ইসলামের প্রচার-প্রসারে গণসংযোগের গুরুত্ব ও গণসংযোগকারীর গুণাবলী...
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৯ জুন, ২০১৬, ০৫:২৬:৩১ বিকাল
গণসংযোগ বা মানুষের সাথে যোগাযোগ বা যাকে দ্বীনের দাওয়াত বলা হয়-এক ব্যাপক গুরুত্ববহ কাজ। সাধারণভাবে মানুষের মধ্যে থেকে, তাদের সাথে যোগাযোগ করে ইসলামের প্রসারকল্পে আল্লাহর পথে আহ্বানকে গণসংযোগ বলি। এর মাধ্যমে আল্লাহর সৃষ্ট মানুষকে সামগ্রিক জীবনে পরিপূর্ণভাবে কালজয়ী মতাদর্শ ইসলামকে মেনে চলার আহ্বান জানানো হয়। মানুষের জীবনের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যেমন, ব্যক্তি জীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন এবং আন্তর্জাতিক জীবনের দিকে মানুষকে ইসলামের আলোকে জীবন পরিচালনার দিকে আহ্বান জানানোই গণসংযোগের মূল লক্ষ্য। গণসংযোগ কেবল এককেন্দ্রিক নয়, কুপথে বা অজ্ঞানতার দিকেও হতে পারে। সুপথে চলে ব্যক্তি যেমন মহাপুরষ্কার পেতে পারে, তেমনি জাহিলি ধ্যান-ধারণা গ্রহণ করে তাগুতের পথে চলে তকদিরে জাহান্নামও লিখা হয়ে যেতে পারে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জাহিলিয়াতের দিকে মানুষকে ডাকবে সে জাহান্নামের জ্বালানী হবে। যদিও সে রোজা রাখে, সালাত আদায় করে এবং মুসলিম বলে দাবী করে।” (আহমদ, তিরমিযী) কাজেই একজন সাধারণ মুসলিম হিসেবে ঈমানের দাবী হলো, তাগুতের পথে না চলা, জাহিলিয়াতকে বর্জন করা এবং আল্লাহর পথে চলে নিজেকে মানবতার কল্যাণে সম্পৃক্ত করা।
গণসংযোগকারীদের পরিচয়: তারা দা’য়ী ইলাল্লাহ
‘দাওয়াত ও তাবলীগ’এর মাধ্যমে সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে ইসলামের সঠিক ধারণা দিয়ে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইসলামকে অনুসরণ ও প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালানো সম্পর্কে দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান জানাতে হবে। গণসংযোগের সময় তিনটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
১) সর্বশ্রেণীর মানুষ যারা মুসলমান হিসেবে পরিচিত তাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর গোলামী এবং তাঁর রাসূলের (সা) আনুগত্য করার আহ্বান।
২) আল্লাহর বান্দা হিসেবে প্রাত্যহিক জীবনে কথা ও কাজের মিল রেখে খাঁটি মুসলমান হওয়ার আহ্বান।
৩) সংঘবদ্ধভাবে সমাজকে কলুষমুক্ত করার লক্ষ্যে অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ ও অসৎ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থাজ্ঞাপন।
গণসংযোগ কেন করতে হবে?
একজন মুসলমান হিসেবে অবশ্যই আমাদের একে অপরের সাথে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শক্তিশালী করতে হবে। আল্লাহর বান্দা এবং বিশ্বনবী (সা)এর উম্মত যদি নিজেকে দাবী করি তবে একে অপরের কল্যাণ কামনা করতে হবে। গণসংযোগ মূলত: আমাদের জীবনের মিশন। এ কাজ ছাড়া কোন মুসলমান সফলতা লাভ করতে পারে না। নবীরা ব্যাপকভাবে মানুষের সাথে মিশে কাজ করেছেন, শত প্রতিকূলতার মাঝেও। জেল-জুলুম নির্যাতনের পরোয়া করেন নি তারা। আল্লাহর রাসূল (সা) এ কাজে তায়েফে ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, তিন বছর শি’আবে আবু তালেব গুহায় বন্দীত্ব বরণ করেছিলেণ। হযরত ইউসুফ (আ) জেলে গিয়েও এ কাজ বর্জন করেন নি। হযরত ইবরাহীম (আ) আগুন নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। হযরত মুসা (আ) ফেরাউনের রোষানলে পড়ে দেশান্তরী হয়েছিলেন। রাসূল (সা)এর সাহাবীগণ সাংঘাতিক দমন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। যত বাধাই আসুক মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বানের কাজ বন্ধ রাখা যাবে না। আমরা যদি এ কাজ না করি তাহলে ধ্বংস হয়ে যাব, অথবা আমাদের উপর নিকৃষ্ট শাসক চাপিয়ে দেবেন, এটা রাসূলুল্লাহ (সা) কথা : “তিনি বলেছেন, অবশ্যই তোমরা ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ ও পাপ কাজ হতে নিষেধ করবে। তা না হলে সামগ্রিক আযাবের দ্বারা আল্লাহ তোমাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন। অথবা তোমাদের মধ্যে নিকৃষ্ট ও পাপী লোকদেরকে শাসক বানিয়ে দেবেন। অতঃপর তোমাদের মধ্যে নেককার লোকেরা (তা থেকে বাঁচার জন্য) দু’আ করতে থাকবে। কিন্তু তাদের দু’আ কবুল করা হবে না।’’ (মুসনাদে আহমাদ)
রাসূল (সা) মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বানের কাজ না করার পরিণতি সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন, বনী ইসরাইলের ৩টি দল ছিল। তন্মধ্যে প্রথম দলটি এ কাজকে অস্বীকার করল, দ্বিতীয় দলটি কবুল করল কিন্তু অপরকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেন নি। অন্যদলটি অর্থাৎ তৃতীয় দলটি স্বীকার করল এবং অন্যকেও আহ্বান জানালো । ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় দল দু’টি ধ্বংস হয়ে গেল এবং তৃতীয় দলটি বেঁচে গেলো।”
মানুষকে এ কাজে শামিল না করলে তবে আমাদের ঈমানের দাবী পূরণ হবে না। ইলমের কদর হবে না, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে, আমলের ঘাটতি হবে ও সৎ এবং যোগ্য নেতৃত্ব তৈরী হবে না। সর্বোপরি দুনিয়ার কল্যাণ ও আখেরাতের নাজাত পাওয়া কষ্টকর হবে। সুতরাং দ্বীনের মানবতার কল্যাণের কাজকে জীবনের মিশন হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সেই অনুযায়ী ইলম্ হাসিল করে ঈমান ও আমল বৃদ্ধি করতে হবে। তাই আমাদের আহ্বান হবে আল্লাহর দিকে, সুমহান আদর্শ আল্ ইসলামের দিকে, নবীজি (সা)এর দেখানো পথে এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে।
গণসংযোগের মূল বিষয়বস্তু:
রাসূল (সা) ইসলামী প্রসারের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ৩টি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন। এ দুনিযার পরও আরেকটি জগত আছে এটা বেশি করে স্মরণ করিয়ে দিতেন। এক. তিনি শিরকের বিরুদ্ধে সর্বাধিক সোচ্চার ছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। (অর্থাৎ তাওহীদের প্রতি আহ্বান) দুই. তাঁর রিসালাতের ব্যাপারে আহ্বান জানাতেন এবং
তিন. মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে ধারণা দিতেন। (অর্থাৎ আখেরাতের বিশ্বাসের প্রতি) একদিন এ পৃথিবী ধ্বংস সাধন হবে, সবাইকে পুনরুত্থিত করা হবে এবং আদালত প্রতিষ্ঠা করে বিচার-ফয়সালা করা হবে। কেউ থাকবে সুখময় জান্নাতে আর কেউ চির জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। কিন্তু লোকেরা প্রথম দুই বিষয়ের ব্যাপারে অস্বীকৃতি না জানালেও তৃতীয় ব্যাপারে আপত্তি জানাত। তাদের ধারণা এ অসম্ভব! তাই আমাদেরকেও গণসংযোগে আখেরাতে বিশ্বাসকে বেশি গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। যেহেতু আখেরাতের মুক্তিই আমাদের মুল লক্ষ্য। সুতরাং বলতে পারি এ কাজের মূল বিষয়বস্তু হল: তাওহীদ, রিসালাত এবং আখেরাত।
গণসংযোগের পদ্ধতি বা কৌশল:
আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে,
ادْعُ إِلِى سَبِيلِ رَبِّكَ بِالْحِكْمَةِ وَالْمَوْعِظَةِ الْحَسَنَةِ وَجَادِلْهُم بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ
“উদ’য়ু ইলা সাবিলি রাব্বিকা বিল হিমাতি ওয়াল মাওয়েজাতিল হাসানা ওয়াজা দিলহুম বিল্লাতি হিয়া আহসান।”
অর্থ: ডাকো তোমার প্রভুর দিকে হিকমাত ও উত্তম নসীহত সহকারে এবং লোকদের সাথে বির্তক করো উত্তম পন্থায়।
(সূরা নহল-১২৫)
এ আয়াতে কারীমার আলোকে বলা যায় দাওয়াত দানের ৩টি পদ্ধতি কৌশল আছে। আমরা এ কৌশলগুলো প্রয়োগ করে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকতে পারি।
এক. বিশ্বজগতের মালিকের পথে মানুষকে ডাকতে হবে হেকমতের সাথে
দুই. উত্তম উপদেশ বা সুন্দর সুন্দর কথার মাধ্যমে এবং
তিন. প্রয়োজনীয় বির্তক করতে হবে উত্তমভাবে।
গণসংযোগের দানকারীর বৈশিষ্ট্য:
যে মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকবে তার বৈশিষ্ট্য কেমন হবে? আল্ কোরআনে এরশাদ হয়েছে,
وَمَنْ أَحْسَنُ قَوْلًا مِّمَّن دَعَا إِلَى اللَّهِ وَعَمِلَ صَالِحًا وَقَالَ إِنَّنِي مِنَ الْمُسْلِمِينَ
“ওয়ামান আহসানু কাওলাম মিম্মান দা’য়া ইলাল্লাহ ওয়াআ’মেলা ছোয়ালেহাঁও ওয়াকালা ইন্নানি মিনাল মুসলেমীন।’’
অর্থ: এবং সেই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে, যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, নেক আমল করল এবং বলল আমি একজন মুসলমান। (সূরা হা-মীম সাজদাহ-৩৩)
এ আয়াতে গণসংযোগ দানকারীর বা আল্লাহর পথে আহ্বানকারীর ৩টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে।
এক. দাওয়াত দিতে একমাত্র আল্লাহর দিকে, তার কোন পার্থিব লালসা মনোবৃত্তি থাকবে না। তার দাওয়াত কোন বাতিল মতার্দশ প্রতিষ্ঠার জন্য হবে না। কোন জাহিলি নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠার জন্য হবে না। কারো স্বপ্নকে, কারো বংশ মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠার জন্য হবে না। তার আওয়াজ হবে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, আল্লাহকে ছাড়া অন্য কাউকে ভয় না করার এবং পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভুতি তৈরি করা মানুষের মন ও মগজে।
দুই. তার ব্যবহারিক জীবন হবে ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত।
নেক আমল যেমন: সালাত, সাওম, যিকর, দু’আ, ইসতিগফার, নফল সালাত, নফল সাওম, কুরআন তেলাওয়াত, দান বা সদ্কা, যাকাত প্রদান, পরোপকার, অসুস্থকে দেখতে যাওয়া, সত্য সাক্ষ্য দেওয়া, সৎকাজের আদেশ প্রদান করা, অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখা, অন্যায়ের প্রতিরোধ, কর্জে হাসানা, দাওয়াতী কাজ করা, আমানত রক্ষা করা, জানাযায় অংশগ্রহণ, ব্রীজ, কালভার্ট নির্মাণ, পানীয় সমস্যার সমাধান, বন্যা ও দুর্যোগ কবলিতদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসা ইত্যাদি।
তিন. তার বলিষ্ঠ ঘোষণা সে একজন একনিষ্ঠ মুসলমান। কেবল জন্মগত বা নামে নয়, ঈমান ও আমলে মুসলমান।
গণসংযোগকারীর গুণাবলী:
১। তিনি আল্লাহর শোকর গুজার বা কৃতজ্ঞতা পোষণকারী হবেন।
২। দুঃখ-কষ্ট এবং বিপদে চরম ধৈর্যধারণকারী হবেন
৩। আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল কারী হবেন।
৪। উচ্চ মানের ভদ্রতা ও শালীনতাপূর্ণ চরিত্রবান হবেন।
৫। অবশ্যই ইসলামী জীবন দর্শনের যথার্থ জ্ঞানের অধিকারী হবেন ।
৬। উদার মন, মানবকল্যাণে নিবেদিত প্রাণ এবং নিঃস্বার্থ হবে।
৭। লক্ষ্য এবং চিন্তা-চেতনা হবে সুদূরপ্রসারী।
৮। তিনি হবেন কর্তব্যপরায়ণ, পরোপকারী এবং গণমুখী চরিত্রের অধিকারী।
৯। তিনি ক্ষমা ও বিনয়ের মূর্তপ্রতীক।
১০। একজন আদর্শবান নাগরিক, স্বামী ও পিতা হবেন।
সহায়ক সূত্র:
১। দায়ী ইলাল্লাহ দাওয়াতে ইলাল্লাহ
২। রাহে আমল-আল্লামা জলীল আহসান নদভী
৩। আদর্শ মুসলিম-ড.মুহাম্মদ আলী আল্ হাশেমী
৪। ইসলামী সংগঠন ও প্রশিক্ষণ-অধ্যাপক আবদুল মতিন
======
বিষয়: বিবিধ
১৪০৪ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন