মাতা-পিতার মৃত্যুর পর সন্তানের করণীয় : কুরআন ও হাদীসের আলোকে ..
লিখেছেন লিখেছেন মিনহাজুল ইসলাম মোহাম্মদ মাছুম ১৬ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৩:১৩:৩৮ দুপুর
মৃত্যু এক চিরন্তন সত্য, জীব মাত্রই মৃত্যু অবধারিত। মৃত্যু থেকে কারো রেহাই নেই। সূরা আম্বিয়ার ৩৫ আয়াতে এরশাদ হয়েছে, “মৃত্যুর স্বাদ প্রত্যেককে গ্রহণ করতেই হবে।” (আল কুরআন) মৃত্যু আল্লাহতায়ালার একটি পরীক্ষা। এরশাদ হয়েছে, “তিনি সেই সত্তা যিনি মৃত্যু ও জীবন উদ্ভাবন করেছেন যাতে তোমাদের পরীক্ষা করতে পারেন-তোমাদের আমলের মধ্যে কে উত্তম হতে পারে।” (সূরা মূলক-২) তাই মহাপরীক্ষা জন্য আমল বা কর্মের ব্যাপারে মৃত ব্যক্তির জন্য কী করণীয় কুরআন ও হাদীসের শরনাপন্ন হতে হবে।
মাতা-পিতার মৃত্যুর পর সন্তানেরা আত্মার মাগফেরাতের জন্য কিছু করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে চান। বেশীর ভাগ ছেলে-মেয়ে না জেনে অনেক শরীয়ত বিরোধী কাজ তথা বিদআতের সাথে লিপ্ত হয়। অথচ সঠিক পদ্ধতি জানাটা আমাদের জন্য প্রয়োজন। এ বিষয়ে শরীয়ত কি বলে তা জানা সবার প্রয়োজন।
হযরত আবু উসাইদ (রা) বলেন, আমরা নবী (সা)এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল (সা)! মাতা-পিতার মৃত্যুর পর তাদের সাথে সদ্ব্যব্যবহার করার কোন অবকাশ আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। চারটি উপায় আছে:
১) মাতা-পিতার জন্য দোয়া ও ইস্তেগফার করা,
২) তাঁদের কৃত ওয়াদা এবং বৈধ অসিয়তসমূহ পালন করা,
৩) তাঁদের বন্ধুদের সাথে সুন্দর আচরণ করা এবং
৪) তাঁেদর আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় এবং সুন্দর আচরণ করা।”
(আল্ আদাবুল মুফরাদ-হাদীস নং-৩৫)
দোয়া ও ইস্তেগফার করা :
মাতা-পিতার জন্য দোয়া করার নিয়ম মহান প্রভু আল্লাহ আমাদের শিখিয়ে দিয়েছেন। “রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানী ছাগিরা।” অর্থাৎ : হে আল্লাহ! আমার পিতা-মাতার উপর রহম করো, যেমনি ভাবে তাঁরা ছোট বেলায় আমাদের উপর রহম করেছেন। (সুরা বনী ইসরাইল-২৪) কাজেই প্রত্যেক সালাতের পর আমাদেরকে আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া দোয়া করা প্রয়োজন।
হযরত আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন, মৃত্যুর পর যখন মাইয়্যেতের নেক আমলের পাল্লা ভারী হবে তখন তারা আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করবে কিভাবে এটা হলো? তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে জানানো হবে, তোমার সন্তানেরা তোমার জন্য দোয়া ও মাগফেরাত কামনা অব্যাহত রেখেছিল এবং তা আল্লাহপাক কবুল করেছেন। (আল্ আদাবুল মুফরাদ)
মুহাম্মদ ইবনে সীরিন (রা) বলেন, এক রাতে আমরা আবু হোরায়রা (রা)এর সাথে ছিলাম। তিনি বললেন, “হে আল্লাহ! আবু হোরায়রাকে, আমার মাকে এবং তাদের দু’জনের জন্য যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে, তাদের সকলকে তুমি ক্ষমা করো”। মুহাম্মদ (রা) বলেন, আমরা তার দোয়ায় শামিল হওয়ার আশায় তাদের জন্য ক্ষমা প্র্রার্থনা করি। (আল্ আদাবুল মুফরাদ-হাদীস নং-৩৭)
মাতা-পিতার ওয়াদাসমূহ বা ওসিয়ত পুরণ করা :
এক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে ? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেননা সে মু’মিনা । (সহীহ ইবনে হিব্বান :১৮৯)
পিতার বন্ধুদের সাথে সুন্দর আচরণ করা :
আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ (রা) এর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়াালেন যে গাধায় আব্দুল্লাহ (রা) উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবান দীনার (রা) বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম: আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ: সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায়-(এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ (রা) বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব (রা) এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ’। (সহীহ মুসলিম:৬৬৭৭)
আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা :
রাসূল (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুওর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে।’ (সহীহ ইবন হিববান:৪৩২)
আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী জান্নাতে যেতে পারবে না।”
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আবু আওফা (রা) বলেন, নবী (সা) বলেছেন, “কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মীয় সম্পর্ক ছিন্নকারী থাকলে তাদের উপর আল্লাহর রহমত নাযিল হয় না।” (আল্ আদাবুল মুফরাদ-হাদীস নং-৬৩)
এছাড়া আরও কিছু নেককাজ করলে পিতা-মাতার জন্য পরকালীন কল্যাণ হয়।
১। দান-সদকা :
হযরত আবু হোরায়রা (রা) আরো বর্ণনা করেছেন, রাসূল (সা) বলেছেন, যখন কোন ব্যক্তি মারা যায় তখন তার আমলের সুযোগ শেষ হয়ে যায়। শুধু তিনটি আমল জারি থাকে। এক. সদকায়ে জারিয়া, দুই. উপকারী জ্ঞান, যা থেকে মানুষ উপকৃত হয় এবং তিন. নেক সন্তান যারা ক্ষমা প্রার্থনা করে। (বুখারী ও মুসলিম) হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি বললো, ইয়া রাসুল (সা)! আমার মা মারা গেছেন। তিনি কোন ওসিয়ত করে যান নি। আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান-খয়রাত করি তবে তাতে তার কোন উপকার হবে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। (বুখারী, তিরমিযী ও নাসায়ী)
২। জনকল্যাণমূলক কাজ করা :
মৃত পিতামাতা বা অন্য করো জন্য বিবিধ জনকল্যাণমূলক কাজ করা যায় যেমন : রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-কালর্ভাট তৈরি করা, পানীয় জলের জন্য নলকুপ বা পুকুর তৈরি করা, মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপন করা, জ্ঞান বিতরণকারী শিক্ষা উপকরণ ব্যবস্থা করা, রোগীদের জন্য ঔষধ-পত্র এবং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, দু:স্থ, ইয়াতীমের ভরন-পোষণ বা পুনর্বাসন করা, অন্নহীনকে অন্ন এবং বস্ত্রহীনকে বস্ত্র প্রদান করা। হযরত সা’দ ইবনে উবাদাহ থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূল (সা)কে বললেন, ইয়া রাসূল (সা)! আমার মা ইন্তেকাল করেছেন, তার জন্যে কি ধরনের দান-সদকা উত্তম হবে? রাসূল (সা) বললেন, “পানীয় জলের ব্যবস্থা কর।” হযরত সা’দ তার মায়ের নামে পানির একটি কুপ খনন করে দিলেন। (আবু দাউদ)
৩। হজ্জ না করলে বাকী হজ্জ করা :
হজ্জ ফরয হওয়ার পর শারীরিক বা অন্য কোন কারণে হজ্জ করতে না পারলে অথবা যদি মৃত্যুবরণ করে এবং মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করে যায়, তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে হজ্জ করিয়ে নিলে হজ্জ আদায় হয়ে যাবে। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, “জনৈক মহিলা রাসূল (সা)কে তার পিতার ব্যাপারে প্রশ্ন করলেন, যিনি মৃত্যুবরণ করেছেন অথচ ফরয হজ্জ আদায় করেননি। রাসূল (সা) জবাবে বললেন, “ তুমি তোমার পিতার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করো।” (নাসায়ী)
৪। কর্জ বা ঋণ পরিশোধ করা :
মাতা-পিতার যদি ঋণ গ্রস্ত হয় তাহলে সন্তানের পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে। হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, “ঋণগ্রস্ত মু’মিন ব্যক্তির রূহ তার পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধ না করা পর্যন্ত তার ঋণের সাথে বন্ধক থাকে।”
৫। কবর জিয়ারাত করা :
হযরত আবু সাঈদ কুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেছেন, আমি তোমাদের কবর জিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম, এখন থেকে করতে পার। কেননা তাতে শিক্ষণীয় ব্যাপার আছে। (তিরমিযী)
তবে মহিলাদেরকে অতিমাত্রায় জিয়ারাতে নিষেধ করা হয়েছে।
হযরত আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, “বেশি বেশি কবর জিয়ারাতকারী মহিলাদেরকে আল্লাহর রাসূল (সা) অভিশাপ দিয়েছেন।” (তিরমিযী)
৬। ফরয সাওম কাযা থাকলে তার ফিদিয়া আদায় করা :
হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, তিনি বললেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা)এর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মা মারা গেছেন, তার এক মাসের সাওম কাযা আছে। আমি কি তার পক্ষ থেকে আদায় করবো? ওাসূল (সা) বললেন, হ্যাঁ, আল্লাহর ঋণ পরিশোধ হওয়ার হক বেশি।” (বুখারী) অন্য হাদীসে ফিদিয়া আদায়ের জন্য বলা হয়েছে।
৭। শরীয়তসম্মত মানত পূর্ণ করা:
হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, সা’দ ইবনে উবাদাহ (রা) রাসূল (সা)কে জিজ্ঞেস করলেন, আমার মা মানত রেখে মারা গেছেন। (এখন করণীয় কি?) রাসূল (সা) বললেন, “তুমি তার পক্ষ থেকে আদায় কর।” (বুখারী)
আমাদের সমাজে মৃত ব্যক্তির জন্য কবর কেন্দ্রিক বিভিন্ন মনগড়া রসম তৈরি হয়েছে। যার সাথে শরীয়তের কোন সম্পর্ক নেই। ঐসব রসম শরীয়তকে বিকৃত করছে। তাই যে কোন বিষয় আমল করার পূর্বে তার শরয়ী ভিত্তি আমাদের জানা প্রয়োজন। আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে তাঁর প্রিয়নবী (সা)এর প্রদর্শিত পথে পরিচালিত করুন। আমিন।
=====
বিষয়: সাহিত্য
৬৭৬৩ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার সকল নেক আশা পূরন করুন ও উত্তম প্রতিদান দান করুন । আমীন
চমতকার লেখা লিখেছেন আল্লাহ আপনাকে উত্তম পুরুস্কার দিবেন। গত কয়েকদিন আগে আমার আব্বা মারা গেছেন আমরা চেষ্টা করেছি সবাই মিলে আব্বার অপুরনিয় কাজগুলি সম্পর্ন করতে। দোয়া চাই আমার আব্বার জন্য
"রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা।আমিন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন