অন্তরে জাগাই জ্ঞানো পিপাসা......৪
লিখেছেন লিখেছেন আফরোজা হাসান ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১০:৫৮:৩৬ রাত
নিজেই নিজের সম্পর্কে ঠিকমতো জানে না! এই উপলব্ধি থেকে সাহিলের লজ্জা ও অপরাধ বোধে নিমজ্জিত চেহারাটা দেখে মায়ার চেয়ে হাসিই বেশি পাচ্ছিলো রাহমার। জীবনে সুবহে সাদিক আসার জন্য আঁধার ছেয়ে যাওয়ায় কোন বিকল্প নেই। একথা জানে বলেই হয়তো দুঃখিত হবার বদলে আনন্দিত বোধ করছিল রাহমা ভাইয়ের অবস্থা দেখে। মানুষের জীবনের পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে তার ভেতর এই আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হওয়াটা যে, সে এতদিন ভুলের পথে ছিল! এই বোধ একবার জাগ্রত হয়ে গেলে যে নিজেই নিজের সংশোধনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠে। আর তখনই কারো পক্ষে সম্ভব হয় সেই ব্যক্তিকে সঠিক পথ প্রদর্শন করা। কোন মানুষ যেই পর্যন্ত নিজে না চায়, কারো পক্ষে সম্ভব নয় তাকে আত্মোন্নয়নের পথে পরিচালিত করা। কেননা আত্মিক শুদ্ধতা কোন মেডিসিন না যে জোড় করে খাইয়ে দেয়া সম্ভব হয়। এর প্রয়োজনীয়তা সর্বাগ্রে ব্যক্তিকে উপলব্ধি করতে হবে। তাহলেই কেবল সম্ভব তার আত্মশুদ্ধি বা পরিবর্তন। মানুষের যেই গুণগুলো একই সাথে কল্যাণকর এবং অকল্যাণকর তার মধ্যে একটি হচ্ছে যে কোণ অবস্থা বা পরিস্থিতির সাথে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। এই গুণের ফলে মানুষ যেমন শত দুঃখ-বেদনা-অপ্রাপ্তির পরেও আবারো হাসতে পারে। আবার এই দোষের কারণেই মানুষ তার ভুল পথ ও মতের উপর বেহুঁশের মত চলতে পারে। যখন কোন মানুষ নিজে এটা বুঝতে পারে। তখনই আসলে শুরু হয় তার জীবনের সঠিক লক্ষ্যে পানে ছুটে চলা।
রাহমা বুঝতে পারছে সাহিল আজ নিজেকে দেখেছে বিবেকের আয়নায়। মনের যে দ্বার রুদ্ধ ছিল, যে জানালাগুলোতে মরচে পড়ে গিয়েছিল বন্ধ থাকতে থাকতে। আজ সব খুলে গিয়েছে। হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়া আলোর বন্যায় তাই চোখ ধাধিয়ে গিয়েছে সাহিলের। সইতে পারছে না আলোর উত্তাপ। বদ্ধ ঘরের বাতাসের এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, বিশুদ্ধ বাতাসের ঠিকভাবে শ্বাস নিয়ে পারছে না। কিন্তু এতে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। এই আলো এই বাতাসের সাথেও নিজেকে মানিয়ে নেবে সাহিল দ্রুতই ইনশাআল্লাহ। অতঃপর শুরু হবে একটু একটু করে নিজের মাঝ থেকে নিজেকে খুঁজে বের করে, সঠিক গন্তব্যের পানে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলা। এগারো বছরের ছোট সাহিল রাহমার চেয়ে। এখনো মনেআছে সাহিলকে হাঁটতে শেখানোর কথা। এক পা দু পা করে হাঁটতে গিয়ে যখন পড়ে যেত। বড় বড় চোখ করে রাহমার দিকে তাকিয়ে দু’হাত বেড়িয়ে বলতো, আপ্পা তোলে। রাহমা তখন নানান কথা বলে, হেসে আবার উঠে দাঁড়ানোতে উৎসাহ যোগাতো সাহিলকে। এবং একসময় সাহিল উঠে দাঁড়াতো। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়তো রাহমার কোলে। পবিত্র হাসির বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে বলতো, আপ্পা আমি উইন উইন।
সেই বয়সেই সাহিল উইল শব্দটা শিখে ফেলেছিল। উইন হবার স্পিডও ওর ভেতরে ছিল। সেই স্পীড সাহিল ধরে রাখতে পারেনি সেই ব্যর্থতা শুধু ওর একার নয়। প্রতিটা শিশুর মধ্যেই সম্ভাবনার আলো থাকে। প্রতিটা শিশুরই একজন রাহ’বার প্রয়োজন পড়ে সঠিক গন্তব্যে এগিয়ে যাবার জন্য। তাই কারো মধ্যের সম্ভাবনার আলো যদি নিভু নিভু হয়ে যায়, চলতে শুরু করে ভুল পথে। সেটা দায় শুধু তার একার নয়। সেই দায় তাদেরও যারা ছোট্ট আলোর বিন্দুটিকে প্রজ্জলিত আলোক শিখায় রূপান্তরিত করতে সহায়তা করতে পারেনি। হাত ধরে গন্তব্যের পথে বিছিয়ে থাকা চোরাকাঁটা, খাঁদা-খন্দ পাড় করিয়ে দিতে পারেনি। তাই সাহিলের এই অবস্থার জন্য নিজেকেও দায়ী মনেহচ্ছে রাহমার। সাহিলকে আবারো হাঁটতে শেখাতে হবে তাকে। পার্থক্য শুরু এবার শেখাতে হবে মানসিক ভাবে হাঁটা। হাত ধরে পার করে দিতে হবে কন্টকাকীর্ণ পথ! ওর মনে জাগাতে হবে জীবনের প্রকৃত বোধ। বোঝাতে হবে জীবনের জটিলতা! শেখাতে হবে ব্যর্থতাকে মেনে নেয়া! জানাতে হবে চাইলেই জীবনে সবকিছু হাজির হয়ে যায় না। সেজন্য কষ্ট করতে হয়, চেষ্টা করতে হয়, পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু তারপরেও সেটি থেকে যেতে পারে অধরাই। আর এইসব শিক্ষা কারো মুখে শুনে শুনে, বা কাউকে দেখে দেখে উপলব্ধি করাটা খুব বেশি কঠিন। তবে হ্যা পড়ে পড়ে অর্জন করাটা সেই তুলনায় বেশ সহজ।
মানুষের শেখার মাধ্যম সাধারণত তিনটি। মানুষ নিজ অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, অন্যেকে দেখে শেখে এবং পড়ে শেখে। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বেশির ভাগ সময়ই শিখতে পারে জ্ঞানের অভাবে। অন্যেকে দেখে শিখতে পারলেও। সেটাকে সঠিক মাত্রায় কাজে লাগাতে পারে না জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে। তাই পড়ে শেখাটাকেই নিজের জন্য সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে রাহমা। এতে একটা বিষয় নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা করে মূল জিনিসটাকে খুঁজে পেতে অনেক সহজ মনেহয়। যত বেশি জ্ঞানার্জন করা হবে নিজেকে তত বেশি জানার সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। যখনই কুরআনের তাফসীর বা হাদীস নিয়ে বসে। রাসূল (সঃ) ও সাহাবীদের উন্নত চরিত্র, ত্যাগ, তিতিক্ষা, পরোপকার, ধৈর্য্য ইত্যাদি সম্পর্কে পড়ে, অনুভব করার চেষ্টা করে। তখন বুঝতে পারে মুসলিম হিসেবে কতটা দীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় দিন যাপন করছে সে। কারো মুখ থেকে শুনে কখনোই হয়তো এভাবে উপলব্ধি করতে পারতো না। একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় সেটি থেকে শিক্ষা নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করা সুকঠিন। অন্যেকে দেখে অবস্থায় গুরুত্ব একই ভাবে অনুভব করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া যুক্তি কাজ করে অবচেতনে, আমি তো তার মত নই। কিংবা দূর থেকে দুটা পরিস্থিতিকে একই মনে হলেওপার্থক্য থাকে যথেষ্ট। ঠিক যেমন একই চেহারার দুজন জমজ ভাই বা বোনের বাহ্যিক মিল যতই থাকুন না কেন, অভ্যন্তরীণ পার্থক্যই বেশি থাকে।
তাই সর্বাবস্থায় নিজে পড়ে জ্ঞানার্জন করার পক্ষে রাহমা। সাহিলকে এখন এটাই বোঝাতে হবে। যত পড়বে তত নিজেকে জানবে। যত নিজেকে জানবে জীবনে আগত সমস্যাগুলোকে কিভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেটা বুঝতে পারবে। এবং নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে সঠিক লক্ষ্য পানে। সেজন্যই নানান ধরণের প্রশ্ন দিয়েছে সাহিলকে রাহমা। যাতে বুঝতে পারে সে যে আসলে হাওয়ায় ভেসে চলছে। ডানা মেলে উড়াকে অপছন্দ করে না রাহমা। বরং সমর্থন করে ভীষন ভাবে। কিন্তু ডানা মেলে উড়ার আগে অবশ্যই মাটিতে পা দু’খানিকে শক্ত করে দাঁড় করিয়ে নিতে হবে। যাতে কখনো ডানা গুটিয়ে গেলেও হুমড়ি খেয়ে পড়তে না হয়। ভাইয়ের পাশে বসে রাহমা বলল, এই নে চকলেট।
রাহমাকে চকলেট খেতে দেখে বেশ অবাক কন্ঠে সাহিল বলল, তুমি চকলেট খাচ্ছো?
রাহমা হেসে বলল, আচ্ছা তোর কখনো এমন হয় যে খুব অপছন্দের কিছু খেতে ইচ্ছে করে? শুধু ইচ্ছে না একদম ভয়াবহ ইচ্ছে যাকে বলে। অর্থাৎ, ঐ মূহুর্তে সেটা না খেতে পারলে চলবেই না এমন অনুভূতি তৈরি হয় মনের মাঝে।
সাহিল হেসে বলল, এমন পিকুলিয়ার ইচ্ছে তোমার মত পিকুলিয়ার মানুষদেরই শুধু হয়। অপছন্দের জিনিসের জন্য হঠাৎ পাগল হয়ে ওঠা তো স্বাভাবিক হতে পারে না!
রাহমা হাসতে হাসতে বলল, তাহলে মনেহয় আমি মানুষটা খুব একটা স্বাভাবিক না। কারণ শুধু চকলেটই না মাঝে মাঝে আমার ভীষণ অপছন্দের কোন মানুষকেও অসম্ভব ভালো লাগতে শুরু করে। এমনটা কখন থেকে শুরু হয়েছে জানিস?
কখন থেকে?
যখন থেকে আমি জেনেছিলাম একজন মানুষকে আমরা শুধু এজন্য পছন্দ করি না যে সেই মানুষটা আসলেই অনেক ভালো। পছন্দ করার পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে সেই মানুষটার মধ্যে সেই সব বা কিছু গুণ থাকে যা আমাদের পছন্দ থাকে। ঠিক তেমনি একজন মানুষকে অপছন্দ করার পেছনেও কিছুটা দোষ তার থাকে আর কিছুটা থাকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীর। এরপর একটা বই পড়ে জেনেছিলাম একজন মানুষ যতই খারাপ হোক না কেন তার মাঝে যদি বিন্দু পরিমাণও ভালো কিছু থাকে সেটাকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। হতে পারে কারো কাছ থেকে পাওয়া এই স্বীকৃতিটুকুই তাকে খারাপ থেকে ভালো হবার পথে প্রেরণা যোগাবে। আরেকটা বাচ্চাদের গল্পে পড়েছিলাম যে, একজন ব্যক্তি এমন একটা দ্বীপে আটকা পড়েছিলেন যেখানে নারকেল ছাড়া আর কোন গাছ ছিল না। নারকেল ছিল তার সবচেয়ে অপছন্দের খাবার। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য লোকটিকে নারকেলই খেতে হচ্ছিলো। প্রথমে খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কিন্তু একটা সময় যে যখন উপলব্ধি করলো তার কাছে অন্য কোন অপশন নেই। তখন সে অনুধাবন করলো যে, কারো কাছে যখন কোন অপশন থাকে না, সেটাও আসলে একটা অপশনই। এবং বুঝলো যে, যখন কোন কিছু মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। তখন সেটা খুশি মনে মেনে নেয়াই বুদ্ধিমত্তা। এতে কষ্ট কম কবে, জীবনযাপন অনেক সহজ হয়ে যায়।
সাহিল হেসে বলল, ওয়াও আপা! বাচ্চাদের গল্পের বইতেও এমন সব চমৎকার শিক্ষা থাকে?
রাহমা হেসে বলল, শিক্ষা তো সবকিছুর মধ্যেই লুকায়িত থাকে। শুধু সেটাকে খুঁজে ও বুঝে নিতে হয়। এজন্যই তো পড়ার কোন বিকল্প নেই।
আমিও এখন সেটা বুঝতে পারছি আপা।
কিন্তু শুধু বুঝলেই হবে না। বোঝার সাথে সাথে নিজের দুর্বলতা, ঘাটতি ইত্যাদি মেনেও নিয়ে হবে। সারাক্ষণ অনুশোচনায় দগ্ধ হওয়া চলবে না মোটেই। মনে করতে হবে না বোঝার কারণে আমার দ্বারা কিছু ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন যেহেতু আমি বুঝি আর ভুল করবো না ইনশাআল্লাহ। আমি নিজেকে ভালো একজন মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো। পথে বাঁধা আসবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বাঁধার কথা ভেবে দুর্বল না হয়ে বরং কিভাবে বাঁধাকে মোকাবিলা করা যায় সেই পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নেবো।
সাহিল হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ আমি তাই করবো। এখন বলো তুমি সত্যিই প্রশ্নগুলোর জবাব বলে দেবে না?
রাহমা হেসে বলল, উহু বলে দেবো না। তোকেই খুঁজে বের করতে হবে প্রশ্নগুলোর জবাব। তবে যদি ভুল হয় তোর কোন জবাব সেটা অবশ্যই শুধরে দেব ইনশাআল্লাহ। নিজেকে গড়তে হলে আগে নিজেকে জানতে হবে। তাই নিজেকে জানার চেষ্টা জারি রাখ।
সাহিল তখন হেসে আবারো প্রশ্নগুলোকে চোখের সামনে মেলে ধরলো।
বিষয়: বিবিধ
১৯৬৬ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে জ্ঞানার্জনের চাষাবাদ করতে বীজতলা তৈরির কাজটি কিন্তু হয়েছে দারুণ। এপাশ থেকে ওপাশ, বেলে-দোআঁশ ফেলে প্রস্তুত করা হলো উর্বর জমিন।
আর, অপছন্দ যদি অবৈধ এবং ভীষণ ক্ষতিকর কিছু না হয় - তাহলে তাকে মেনে নেয়া মানেই তো প্রকারান্তরে নিজের নফসকে (desire/whim) নিয়ন্ত্রণের অভ্যাসকে রপ্ত করা, তাই না মিস?
চমৎকার একটা লেখার জন্য জাযাকাল্লাহু খাইরান আপুমণি
অনেক অনেক ভালোবাসা রইলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন