ।
আন্তরিক ধন্যবাদ।
আমি কেন তাবলীগকে বিদয়াতী বলি নাই, এজন্যে আমাকে কৈফিয়ত দিতে হয়।
কট্টর হয়ে ইসলামের কতটুকু উপকার হয় বা হয়েছে তা অনেকেই মূল্যায়ন করতে চান না।
সেদিন ফেসবুকে একজন মুওয়াহহিদ ভাই আমি টঙ্গী ইজতেমায় ষ্টল নিয়ে যাচ্ছি শুনে আমাকেও বিদআতের কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন।
আমাদের এই মানসিকতা কবে যে পরিবর্তন হবে!
যখন আমরা আমাদের অপর মুসলিম ভাইদের ব্যাপারে কেবল তুলো-ধুনো সমালোচনার পরিবর্তে ভালো বিষয় ও পজেটিভ দিক গুলো নিয়ে বেশি স্বরব হবো। কবে নাগাদ আমরা আবারও এই অঞ্চলের মুসলিমদেরকে ইসলামের বুনিয়াদী বিষয়গুলো আবারও সহজবোধ্যভাবে তাদের সামনে তুলে ধরতে পারবো।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে শীঘ্রই সেই তাওফিক দিন, আমীন।
আাপনি ঠিক বলেছেন, বিখ্যাত মুসলিম মণীষীদের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত ব্যক্তিগত পর্যায়ে যতটুকু হয়েছে বাস্তবিক চাহিদা ছিলো তার চাইতে অনেক বেশি। " সিন্ধু বিজয়ের পরেই তৎকালীন শাসকের আত্মঘাতি সিদ্ধান্তে এই অঞ্চলে ইসলামের সঠিক আদর্শের প্রচার বলতে গেলে শরুই করা যাই নি ।
যাজ্জাকাল্লাহ খায়ের
ইসলামি শক্তির ঐক্যর পক্ষে আরও লেখা চাই।
আমরা যদি প্রত্যেকে তার অবস্থান থেকে উম্মাহর ঐক্যের জন্য সাধ্য মতো কাজ করি তাহলে কিন্তু এটি খুবই সম্ভব।
ইমাম সাহেব বলেছেন কোন খ্রীষ্টান বেহেশ্তে যাবেনা শুধু যিনি প্লেন আিষ্কার করেছেন তিনি ছাড়া৷ কারণ প্লেনে চড়ে হজে যাওয়া যায়৷ আমি হাজার বোঝালেও মুক্তাদীরা জানে ইমাম সাহেব যা বলেন তা কোরান হাদীশ থেকেই বলেন৷ আমাদের অবস্থা এটাই৷ বিষটি অবশ্যই গুরুত্বপপূর্ণ৷ ধন্যবাদ৷
আমার লেখাটি আবারও পড়ার অনুরোধ রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন