=======অকালে বিয়ে=======
লিখেছেন লিখেছেন পত্রিকার পাতা থেকে ০৫ অক্টোবর, ২০১৩, ১১:১১:৪১ সকাল
আমার মেয়েটা সেই সকালে খেয়ে যায় ফেরে সন্ধ্যায়, আমার কি ইচ্ছে হয়না মেয়েকে দশটা টাকা দিই গাড়ি ভাড়ার জন্য, পাঁচটা টাকা টিফিনের জন্য? মেয়েটা আধপেটা থাকে দিনের পর দিন, ছোট ভাইদের কথা ভেবে সে কিছুই বলে না; সে আমাকে মনে মনে বদদোয়া দেবে, পড়াশোনা লাগবে না আমার মেয়েটা পেট ভরে খেতে পারলে হবে।’
ক্লাস টেনে পড়ুয়া এক ছাত্রীর বিয়ে প্রায় ঠিক। ছোট ভাইয়ের কাছে প্রাইভেট পড়ে, সে সূত্রে পরিচয়ও আছে। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার কারণে তার জন্য ছিল বিশেষ দরদ। অতি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে; তার বাবা দিনমজুরি করত, ক’দিন আগে দু’চারটা এনজিওতে লোন নিয়ে বিদেশ গেছে। বর্তমানে তারও দুর্দশা চলছে, ফ্রি ভিসায় গিয়ে কাজ পাচ্ছে না, যখন-তখন ধরা খাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। মাসে ছাত্রীটির পরিবারের সাড়ে সাত হাজার টাকার কিস্তি, বাবা পাঠায় দশ হাজার টাকা। কিস্তি দিয়ে বাকি টাকায় চার ভাই-বোনের পড়াশোনা আর চালডাল নুনের খরচ। অত সব সবিস্তারে আপনাদের কেন যে শোনাতে হচ্ছে! ছাত্রীর নাম রুনা আক্তার, বয়স ষোল হল বলে। পড়াশোনায় যথেষ্ট সিরিয়াস, কদিন পর দেবে এসএসসি, পড়াশোনার খুব চাপ। পেটে দানাপানি না থাকলেও মুখের হাসি আমলিন। ছোট ভাই এসব আমাকে দুঃখ করে বলে, আমি তার দুঃখের সামান্যও নিবারণ করতে পারিনা।
বাবা মা রুনাকে নিয়ে খুব আশাবাদী ছিল, হঠাৎ বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে তাদের মাথায় চাপল কি করে। ভাইএর কড়া নির্দেশ তার ছাত্রীকে যেন সরাসরি এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা না হয়। আমি করিওনি। আমার মাকে অনুরোধ করলাম তার মাকে আমাদের ঘরে একটু ডেকে আনতে। মা ব্যবস্থা নেয়ার আগে দেখি তার মা এক বিকেলে হাজির। বললাম আপনার সালিশ হবে। রুনার মা কেন জানি আন্দাজ করতে পেরেছে বিচারের বিষয়। বেচারির দারিদ্র আর অসহায়ত্ব চোখে পড়ছিল চোখে-মুখে আর পোশাক-আশাকের অবস্থায়। খুব কঠিন করে প্রথমে হুমকি দিয়ে দিলাম ‘কম বয়সে বিয়ে দিলে কি শাস্তি জানেন? কদিন আগে এক ঘরের সবাইকে দড়ি বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল কেবল কম বয়সে মেয়ে বিয়ে দিতে চাওয়ার কারণে, আপনাকে যখন ওভাবে ধরে নিতে পুলিশ পাঠাব তখন কেউ বাঁচাতে পারবে না, দড়ি বেঁধে নিয়ে গেলে মান সম্মান থাকবে?’ কড়া কথা শুনে তার মায়ের চোখে পানি চলে এল, আমার মা বলল কঠিন কথা হলেও তোমার ভালর জন্য বলছে কিন্তু রুনার মা। মায়ের কথায় তার দুঃখের আগুনে যেন ঘি পড়ল, আমার দিকে না থাকিয়ে তিনি জবাব দিলেন - আমি কি সখ করে মেয়ের বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছি? আপনারা তো ভদ্র পাড়ায় থাকেন আমার অবস্থা তো বুঝবেননা, সারাটা দিন মানুষের কথা শুনতে হয় আমাকে, পেটে ভাত নাই আবার নাকি ঢং করে মেয়েকে পড়াচ্ছি, মাসে দশ পনেরটা বিয়ের প্রস্তাব আসছে, বাপ বিদেশে আছে বলে ওসব প্রস্তাব আসছে, বিদেশ থেকে ফেরত আসলে কি আমার মেয়ের ভাল ঘরে বিয়ে হবে? যে ঘরে দেব বলে চিন্তা করেছি তারা বলেছে মেয়েকে পড়াবে আর আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা দেবে, আর ছেলেটা ডিগ্রি পাস, ব্যবসা করে।
তার কথার মাঝ পথে বললাম ছেলে মোটেও শিক্ষিত নয়, সে নিশ্চিত মিথ্যে বলেছে। একজন শিক্ষিত ছেলে ক্লাস টেনের মেয়ে বিয়ে করতে চাইবেনা, আর পড়াশোনা করানোর কথা বলছেন? সেটা খুব সস্তা ডাহা মিথ্যে কথা। আপনার মেয়ে পড়াশোনায় ভাল, সেইতো আপনার দুঃখ মোছার হাতিয়ার, তার অবহেলা করলে আল্লাহ আপনাকে আর সুযোগ নাও দিতে পারে। মেয়েদের আজকাল কতো চাকরির সুযোগ, বিদ্যে থাকলে ঠেকাবার জন্য কিছুই দাঁড়াতে পারবে না। বিয়ে দিলে যে মেয়ে সুখে থাকবে তার নিশ্চয়তা কী? আপনাদের যে অবস্থা তাতে তাকে যদি অত্যাচার করা হয় আপনি তো বুক ফুলিয়ে বলতেও পারবেন না ঘরে চলে আসতে, কারণ আপনার তো সামর্থ্য নেই তাকে লালন পালন করার, তখন আপনার মেয়ের দুঃখ আপনি কি সইতে পারবেন? সার্টিফিকেট কিছু না থাকলে সে তো বানের জলে ভেসে যাবে।
আমার কথাগুলো তাকে যেন বশ করেছে। তিনি একদম অসহায়ের মত চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। আমার মা তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। তার জন্য খুব করুণা হচ্ছে। দারিদ্রের দুষ্টচক্রে তার হাত পা বাঁধা। প্রতি মাসে দোকানে বাকি পড়ে থাকে দুই তিন হাজার টাকা। ছেলেগুলোও হচ্ছে দিনে দিনে বেয়াড়া, ঘরে যে অভাব তার কথা মাথায় রাখে না। প্রতিবেশীদের নিত্যকার গঞ্জনায় বাধ্য হয়েছে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিতে।
তার কথায় আমি পাচ্ছি চিরকালীন দারিদ্র ক্লিষ্ট মানুষের স্বপ্ন পোড়ার ঘ্রাণ। উপদেশের পশরা সাজানো ছাড়া তার দুঃখ মোচনের আর কোন বৈষয়িক উপায় আমি দিতে পারিনা, নিরন্তর অপারগতার যন্ত্রণায় আমার বসত। তার অশ্রু জড়ানো কথাগুলো আমার কানে লাগছে - ‘এক বস্তা চালের দাম দুই হাজার টাকা, পুরা মাস সেটা দিয়ে চলে না, আড়াই হাজার টাকা হিসেবে পায় এক মাসের জন্য, এবার বলেন কয় টাকা আমার হাতে আর থাকে? আমার মেয়েটা সেই সকালে খেয়ে যায় ফেরে সন্ধ্যায়, আমার কি ইচ্ছে হয়না মেয়েকে দশটা টাকা দিই গাড়ি ভাড়ার জন্য পাঁচটা টাকা টিফিনের জন্য? মেয়েটা আধপেটা থাকে দিনের পর দিন, ছোট ভাইদের কথা ভেবে সে কিছুই বলে না; সে আমাকে মনে মনে বদদোয়া দেবে, পড়াশোনা লাগবে না আমার মেয়েটা পেট ভরে খেতে পারলে হবে।’ কথা শেষ করে তার মা উঠে চলে যেতে বসে, আমি কোন রকমে ঠেকিয়ে রাখি, বলি - তার সামনের দিনগুলোর পড়াশোনার খরচ আমি জোগাড় করে দেব তবু আপনি তার বিয়ে দিয়েন না , অত কষ্ট করে এত বছর সহ্য করতে পেরেছেন আর দুই তিনটা বছর সহ্য করতে পারবেন না? মেয়ে টিউশনি করতে পারবে, নিজের খরচ নিজে চালিয়ে আপনাকেও দিতে পারবে। কোন রকম কথা তিনি দিলেন না, এখন পর্যন্ত অবশ্য তার বিয়ে দেয়ার কোন আলামতও টের পাচ্ছি না।
রুনার মায়েদের দুঃখকে কাজে লাগিয়ে নিতে কত জন বসে থাকে, তারাও যেন ফাঁদে পড়ে যায় আর বাধ্য হয় স্বপ্ন পূরণের সিঁড়ির মাঝ পথে থেমে গিয়ে আবার পিছিয়ে যেতে। তাদের জন্য মুক্ত বাতাসের ব্যবস্থা করতে কোন দরাজা জানালা আমরা বসাইনা, যেন চাইছি তারা দুঃখের ভারে দম বন্ধ হয়ে মরে যাক।
কেবল আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা গেলে বা এমন - মৌলিক চাহিদাগুলোর অভাব পূরণের ব্যবস্থা করা গেলে, বিশেষ করে শিক্ষার ব্যাপারে সামান্যতম খরচকেও আটকানো গেলে রুনাদের বিকশিত হওয়া সহজতর হবে। লাখ টাকা যারা কথায় কথায় খরচ করতে পারে তাদের উদর কিছুটা খালি করে হলেও কি উচিত নয় রুনাদের জন্য স্বস্তির একটা পথ খুলে রাখা?
লিখেছেন-
ইয়াসিন আরাফাত
দৈনিক আজাদী (চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত)
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন