গল্পঃ পাওয়ার
লিখেছেন লিখেছেন মোস্তাফিজ ফরায়েজী জেরী ২৩ মে, ২০১৪, ০৮:১২:৩৫ রাত
১.
কে যে তার নাম রহিম শেখ রেখেছিল তা নিয়ে রহিম শেখ নিজেও সন্ধিহান। রহিম শেখ শুনেছে তার মামা নাকি তার নাম রেখেছিল। খুব সম্ভব, মামা নাম রেখেছিল বলে সে আর রহিম শেখ নয়, এখন সে মামা। রাস্তার এ মোড়ে কিংবা ও মোড়ে অথবা যেখানেই হোক না কেন সে সর্বজনের মামা। তার যেন ভাগ্নের অভাব নেই। ভাগ্নেরা দাম-দর কষে ওঠে। রহিম শেখ তার শরীরের সব পাওয়ার দিয়ে চালায়। তারপর ভাগ্নে নেমে যায় হাতে নোট গুঁজে দিয়ে।
গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতে রহিম শেখের শরীরে থাকতে হয় সমান পাওয়ার। শরীরে পাওয়ার না থাকলে পেটও চলে না। পেট আবার একটি নয়, তার পেট চারটি। একটি তার নিজের, ঢাকায় থাকে তার সাথে। আর তিনটি নওগাঁয় থাকে।
গ্রীষ্মের তাপে ক্লান্ত হয়ে থেমে থাকলে তার চলে না, বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে দু’দিন বিশ্রাম নেবার তার জো নেই অথবা কনকনে শৈত্য প্রবাহে বসে থাকা তাকে মানায় না। কেননা, তার ছেলেটি মাধ্যমিকে পড়ে আর মেয়েটি ক্লাস ফাইভে।
এইতো বেড়ি বাঁধে এক গ্যারেজে থাকে রহিম শেখ। নোংরা পরিবেশে তার বসবাস।
রহিম শেখ প্রতিদিন সকালে জিগাতলা কাঁচা বাজার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে তে পেয়ো একটি যানের সাথে। তিন পা ওয়ালা তার যানটির সাথে অনেক দোস্তি তার।
একদিন সে প্রতিদিনের মতো দাঁড়িয়ে ছিল জিগাতলা কাঁচাবাজার মোড়ে। হঠাৎ একটি প্রাইভেট কার এসে তার প্রাণের তে পেয়ো যানের সাথে জোরে ঘর্ষণ লাগিয়ে চলে গেল। রহিম শেখ চিৎকার করে উঠলো। দু’চারটা গালিও ঠুকে দিল।
এক মিটার দূরে গিয়ে প্রাইভেট কারটা থামল। কারের ভিতর থেকে স্যুট কোট পড়া একটা লোক বেরিয়ে আসলো। অবাক ব্যাপার হল স্যুট কোট পড়া লোকটির নামও রহিম শেখ, তবে এখন সবাই তাকে রহিম সাহেব বলে ডাকে। রহিম সাহেব রহিম শেখের সামনে এসে জোরে এক থাপ্পর বসিয়ে দিল রহিম শেখের গালে আর বলতে লাগলো, ‘কি রে? গাড়ি সাইড করে রাখতে পারিস না।’
রহিম শেখ চকিত এই ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে যায়। তার দোষ কোথায় সে খুঁজে পেল না। কেননা, তার গাড়িটা সাইডে চাপানো ছিল ঠিকঠাক মত। তিন দিন গালে ব্যাথা ছিল রহিম শেখের। রহিম শেখ সেই ঘটনা ভুলতে পারে না। স্বপ্নে পর্যন্ত সেই ঘটনা দেখে।
সে ভাবে আজ যদি তার পাওয়ার থাকত তাহলে ঠিকই এর শোধ নিত। কার গাড়ির পাওয়ারের জোরে যে সেদিন লোকটি তাকে চড় মেরেছিল, এটা তার বদ্ধমূল ধারণা। এরপর প্রতিদিন সেই কারটিকে দেখতো রহিম শেখ। প্রতিটা কার থেকে এই কারকে তার কাছে আলাদা মনে হয়। এক বর্ষার দিনে তো তার গায়ে কাঁদা ছিটিয়ে কার গাড়িটা চলে যায়। কালো রং-এর কার গাড়ি, সে ভাবে হয়তো কোন কালো বিড়ালের হবে।
কার গাড়ির পাওয়ার দেখে সে অবাক হয়। আরেক দিন তো তার পাশে দাঁড়ানো এক লোককে ধাক্কা মেরে দিল ঐ কার গাড়িটা। শেষে পাঁচ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিদায় নিল রহিম সাহেব।
এটা হল টাকার পাওয়ার। টাকা থাকলে সব মাপ এ শহরে। দু’চারশ খুন করেও দিব্বি ঘুরে বেড়ানো যায় এ শহরে যদি তার টাকা থাকে। পাওয়ারের কোন শেষ নেই এই ঢাকা শহরে। শুধু রহিম শেখদের কোন পাওয়ার নেই। রহিম শেখও এমনই ভাবতো। কিন্তু না, রহিম শেখতো একদিন অবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল তারও পাওয়ার আছে।
২.
টানা সাতদিন ধরে বৃষ্টি চলছে। দিনও রাতের মত অন্ধকার রূপ ধারণ করেছে। দোকানপাট সব বন্ধ। রহিম শেখ দাঁড়িয়ে আছে সেই মোড়ে, তার তে পেয়ো যানের সাথে। তার পাশে আরেকজন তার মত দাঁড়িয়ে আছে। ওর নাম সাত্তার। আশে-পাশে কেউ নেই। এই সকাল সাড়ে আটটাতে অন্যদিন রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। তবে আজকের দিনের ব্যাপার আলাদা। অতি প্রয়োজন ছাড়া এই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে কারো দায় পড়ে নি বাসা থেকে বের হতে।
হঠাৎ রহিম শেখ দেখে ছাতা মাথায় দিয়ে প্যান্ট গুটিয়ে একজন লোক আসছে। বেশ দূরে থাকতেই রহিম শেখ তাকে চিনে ফেলল। এত সহজে ভোলার পাত্র রহিম শেখ নয় নয়। এ যে তাকে চড় দেওয়া সেই সাহেব, রহিম সাহেব। আজ বেশ বিপাকে পড়েছেন রহিম সাহেব। তার কার গাড়িটাও বের করতে পারছেন না কয়েকদিন থেকে। রহিম সাহেব তার বেকায়দা ভুঁড়িটা নিয়ে আস্তে আস্তে হেটে কাছে আসলো।
সাত্তারকে বলল, ‘এই মামা ফার্মগেট যাবা?’
সাত্তার কয়, ‘না।’
এবার রহিম সাহেব রহিম শেখের কাছে আসে। বলে, ‘মামা যাবা?’
রহিম শেখ এক পলকে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর ভাব ধরে চট করে বলে, ‘কোথায়?’
‘ফার্মগেট, কত?’
রহিম শেখ মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করে বলে একশো।
‘কি যে বলিস, পঞ্চাশ টাকায় যাবি।’
রহিম শেখ বোঝে আজ দিন তার। তাই হাত দিয়ে দাঁতের খোঁচাতে খোঁচাতে বলে, ‘সাইডে চাপেন। ঐ যে দেখছেন ড্রেন, ড্রেনের ভিতর মাথা চুবিয়ে মাথা ঠিক করে আসেন।’
রহিম শেখের আজ অনেক পাওয়ার। এত খারাপভাবে বলার পরও রহিম সাহেব চুপ।
বরং রহিম সাহেব তো থতমত খেয়ে গেলেন। রিক্সাওয়ালা যে এমন কথা বলতে পারে তিনি ভাবতেই পারেন নি।
রহিম সাহেব কোন কথা না বলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রহিম শেখের রিক্সায় উঠে বসে।
রহিম শেখ তার শরীরের পাওয়ার দিয়ে রিক্সা চালাতে থাকে আর ভাবে, ‘আজ বজ্জাতের কাছে গাড়ি নেই। আজ সব পাওয়ার আমার।’
খালি গায়ে গান গাইতে গাইতে রিক্সা চালায় রহিম শেখ,
‘এক আকাশের তারা তুই একা গুনিস নে, গুনতে দিস তুই কিছু মোরে............’
রহিম শেখ রিক্সা এক নির্জন গলিতে নিয়ে যায়। যে গলিতে সাধারণত খুব কম মানুষ জন যায়। গলিতে গিয়ে রহিম শেখ হঠাৎ করে রিক্সা থামায়। রিক্সা থেকে নেমে বলে, ‘মামা, আপনার নাম কি?’
রহিম সাহেব বলেন, ‘রহিম শেখ। রিক্সা থামালে কেন?’
রহিম শেখ ‘হা! হা!’ করে হাসতে হাসতে বলে, ‘আমার নামের নাম। নামেন।’
রহিম সাহেব বলেন, ‘ফার্মগেট আসে নি তো।’
রহিম শেখ এবার বলে, ‘ঐ মামা, নাম! নাম!’ বলে হাত ধরে টানতে টানতে রিক্সার বাইরে নিয়ে আসে।
তুলতুলে রহিম সাহেব ঘাবড়ে গেল এ ঘটনায়, ভাবল ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে। তিনি বললেন, ‘তুমি আমার সব কিছু নিয়ে নাও, শুধু আমার কিছু করো না।’
রহিম শেখ ‘ঠাশ! ঠাশ!’ দুটো চড় বসিয়ে বলল, ‘যা, সোজা চলে যাবি। পিছনে তাকাবি না।’
রহিম সাহেব গালে হাত দিয়ে পিছন ফিরে তাকাতে তাকাতে বাচ্চা ছেলের মতো ছল ছল চোখে সোজা চলল। রহিম সাহেব তখনো জানে না, কেন কি হল? ছিনতাইকারী হলে তার কাছ থেকে কিছু না নিয়ে ছেড়ে দিল কেন কিছু বুঝল না রহিম সাহেব। রহিম শেখকে কবে চড় দিয়েছিল তাও মনে নেই রহিম সাহেবের।
এদিকে রহিম শেখ রিক্সা ঘুরিয়ে বিপরীত দিকে চলতে থাকে। সেও তার মুখে হাত দিয়ে হাত বুলায়, কিন্তু ঠোঁটে মুচকি হাসি। তার নিজের পাওয়ার আছে জেনে খুব খুশি রহিম শেখ। রহিম শেখের মনে আজ অট্টহাসি। তাই মন খুলে জোরে জোরে গাইতে থাকে,
‘জাত গেল জাত গেল বলে
একি আজব কারখানা
সত্য কাজে কেউ নয় রাজি
সবই দেখি তা না-না-না..................... ’
***সমাপ্ত***
বিষয়: সাহিত্য
১১৩৪ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন