লক্ষ কোটি মানুষের দগদগে ঘা
লিখেছেন লিখেছেন লাল বৃত্ত ২৩ জুন, ২০১৩, ১১:৫৯:০২ রাত
Grameenphone এর প্রধান কার্যালয়ে হয়ে যাওয়া "আই জিনিয়াস" প্রতিযোগিতার সিনেমাটোগ্রাফি করতে যাওয়ার পথে বাসের জানালায় জ্যামিতিক শহুরেপনা দেখছিলাম, হটাত শুনি কন্ট্রাক্টর তুমুল চিল্লাচ্ছে... পেছনের সিটে বাচ্চা মত কোন একটা ছেলের সাথে, ঝাড়ি দিয়ে নেমে যেতে বলছে। এসব নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়। আজকাল আমরা গ্যাঞ্জামে এত বেশী অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে মোটামুটি আমাদের কানগুলো এখন অনেকটাই অকার্যকর হয়ে আছে।
পিচ্চিটাকে কন্ট্রাক্টর ধাক্কিয়ে উঠিয়েই দিলো, আমারও নামার সময় হয়ে এসেছে, বসুন্ধরার প্রবেশ পথেই নেমে যেতে হবে, পিচ্চিটাকেও এখানেই নামিয়ে দেয়া হবে। আমার পার্শ অতিক্রম করার সময় ওর মাথার বাম পাশ আর বাম হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম। মাথায় একটা বড় ফুটো, সেলাই করা, দগদগে ক্ষত দেখে মনে হচ্ছে ধীরে হলুদ ঘিলু বেড়িয়ে আসছে। কি জানি, হত ঠিক সময়ে ড্রেসিং করা হয়নি বলে ঘা টা পঁচতে শুরু করেছে। বাম হাতের উলটা পিঠে গাছের বাকলের মত মোটা মরা কালো ত্বক দেখা যাচ্ছে।
ছেলেটা এক গাল বাঁকা করে হাসছে। হৃদয়ের ভেতরটা ভয়ংকর এক চিৎকার করে কেঁদে উঠলো, কোন মায়ের সন্তান কে জানে!! হয়ত বাবা মা কেউই নেই তার, হয়ত এক্সিডেন্টের পর রাস্তার লোকজনই ধরে কাছের কোন হাসপাতালে নিয়ে গেছে, হতে পারে ডাক্তার মানবিকতা থেকে কিছু সেলাই করে দিলো।
ছেলেটা কেন হাসছে? এই আঘাত হয়ত তার স্বাভাবিক বোধ বুদ্ধিকে ওলটপালট করে দিয়েছে, ওর তো এই অবস্থায় ব্যথায় কুঁকড়ে থাকার কথা, আমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে, ওর হাঁটার এলোমেলো অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে কোন সময় পড়ে যাবে। ধপ করে দুটো কাঁধ ধরে ফেললাম, বাসের দরজার কাছে যাওয়ার পর কন্ট্রাক্টর আমাকে অতিক্রম করে তাকে ধাক্কাতে লাগলো, আমি কিছু বলার আগেই পিচ্চিটি বাসের দরজার সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রেখেছে, হ্যাঁ সেই এলোমেলো পা। হটাত কন্ট্রাক্টর পা দিয়ে তার পিঠে লাথি দিয়ে তাকে নামিয়ে দিতে চাইলো।
মাথার মধ্যে আগ্নেয়গিরির মত একটা বিস্ফোরণ অনুভব করি। সাধারণত সমাজের নিন্ম আয়ের মানুষদের সাথে আমি বাক্য ব্যয় করিনা, কারণ তাদের শব্দ ব্যবহার এবং আচরণ বেশীরভাগ সময়েই অনিয়ন্ত্রীত। খুব চাবিয়ে চাবিয়ে কনট্রাক্টরকে বললাম এরকম করছ কেন?? সে প্রচণ্ড এক দলা থুথু ফেলার মত কপাল খিচিয়ে বলে, সেই চৌরাস্তা থেইক্কা কইতেছি নামতে, হালারপুতে নামেনাই...
খুব বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি জন্মাল, বলি, ওর মাথায় হাতে আঘাত তুমি দেখোনা??
কোন রিপ্লাইয়ের অপেক্ষা না করেই আমি ওর হাত ধরে নামিয়ে দিলাম। আমার খুব ইচ্ছা করছিলো ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই, একটু চিকিৎসা করাই। কিন্তু ওদিকে এই মাসের খরচাপাতি যোগাড়ের আহবান উপেক্ষা করাও যে অসম্ভব।
আমি মহা মানব হতে পারিনি বলেই সারাটা পথ রিক্সায় বসে চোখ মুছেছি, নিজের অপারগতায় নিজেই অসহায়ের মত কাঁদি। বাম পাশে, হ্যাঁ বাম পাশেই বিশাল যমুনা ফিউচার পার্ক, বিলাসবহুল সুইমিং পুল, কত হাজার ধারণক্ষমতা সম্পন্ন বিশাল সিনেপ্লেক্স, এমিউজম্যান্ট পার্ক। একটু সামনে এগিয়েই ঝকঝকে জিপি হাউস। কার জন্য এত সব আয়োজন, কার বাইরে প্রচণ্ড রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাই, কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এসির হৃদয় জুড়ানো বাতাস ঠাণ্ডা করে দিলো দিল।
আমি কত সুখে আছি, ঐ ছেলেটি এই নগরীতে এখনো প্রচণ্ড রোদের মধ্যেই বোধহয় হাঁটছে... তার সাথে সাথে হাঁটছে লক্ষ কোটি মানুষের দগদগে ঘা। হয়ত ইনফেকশন হয়ে দুদিন পরেই পিচ্চিটি মরে যাবে। কেউ খোঁজও নেবেনা লাশটা কার।
অথবা বহু বছর পরে যখন আমার চুলের মাঝে দু একটা কালো চুল খুঁজে পাওয়া যাবে তখন অফিসের পথে কিংবা কোন এক শুটিং এর মাঝে দেখবো একটি মধ্যবয়স্ক পাগল বসে হাসছে, ঠিক সেই বাঁকা হাসি, যার অর্ধেক উপহাস আর অর্ধেক বেদনায় টইটুম্বুর। আরেকটু ভাল করে খেয়াল করলে হয়ত দেখবো মাথার বাম পাশে একটি ভয়াবহ ক্ষত।
হয়ত সেদিন আমার মনেও থাকবেনা আজকের কথা...
হয়ত তখন আমি অন্য কেউ।
বিষয়: রাজনীতি
২০৭৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন