চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ-১
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ২৭ জানুয়ারি, ২০১৩, ১১:০৩:৫৭ রাত
সন্তানদের ভালোর জন্যই প্রয়োজনে বাবা-মাকে দৃঢ় হতে হয়। এটা অবশ্যই ভালো কারণ বাবা-মার দৃঢ়তা সন্তানদের মনে নিরাপত্তা বোধের জন্ম দেয়। কিন্তু ছেলেমেয়েরা যখন কথা শোনে না বা অবাধ্যতা করে, তখন তাদেরকে সঠিক পথে আনতে বাবা-মারা যে কাজটি করেন, তাঁর নাম ‘শাসন’। আর শাসন মানে সবাই মনে করেন যে, বকাঝকা করা নয়তো কোন শারীরিক শাস্তি দেয়া কিংবা পছন্দের জিনিস বন্ধ করে দেয়া ইত্যাদি। আর শাসনের পক্ষে নানা ধরণের যুক্তিও থাকে বাবা-মার কাছে। যেমন- মাঝে মাঝে শাসন না করলে বাচ্চারা মানুষ হয় না, সাহস বেশি বেড়ে যায়, ছোটবেলায় আমাদের বাবা-মা’রাও আমাদেরকে শাসন করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ শাসন আর গায়ে হাত তোলা কিন্তু এক জিনিস নয়। বাচ্চাদের ভুল বা অন্যায় গুলো অবশ্যই তাদেরকে ধরিয়ে দিতে হবে, তবে এরসাথে গায়ে হাত তোলার কোন সম্পর্ক নেই।
আমি দেখেছি আড়াই বছর বয়সি একটি মেয়েকে তার বাবাকে ঘর ভর্তি মানুষের সামনে চড় লাগিয়ে দিতে, মেহমানদের জন্য সাজিয়ে রাখা খাবার ধরার জন্য। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল, কারণ চড়টা কেন খেল বুঝতে পারছিলো না। বাসায় টিচার আসলে পড়তে চায় না তাই চার বছর বয়সি মেয়েকে মা লাঠি পেটা শুরু করলো টিচারের সামনেই। স্কুল থেকে ডেকে টিচাররা অভিযোগ করলো ক্লাসে বাচ্চা অমনোযোগী থাকে, বাসায় ফিরেই বাবার চড়-থাপ্পড়ের বৃষ্টি বাচ্চার উপর। ছয় বছর বয়সি ছেলেটা তার তিন বছরের বোনের সাথে খেলনা শেয়ার করতে রাজী না হলেই শারীরিক আঘাতের স্বীকার হয়। ঘরের কোন জিনিসপত্র নষ্ট করলো তো আর রক্ষা নেই। এমন আরো অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে বাচ্চাদের সাথে। অথচ এই ব্যাপার গুলোর সমাধানের সাথে শারীরিক আঘাতের কোন কোন সম্পর্ক নেই বা শারীরিক আঘাত এর সমাধানও নয়।
পরীক্ষায় নাম্বার কম পেলে, ঘরের কোন জিনিস নষ্ট করলে, ছোট ভাই-বোনের সাথে বনিবনা না হলে, কথা শুনতে না চাইলে, অবাধ্যতা করলে বাচ্চাদের বুঝিয়ে না বলে, গায়ে হাত তুললে আসলে তেমন কোন লাভ হয় না। শরীরে ব্যথা পায় কিন্তু কেন ব্যথা পেলো বুঝতে পারে না, ফলে একই কাজ বার বার করে এবং আবারো শাস্তি পায়। এরফলে বাচ্চাদের মনে বাবা-মায়ের প্রতি চাপা ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং ক্রমাগত তা বাড়তে থাকে। একটা সময় বাচ্চারা বাবা-মার কথাই সহ্য করতে পারে না। ইচ্ছে করে তখন কথা শোনে না বা দুষ্টুমি করে। কারণ চিন্তা থাকে বড়জোর আমাকে ধরে মারবে এই তো! তাই বাচ্চারা কোন অন্যায় করলে তাদের বোঝাতে হবে। কেন এই কাজটা করা ঠিক না, এর প্রভাব কি হতে পারে ইত্যাদি। আর শারীরিক আঘাতের চেয়ে এই বোঝানোটা অনেক বেশি ফলপ্রসূ।
শাসন আর অ্যাবিউজ কিন্তু এক জিনিস না। শাসন হচ্ছে এমন একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে শিশুর ভুল বা অন্যায় গুলো তাকে ধরিয়ে দিয়ে, তার থেকে বের হবার প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা করা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে শাসনের নামে বাচ্চারা অ্যাবিউজের স্বীকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত, যার ফলে বাঁধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তাদের সুষ্ঠু বিকাশ। বাবা-মা যখন শাসন করতে গিয়ে বাচ্চাদের গায়ে হাত তুললেই যে সব ঠিক হয়ে যাবে এর কিন্তু কোন গ্যারান্টি নেই। বরং বাচ্চারা আরো জেদি হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। যারা বাচ্চাদেরকে বোঝাতে পারেন না বা শেখাতে পারেন না তারাই আসলে শাসনের নামে গায়ে হাত তোলেন। কিন্তু এভাবে সন্তানদের মানুষ করা যায় না। নিজেদের চরিত্রের অযোগ্যতা, নিয়ন্ত্রণহীনতাকে শাসনের নামে চালিয়ে দেন। যা কিনা প্রকৃত অর্থে চাইল্ড ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ।
আজ যে বাচ্চাটাকে আমি সামান্য কারণে গায়ে হাত তুলছি, শরীরের সাথে সাথে ছোট্ট মনটাকেও করছি আঘাতে আঘাতে জর্জরিত...!! যখন ওর স্নেহ- মমতা-সহমর্মিতা-ভালোবাসার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন পাচ্ছে শাসনের নামে চড়-থাপ্পড়-বকাঝকা...!! একটা বয়সে গিয়ে যখন আমার স্নেহ-মমতা-সহমর্মিতা-ভালোবাসার প্রয়োজন পড়বে, তখন কি সন্তানের কাছ থেকে সেটাকে প্রাপ্য মনে করাটা অন্যায় হবে না? আমার আজকের আচরণটাই যে আমার সন্তানের আগামীর পাথেয় হবে সেটা যেন আমরা কেউ ভুলে না যাই।
চলবে.........(ইনশাআল্লাহ)
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন