ইসলামঃ ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণের একটি কর্মসূচী
লিখেছেন লিখেছেন আবু সাইফ ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:১৫:০৪ রাত
ইসলামঃ ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণের একটি কর্মসূচী
শুক্রবারে, যা মুসলমানদের ছুটির দিন, আমি দামেশকের জীবনে লক্ষ্য করতাম এক ছন্দ পরিবর্তন, আনন্দময় উত্তেজনার একটুখানি চাঞ্চল্য, একটা ঝটকা এবং তারই সাথে ভাবের গাম্ভীর্য।
আমার মনে পড়লো- ইউরোপে আমাদের রোববারগুলির কথা- নগরীর নির্জন রাস্তাঘাট এবং বন্ধ দোকানপাটের কথা, সেই সব অর্থহীন শূন্যগর্ভ দিন আর সেই শূণ্যতা যা দুর্বহ পীড়ন এনে দিতো, তার কথা।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এরূপ কেনই বা হবে।
ক্রমে আমার এই উপলব্ধি হতে লাগলোঃ এর কারণ, প্রতীচ্যের প্রায় সকল লোকের কাছেই ওদের রোজকার জীবন হচ্ছে একটি বোঝা, যা থেকে কেবল রোববারগুলিই ওদের দিতে পারে নিস্তার। রোববার এখন আর অবকাশের দিন নয়, বরং তা হয়ে দাঁড়িয়েছে এক অবাস্তত জগতে, এক আত্মপ্রতারণামূলক বিস্মৃতিতে পালানোর একটি উপায়, যে বিস্মৃতির পেছনে উকি মারছে দ্বিগুণ ভারী আর ভয়ংকর বিগত হপ্তার দিনগুলি।
এদিকে, আরবদের কাছে কিন্তু শুক্রবার হপ্তার বাকি দিনগুলি বিস্মৃত হবার একটি সুযোগ নয়; এর মানে এ নয় যে, এ লোকগুলির কোলে জীবনের ফল-ফসল সহজে এবং অনায়াসে ঝরে পড়ে। বরং এর সোজা মানে হচ্ছে- ওদের পরিশ্রম, হোক না কঠোরতম, ওদের ব্যক্তিগত আরজু- আকাঙ্ক্ষার সাথে সংঘাত বাঁধায় না। রুটিনের জন্যে রুটিন এদের জীবনে নেই। তার পরিবর্তে একজন কর্মরত মানুষ ও তার কাজের মধ্যে রয়েছে একটা নিবিড় আন্তরিক যোগ। কাজেই এদের জীবনে বিশ্রামের শুধু তখনি প্রয়োজন হয় যখন ওরা ক্লান্তি বোধ করে।
মানুষ আর তার কাজের মধ্যে সংগতি, এই মিলকে ইসলাম নিশ্চয়ই স্বাভাবিক অবস্থা বলে বিবেচনা করে, আর এজন্যই শুক্রবার বাধ্যতামূলক বিশ্রামের কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। কুটির শিল্পী এবং দামেশক বাজারের দোকানীরা কয়েক ঘণ্টা কাজ করে, কয়েক ঘণ্টার জন্য দোকানপাট রেখে দিয়ে ওরা যায় মসজিদে জুম’আর সালাত আদায় করতে।
তারপর কোন ক্যাফেতে গিয়ে বসে, বন্ধু-বান্ধবদের সাথে সাক্ষাৎ করে। এরপর ওরা আবার ফিরে আসে ওদের দোকানপাটে, নিজ নিজ কাজে। এবং আরো কয়েক ঘণ্টা আনন্দ ও স্ফুর্তির সাথে তারমুক্ত হৃদয়ে ওরা কাজ করে চলে, যার যেমন খুশি। মাত্র অল্প ক’টি দোকানই আমি বন্ধ করতে দেখেছি এবং সে-ও কেবল সালাতের সময়ে, যখন লোকজন গিয়ে জমা হতো মসজিদে। দিনের বাকি সময়ে রাস্তাগুলিতে মানুষ গমগম করে, কর্মমুখর থাকে হপ্তার অন্য দিনগুলির মতোই।
এক শুক্রবারে আমি ‘উমাইয়া মসজিদে’ গিয়েছিলাম আমার এক দোস্তকে নিয়ে, যাঁর মেহমান ছিলাম আমি। মসজিদের গম্বুজ অনেকগুলি স্তম্বের উপর দাঁড়িয়ে আছে; জানালার ভেতর দিয়ে আলো এসে পড়ায় তা ঝলমল করছে। বাতাসে ভাসছে মেশকের খোশবু। মসজিদের মেঝেটি লাল নীল কার্পেট দিয়ে ঢাকা।
দীর্ঘ সমান সমান সারিতে কাতারবন্দী হয়ে লোকেরা দাঁড়িয়েছে ‘ইমামে’র পেছনে। ওরা মাথা নিচু করছে, হাঁটু গেড়ে বসছে ভূমিতে ঠেকাচ্ছে কপাল এবং আবার সোজা হয়ে দাঁড়াচ্ছে; সকলের মধ্যে এক সুশৃংখল ঐক্য, সৈনিকদের মতো। এমনি নিরিবিলি চুপচাপ ব্যাপার।
লোকেরা যখন জামা’আতে দাঁড়ালো, আমি অনেক দূরে। বিশাল মসজিদের ভেতর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম বৃদ্ধ ‘ইমামে’র কণ্ঠস্বর। তিনি কুরআনের আয়াত আবৃত্তি করছিলেন। তিনি যখন মাথা নিচু করছেন বা সিজদায় যাচ্ছেন, গোটা জামা’আতেই একটিমাত্র ব্যক্তির মতো অনুসরণ করছে তাঁকে। আল্লাহর সামনে তারা মাথা নিচু করছে এবং সিজদায় যাচ্ছে, যেন আল্লাহ তাদের চোখের সামনেই রয়েছেন।
ঠিক সেই মুহূর্তে আমি উপলব্ধি করলামঃ এই লোকগুলির কাছে ওদের আল্লাহ এবং ধর্ম কতো কাছের, কতো আপন!
-‘কী বিস্ময়কর! কী চমৎকার!’ আমি আমার বন্ধুকে বলি মসজিদ থেকে বের হতে হতে- ‘তোমরা আল্লাহকে তোমাদের এতো কাছে বলে অনুভব করো! আমার ইচ্ছা হয়, আমি নিজেও যদি ঠিক এরূপ অনুভব করতে পারতাম’।
-‘কিন্তু ভাই, এর চেয়ে অন্যরূপ হওয়াই বা কি করে সম্ভব? আমাদের পবিত্র কিতাব যেমন বলে, “আল্লাহ কি তোমাদের গর্দানের রগের চেয়েও তোমার নিকটতরো নন?’
এই নতুন উপলব্ধিতে চঞ্চল হয়ে আমি দামেশকে আমার প্রচুর সময় ব্যয় করি, ইসলাম সম্পর্কে যখনি যে কিতাব পাই তা-ই পড়ে পড়ে। আরবী ভাষার উপর আমার দখল কথাবার্তার জন্য যথেষ্ট হলেও তখনো তা মূল কুরআন পাঠের জন্য ছিলো খুবই অপ্রচুর। কাজেই আমি দু’টি তর্জমার আশ্রয় নিই- একটি ফরাসী, অপরটি জার্মান। তর্জমাগুলি আমি সংগ্রহ করেছিলাম এক লাইব্রেরী থেকে এছাড়া বাকী সবকিচুর জন্য আমাকে নির্ভর করতে হলো ইউরোপীয় প্রাচ্যাতত্ত্ববিদদের বই-পুস্তক আর আমার বন্ধুর ব্যাখ্যা- বিশ্লেষণের উপর।
যতো আংশিক এবং বিচ্ছিন্নই হোক না কেন, আমার জন্য এই সব পড়াশোনা এবং আলাপ-আলোচনা হলো যবনিকা তোলার মতো- এমন একটি চিন্তার জগৎ দেখতে শুরু করলাম যার বিষয়ে এতোদিন আমি ছিলাম সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
মনে হলোঃ ধর্মকে সাধারণ অর্থে লোকে যা বোঝে ইসলাম সে রকম কিছু নয়- বরং এ যেন এক জীবন-ব্যবস্থা, শাস্ত্রবিধি এ যতোটুকু নয় তার চইতে অনেক অনেক বেশি গুণে, এ হচ্ছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণের একটি কর্মসূচী, যার ভিত্তি আল্লাহর উপলব্ধির উপর প্রতিষ্ঠিত। কুরআনে কোথাও আমি কোন উল্লেখ পেলাম না ‘পরিত্রাণের’ প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে।
ব্যক্তি এবং তার নিয়তির মধ্যে কোন আদি জন্মগত পাপ দাঁড়িয়ে নেই; কারণ মানুষ কিছুই পাবে না যার জন্য সে চেষ্টা-সাধনা করে তা ছাড়া’। পবিত্রতার কোন গোপন প্রবেশদ্বার খোলার জন্য কোন কৃচ্ছব্রত বা সন্ন্যাসের প্রয়োজন নেই- এবং আল্লাহ যে-সব সহজাত কল্যাণকর গুণ দিয়ে সৃষ্টি করেছেন প্রতিটি মানুষকে সেগুলি থেকে বিচ্যুতিই তো পাপ। পাপ তো এছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের প্রকৃতি বিচার করতে গিয়ে কোন দ্বৈতবাদের অবকাশ রাখা হয়নি। দেহ আর আত্মা মিলে এক অখণ্ড সত্তা মনে করে ইসলাম।
প্রথমে আমি কেবল আধ্যাত্মিক বিষয় নয়, বরং আপাতদৃষ্টিতে যা জীবনের তুচ্ছ এবং বৈষয়িক ব্যাপার তা নিয়েও আল-কুরআনের ঔৎসুক্যে চমকে উঠেছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে শুরু করলামঃ মানুষ যদি দেহ আর আত্মা নিয়ে একটি গোটা সত্তা হয়ে থাকে, যা ইসলাম দাবি করে, তাহলে জীবনের কোনদিকই এতো তুচ্ছ হতে পারে না যে, তা ধর্মীয় এখতিয়ারের বাইরে পড়বে।
এ সব বিষয়কে নজরে রেখেই কুরআন কখনো তার অনুসারীদের একথা ভূলতে দেয় না যে মানুষের এই পার্থিব জীবন মানুষের উচ্চতর জীবনের পথে একটি স্তর মাত্র এবং তার চূড়ান্ত লক্ষ্যটি হচ্ছে আধ্যাত্মিক প্রকৃতির। বৈষয়কি উন্নতি ও সমৃধ্ধি কাম্য, কিন্তু তা-ই লক্ষ্য নয়। এজন্য, মানুষের ক্ষুধা-তৃষ্ণার যদিও নিজস্ব যৌক্তিকতা আছে তবু তা নৈতিক চেতনার দ্বারা অবশ্য সংযত ও নিয়ন্ত্রিক করতে হবে।
কেবল যে আল্লাহর সংগে মানুষের সম্পর্কের সাথে এই চেতনার যোগ থাকবে তা নয়, মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের সাথেও এর যোগ থাকবে; কেবল সৃষ্টির সংগেও তার সম্পর্ক থাকবে যা সকলের আত্মিক বিকাশেরও অনুকুল, যাতে করে সকল মানুষই পূর্ণ জীবন-যাপন করতে পারে।
এ সবই ছিলো, এর আগে আমি ইসলাম সম্বন্ধে যা কিছু শুনেছি এবং পড়েছি সে-সব থেকে, মানসিক নৈতিক দিক দিয়ে অনেক বেশি ‘শ্রদ্ধেয়’। আত্মিক জগতের সমস্যাবলী সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভংগী ওল্ড টেস্টামেন্টের চাইতে অনেক বেশি গভীর মনে হলো। অধিকন্তু বিশেষ একটি জাতির প্রতি ওল্ড টেস্টামেন্টের যে পক্ষপাত দেখা যায় এতে তা-ও নেই। তা ছাড়া, জৈবিক সমস্যাবলীর প্রতি এর দৃষ্টি নিউ টেস্টামেন্টের চাইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং খুবই ইতিবাচক। আত্মা ও দেহের সম্পর্ক, দুয়ের প্রত্যেকেরই নিজস্ব বৈশিষ্ট নিয়ে, আল্লাহ-র সৃষ্ট মানব-জীবনর যুগল দিক ছাড়া আর কিছু নয়।
****************
উতসঃ মক্কার পথ - আল্লামা মুহাম্মদ আসাদ
অনুবাদঃ শাহেদ আলী
*********************
বিষয়: বিবিধ
৯৯৫ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার উদ্যোগ ভাইয়া! যাদের বইটি পড়া হয়নি অন্তত এভাবে হলেও কিছুটা স্বাদ উনারা পেয় এযাবেন আর যারা পড়েছি আগে তারাও ঝালাই করে নিতে পারবেন!
উনি আরবদের আতিথেয়তার যে উল্লেখ করেছেন সেটি আমার খুব ভালো লেগেছিলো! পাসপোর্ট নিয়ে যে বিড়ম্বনা এবং জাল করার কৌশল সটি এখনো ভুলিনি!
আরেকটা অধ্যায়- উনাকে যখন বিয়ে করানোর জন্য ছোট একটি মেয়ে আনা হয়েছিলো,বিয়েও করেছিলেন কিন্তু পরেরদিন তালাক দিয়েছেন মেয়েটি অপ্রাপ্তবয়স্কা ছিলো এজন্য এই টুকুও ভালো লেগেছিলো!
আশাকরি নিয়মিত পাব। জাযকাল্লাহ খাইর
কোনটা রেখে কোনটা যে তুলে আনি-
বাছাই করাও বেশ কঠিন!!
উনার দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ এতো গভীর যে, পাঠক মুহুর্তের জন্য অমনযোগী হলে অনেক কিছু হারাবেন!!
আমি মূলতঃ পাঠককে পূরো বইটি পড়তে আগ্রহী করে তুলতে চাচ্ছি!!
অনেক ধন্যবাদ, জাযাকুমুল্লাহ..
আস্তে আস্তে লেখাগুলি পোস্ট করলে
পড়তে পারব।
জাযাকাল্লাহু খায়রান।
সুযোগ করে বইটাই পড়ে ফেলুন, এখানে আছে
মানুষটাও যে অসাধারণ!
মাত্র ২২বছর বয়সের ঘটনা এগুলো!!
জাযাকাল্লাহ...
মন্তব্য করতে লগইন করুন