আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল বাতিল করা কি এখন সময়ের দাবি?

লিখেছেন লিখেছেন সালাম আজাদী ০৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ১১:১৮:০৭ রাত



যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে যেদিন প্রথম শুনেছিলাম, খুশীতে আমি আটখান হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ এই বিচারটা হয়ে গেলে আওয়ামীলীগের রাজনীতি করার আলাদা একটা ডাইমেনশান তৈরী হত। যেটা সারা বাংলাদেশের জন্য খুব দরকার ছিলো। সে ডাইমেনশান টা হত দেশ গড়ার, সেটা হত ডিজিটাল দেশের জন্য ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, সেটা হত গঠনমূলক রাজনীতির দিকে আওয়ামীলীগের নতূন পদযাত্রা।



এই বিচারটা হয়ে গেলে জামায়াতের জন্য হয়ে যেত একটা মহা আনন্দের দিন। তাদের বড় বড় নেতাদের, যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে বলে সব সময় জিগির তোলা হয়, অনেকেই বুড়া হয়ে গেছেন। কেও কেও মৃত্যুর কাছাকাছি, কারো কারো বয়স এত বেশি যে সঠিক ভাবে দল চালানোর মত শারীরিক শক্তি তাদের কমে গেছে। রিটায়ার্ড হয়ে যাচ্ছেন তারা। জামায়াতের যারা আজ প্রথম সারির নেতা, তাদের মাত্র গুটি কয়েক কে এই বিচারে শাস্তি হলেও হতে পারে, না হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা পঁচানব্বই ভাগ। বাদ বাকী সকল নেতাই আবির্ভুত হতেন যুদ্ধাপরাধহীন চরিত্রে্র এক্কেবারে খাটি বাংলাদেশী প্রগতিশীল নেতা হিসেবে। জামায়াত হতে পারত গণ মানসের খুব প্রিয় একটি দল, হয়ে যেত বাংলাদেশের পক্ষের এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি, কিংবা নিদেন পক্ষে তারা পেত দেশের জন্য কিছু করবার মত ভালো একটা সুযোগ।



এই বিচার হয়ে গেলে এরশাদ সাহেবের বলার সুযোগ থাকতো না, আমি স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে ঐক্য করবোনা, তাদের সাথে বসব না। তরীকত ফাউন্ডেশান জামায়াতের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিতনা, কিংবা মিসবাহ চৌধুরীর মত রাজাকারও জামাতের গেট্টু ধড়ে আছাড় মারার পায়তারা করত না। এই বিচার শেষ হলে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মত এক নিরেট প্রতিক্রিয়াশীল দলের প্রয়োজন বাংলাদেশ থেকে উঠে যেত, ফলে বিদ্বেষ ছড়াবার রাজনীতি শহীদ মিনার থেকে আর বাইরে আসতো না। ঊদীচীর মত একদেশদর্শী সাহিত্যসেবীদের সংখ্যা কমে যেত। বুদ্ধিজীবী, থিংকট্যাংক ও শুশীল সমাজের কথার মধ্যে তখন যুদ্ধ বা যুদ্ধ সংক্রান্ত কঠিন কঠিন শব্দ বন্যা না বয়ে; সুন্দর, সাবলীল, কোমল কাব্যিক ভাষার চর্চা হত অহর্নিশ। গোটা দেশ তাদের পদতলে সুখের স্বপ্নে বিভোর হত, দেশ নবেল বিজয়ের লক্ষ্যে তাড়িত হত, ছাত্র-বৃদ্ধ-যুবাদের সম্মিলিত সাধনা থাকত, “মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ”।

শিবিরকে আর স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি বলে গালি শুনতে হতনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির বিরোধী মোর্চা দেখা যেত না, রাস্তায় রাস্তায় তাদের দিয়ে ‘সকাল বিকাল নাস্তা খাওয়ার’ ডাক শুনতে হতনা। তাদের নিয়ে ডঃ জাফর ইকবালদের চোখে হিংস্রতা দেখে বিবমিষা ভাব আমাদের কেটে যেত, এবং পুলিশের মনে এদের শেষ করার জন্য গ্রেনেড হাতে এগিয়ে আসার প্রয়োজন ফুরিয়ে যেত। শিবিরের ছেলেদের তখন আর লাঠি বৈঠার তান্ডবের নিচে অসহায় শাপ হয়ে মরতে দেখতাম না আমরা। পত্রিকার পাতায় পাতায়, বইয়ের শীরোনামে বা চ্যাপ্টারে ‘তোমরা যারা শিবির কর’ নামের অখাদ্য শব্দের মিনমিনে গান শুনতে হত না। শাহরিয়ার কবিরের মত সাংবাদিকদের খিস্তি খেউড় ও বাংলার মাটি তে গনগণে লাভা তৈরী করতোনা । বিশেষ করে এই সেদিনকার জন্ম নেয়া বাংলাদেশী সন্তান গুলোর ললাটে ‘দেশ বিরোধী’ তকমাটা মুছে যেয়ে, দেশের বিভিন্ন যায়গায় সমান সম্মান ও সুযোগ নিয়ে শিবিরের মেধাবীদের যোগ্য আসন পেতে সমস্যা হতোনা।

বিচারটা হয়ে গেলে কোটি কোটি টাকার রাস্ট্রীয় অর্থ যুদ্ধাপরাধীদের খোঁজ করতে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে, সাক্ষী সাবুদ তৈরী করতে আর ভলিউম ভলিউম এভিডেন্স বানাতে খরচ হতো না। জনগনের ট্যাক্স খরচ করে জিয়াদ আলমালুম দের মত অমেধাবী দের দিয়ে প্রসিকিউটর টীম বানানো লাগতো না। বিদেশে ঘাতকদালাল নির্মূল কমিটিদের সদস্যদের সাথে নিয়মিত হেদায়েত নিতে স্কাইপির পেছনে সময় দিতে হতনা আমাদের বিজ্ঞ, অভিজ্ঞ, নলেজেইবল বিচারকদের। বিচারটা হয়ে গেলে কোর্ট পাড়ায় অত বেশী সিকিউরিটির দরকার লাগতো না, পুলিশের মার মুখী হওয়া লাগতোনা, ডিবি পুলিশের সাক্ষী দের নিয়ে জল্লাদের ভূমিকা, বা কিডন্যাপের দায় গ্রহন করা লাগতোনা। বিচার আমরা চাই, শেষ হয়ে যাক তাড়াতাড়ি। তানা হলে সেইফ হোমসে কাড়ি কাড়ি টাকা নষ্ট হয়েছে, আরো হবে। সাক্ষীদের ঘর বানিয়ে দিতে হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বানিয়ে দিতে হচ্ছে, চাকুরি দিতে হচ্ছে, এবং ঐ সব আকাট মূর্খ সাক্ষীদের পড়াতে যেয়ে জিয়াদ আলমালুমরা জিয়াদ আলমাজহূলে (অর্বাচীন) পরিনত হচ্ছে। সর্বোপরি বিচারটা হয়ে গেলে সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত সমস্ত দ্বিধা বিভক্তির শেষ হয়ে যাবে।

কিন্তু আওয়ামীলীগের বিগত ষাট সত্তর বসরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই বিচার তারা করবেনা। কারণ এই বিচার শেষ হলে তাদের রাজনীতি করার আর কিছুই থাকবেনা। এই জন্য যতজন মন্ত্রী এই সরকারে আছেন, বিচার নিয়ে তত রকম ই কথা তাদের কাছ থেকে আমরা শুনেছি। কেও বলেছেন মানবতা বিরোধী অপরাধের বিচার হবে এই ট্রাইবুনালে। কেও বলেছেন না যুদ্ধাপরাধীদেরই বিচার হবে এখানে। কেও আবার রাজাকার আলবদর দের বিচার করার কথা শুনিয়েছেন। কেও কেও বলেছেন জামায়াত শিবিরেরই বিচার করবেন। আবার প্রধানমন্ত্রীতো একাই বলেন অনেক কিছু। তার আজকের বক্তব্য কখনো কালকের সাথে তুলণীয় হয়না। তাহলে বিচার কার হবে, কিসের হবে, কেন হবে তা স্পষ্ট করার চেয়ে জামায়াত শিবির কেই নিশ্চিহ্ন করার কথা বেশী আসছে কেন? আইনটার নাম আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল। অথচ সেখানে আন্তর্জাতিকতার কিছুই নেই। ট্রাইবুনাল রেজিস্ট্রার রোষের সাথে বলেছেন, “এই আইন দেশীয়”। অথচ আমাদের দেশীয় আইনের অনেক কিছুই এখানে বিলুপ্ত। এই আইন করেছে আওয়ামীলীগ, পাস করেছে আওয়ামী মন্ত্রী পরিষদে, এবং শুধুমাত্র আওয়ামী সংসদে। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে তাহলে এই ধরণের আওয়ামী আইনের দরকার কি ছিলো?

একে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা, বিচারকরা, প্রসিকিউটরেরা এবং সারা বিশ্বের বিভিন্ন আইন সংস্থা কিংবা আইনজ্ঞগণ। একে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে আওয়ামী এমপিরা, আওয়ামী সাক্ষীরা, আওয়ামী বুদ্ধিজীবিরা। মুন্তাসির মামুনের মত ইতিহাস লেখকেরা, শাহরিয়ার কবীরের মত মানবতাবাদীরা, সুলতানা কামালের মত সুবিধাভোগীরা, কিংবা ডঃ আনিসুল হকের মত গবেষকেরা সাক্ষ্য দিতে এসে যা করেছেন তাতে গোটা বিচার প্রক্রিয়াকেকে রাজনৈতিক রং দিয়ে চিত্রায়িত করেছে। প্রজন্মকে হতাশ করেছেন তারা। তাদের ক্রেডিবিলিটিকে তারা নিজ হাতেই জবেহ করেছেন। তদন্তকারী সংস্থার লোকজনকে আওয়ামীলীগার হিসেবেই দেখা গেছে সবক্ষেত্রে।

এমন একটা বিচার এখন চলছে যার বিরোদ্ধে অবস্থান নিতে মন টলেনা, যার বিরুদ্ধে কথা বলতে বিবেক বাঁধা দেয়না, যে ট্রাইবুনালকে বর্জন করাই এখন সময়ের দাবী বলেই মনে হচ্ছে।

বিষয়: বিবিধ

১৬০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File