শিকড় সন্ধানে বাংলাদেশে ক্রিশ্চিয়ান ইমাম
লিখেছেন লিখেছেন মিকি মাউস ২৭ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৭:২২:০৫ সন্ধ্যা
জীবনের ৩৫ বসন্ত কেটে গেছে। বড় হয়েছেন উন্নত বিশ্বের নাগরিক সুবিধায়। কোনো চাহিদা মা-বাবা অপূর্ণ রাখেননি। তারপরও কোথায় যেন অতৃপ্তি, আপনজনের অভাববোধ। আর সেই অভাববোধ ঘুচাতে রক্তের টানে বাংলাদেশে এসেছেন ক্রিশ্চিয়ান ইমাম হ্যুরম্যান।
গত বছরের নভেম্বর থেকে বাংলাদেশের অলিতে-গলিতে ইমাম খুঁজে ফিরছেন নিজের জন্মদাতা মা-বাবা ও ভাই-বোনদের। সরকারি দপ্তর, বস্তি হয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাহায্য নিলেও এখনও তিনি আপনজনদের খুঁজে পাননি। তবে আশা ছাড়েননি, নিরন্তর সন্ধান করে চলেছেন ডাচ এই নাগরিক।
১৯৭৭ সালে নবজাতক এই বাংলাদেশিকে দত্তক নেন নেদারল্যান্ডের নিঃসন্তান দম্পতি ক্যাথরিনা ভন জেমেরান এবং উইলিয়াম হ্যুরমান। এরপর তারা ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন।
ইমাম দেশটির রটেরডেমের ইরাসমুস ইউনিভার্সিটি থেকে বিজেনস এডমিনিস্ট্রেশনে এমএসসি ও অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। এই ইউনিভার্সিটিতে তিনি শিক্ষকতাও করেছেন। বর্তমানে তিনি লন্ডনের বহুজাতিক এনার্জি ফিন্যান্স প্রতিষ্ঠান মর্গান স্ট্যানলির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
ইমাম নেদারল্যান্ডের জুটেমিয়ার শহরের ক্যাথারিনা ভন জেমেরান ও উইলিয়াম হ্যুরমান নিঃসন্তান দম্পতির পালকপুত্র। তিনি গত নভেম্বরে লন্ডন থেকে ঢাকায় ছুঁটে এসেছেন। ঢাকার হাজারিবাগ এলাকার বিভিন্ন বস্তি, অলি-গলি, সিআইডি পুলিশ, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আর বাংলা ও ইংরেজি সংবাদপত্রের কার্যালয়ে ঘুরে সাহায্য চেয়েছেন তার মা-বাবা ও দুই ভাই-বোনের সন্ধান জানতে।
ক্রিশ্চিয়ান ইমাম কিভাবে খুঁজে পাবেন তার পরিবারকে? এজন্য তার মোটে তিনটি দলিল সম্বল। শিশুকালের বাংলাদেশি পাসপোর্ট, তাকে দত্তক দিতে বাবার সম্মতিসূচক একটি আইনি চুক্তি আর এদেশি অনাথ আশ্রম ‘বেবি হোম’ সরবরাহকৃত তার বাবার তথ্য সম্বলিত একটি পত্র।
ওই সব দলিলের তথ্য থেকে ইমাম জানতে পেরেছেন, তার বাবা নাসির মিয়া। দাদার নাম মরহুম খলিল মিয়া। বাবার ঠিকানা বলতে শুধু মনেশ্বর রোড, মোহাম্মদপুর ঢাকা। মা, ভাই ও বোনের নামও নেই তাতে।
দলিলগুলো ঘেটে ইমাম জেনেছেন, তিনি জন্মেছেন ১৯৭৭ এর ১০ মে ঢাকায়। তার জন্মদাতা বাবা ছিলেন একজন দরিদ্র নৌকার মাঝি। দুর্ঘটনায় এক পা হারিয়ে তিনি স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দুর্বিষহ জীবন পার করছিলেন।
অভাবের তাড়নায় ছোট ছেলে ইমাম মিয়াকে মাত্র ছয় সপ্তাহ বয়সে দত্তক প্রতিষ্ঠান ‘নেদারল্যান্ড ইন্টারকান্ট্রি চাইল্ড ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন ঢাকার (এনআইসিডি) জিম্মায় ছেড়ে দিতে বাধ্য হন।
এনআইসিডি তাকে প্রথমে ধানমন্ডির একটি অনাথালয় ‘বেবী হোমে’ রেখেছিল। পরে তাকে ক্যাথারিনা ভন জেমেরান ও উইলিয়াম হ্যুরমান দম্পতির কাছে দত্তক দেয়। তারা তাকে ১৯৭৭ সালের ২২ জুন নেদারল্যান্ডে নিয়ে যান।
ইমাম এসব তথ্যের উপর নির্ভর করে মনেশ্বর রোডে ও বুড়িগঙ্গা নদীর বয়স্ক মাঝিদের কাছে তার বাবার খোঁজ করেছেন। কিন্তু কোথাও বাবার সন্ধান পাননি। তবে মনেশ্বর রোডের এক বয়স্ক নারী ও পুরুষ জানিয়েছেন, তারা নাসির মিয়াকে চিনতেন। তবে তারা বিগত ১০ বছর নাসির মিয়াকে আর দেখেননি।
বুড়িগঙ্গা নদীর নৌকার মাঝিরা সাধারণ ফরিদপুর এলাকা থেকে ঢাকায় আসেন। এ তথ্য জেনে ইমাম ধারণা করছেন, তার বাবা নাসির মিয়া হয়তো অভাবের কারণে ঢাকা ছেড়ে ফরিদপুরে গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন। কিন্তু ইমাম জানেন না ফরিদপুরের কোথায় তার বাবার বাড়ি।
প্রথমবারের সফরে বাবাকে খুঁজতে ফরিদপুরে আর যাওয়া হয়নি ইমামের। তাকে ফিরতে হয়েছে কর্মস্থল লন্ডনে। কিন্তু শৈশব থেকে খুঁজে ফেরা মা-বাবার সন্ধান জানতে একবারের ব্যর্থতা তাকে হতোদ্যম করতে পারেনি।
ইমাম আবার বাংলাদেশে এসেছেন। ঢাকায় এসে উঠেছেন লন্ডনে পরিচয় হওয়া বন্ধু ঈসার বাসায়। ইমাম যেমন ফরিদপুর চেনেন না তেমনি ঈসাও না। তাই এবারও ইমাম ঢাকার রাস্তায় খুঁজে ফিরছেন মা-বাবা আর ভাই ও বোনকে।
মা-বাবাকে খোঁজ করার অংশ হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছেন ক্রিশ্চিয়ান ইমাম ও ঈসা। এ সময় এই প্রতিবেদকের কাছে ইমাম তার জীবনের কথা তুলে ধরার পাশাপাশি বলেন কিভাবে তিনি তার স্বজনদের খুঁজে পেতে পারেন।
ইমাম প্রথমেই বললেন, ‘তুমি পৃথিবীর যেখানেই থাক না কেন, ঢাকা কি লন্ডন, তুমি ধনী বা গরীব যেই হও না কেন- ভালবাসা আর পরিবার জীবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাবা-মা ও দুই ভাই-বোনের সঙ্গে একত্রিত হতে পারলে আমার জীবন পূর্ণতা পাবে।’
‘যখন আমি আমার ভাই-বোনের দেখা পাব, তখন বুঝতে পারব আমার বদলে ওদের কেউ দত্তক হলে আমি সত্যিকার কী অবস্থায় থাকতাম।’ – যোগ করেন অর্থনীতিতে পিএইচডি করা ইমাম।
শৈশব থেকেই নিজের ‘বায়োলজিক্যাল’ মা বাবা ও ভাই বোনকে খুঁজে পাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে ইমাম বলেন, ‘যদিও আমার অনেক ডাচ বন্ধু আছে এবং হল্যান্ডে আমার যৌবনকাল উপভোগ করেছি। তবুও আমি সব সময় চাইতাম প্রাপ্ত বয়স্ক হলে বাংলাদেশে ফিরে আসতে। কারণ আমি জানতে চাইতাম আমার দুই ভাই-বোন আর মা-বাবা কেমন আছে। আমি আশা করি তারা আমাকে ভুলে যায়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি বাংলাদেশে আবার এসেছি আমার শিকড় খুঁজতে। আমি এখানে জন্মেছি এবং আমার জীবনের প্রথম ছয় সপ্তাহ কেটেছে এই ঢাকায়। আমি এসেছি আমার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজতে। আমাকে তিনি ১০ মাস তার গর্ভে ধারণ করেছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা আমাকে খুব ভালবাসত। এখনো তারা আমার সেই প্রথম ছয় সপ্তাহকে মনে করতে পারবে। তারা জানুক তারা সব সময় আমার হৃদয়ে আছেন।’
তথ্যের ঘাটতির কারণে ইমাম মা-বাবাকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলেও আশা ছাড়েননি। তার মনে হয়েছে যদি বাংলাদেশের কোনো এনজিও বা সামাজিক সংগঠন চেষ্টা করলে হয়তো তিনি তার স্বজনদের সহজেই খুঁজে পাবেন।
ক্রিশ্চিয়ান ইমামকে সহযোগিতা করতে যোগাযোগ করুন এই ই-মেইল ও মোবাইল ফোন নম্বরে- , মোবাইল: ০১৭৭২ ৯৪৭১৩১
বিষয়: বিবিধ
১১৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন