দুর্নীতি সম্রাট, লতিফ কাজ্জাবীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় গড়িমসি এবং ধর্মীয় অনুভূতির মামলায় জামিন প্রদান কেন?
লিখেছেন লিখেছেন খান জুলহাস ৩০ নভেম্বর, ২০১৪, ০১:১৬:১৪ দুপুর
বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রায় দুই বছর ধরে অভিযোগ গঠন বিষয়ে শুনানির তারিখ পেছাতে দফায় দফায় আবেদন করে আসছিলেন তাদের আইনজীবীরা। এরপরও দুটি মামলায় সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। আদালত তা নাকচ করে অভিযোগ গঠনের নির্দেশ দেয়।
ইয়াতীমদের সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে পাঠানো দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা ক্ষমতার অপব্যহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করার অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক এ মামলা করে। ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট এ ৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে জমি কেনা নিয়ে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এ মামলা হয়। ২০১১ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় দুদক এ মামলা করে। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়া হয়।
দুটি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং দ-বিধির ৪০৯ ও ১০৯ ধারায় অভিযোগ গঠন করা হয়।
দেখা যাচ্ছে- বর্তমান সরকার, দেশের দু’বার মেয়াদে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক বিরোধীদলীয় নেত্রী, সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদসহ অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তি এমনকি তাদের ক্ষমতাসীন এমপি বদির বিরুদ্ধেও দুর্নীতি মামলা করেছে। আর সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী এখন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও মামলা করেছে। কিন্তু দেশবাসী আজকে বিস্ময় দেখছে যে নাস্তিক মুরতাদ সাবেক মন্ত্রী লতিফ কাজ্জাবীর বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত দুর্নীতির মামলা হচ্ছে না এবং সরকারও গা করছে না।
অথচ মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবী দেশে ফেরার আগেই সব দৈনিকে খবর হয়েছিল- দেশে ফিরলেই দুর্নীতির ‘মহারাজা’ হিসেবে পরিচিত মন্ত্রী লতিফ কাজ্জাবীকে মুখোমুখি হতে হবে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের।
বিগত মহাজোট সরকারের সময় বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় একের পর এক দুর্নীতির মাধ্যমে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারের সম্পদ পানির দরে বিক্রি করেছিল এই মন্ত্রী। সরকারি সম্পত্তি পানির দরে বিক্রি করলেও নিজে হয়েছে বিত্ত-বৈভবের মালিক।
প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে তার দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটির তদন্তেও বেরিয়ে এসেছে তার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিভিন্ন খতিয়ান। ইতোমধ্যে কমিটি কাজ্জাবীর পাহাড় সমান দুর্নীতির প্রতিবেদন জমা দিয়েছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ে।
যাতে মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবীর দুর্নীতির প্রায় অর্ধশত প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তদন্তে বের হওয়া দুর্নীতির এসব অভিযোগের জন্য বর্তমান সরকারের ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবীকে এসব অভিযোগের বিষয়েই জিজ্ঞাসাবাদ করবে দুদক। এর বাইরে এখন সে যে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছে সেখানেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে পুরান ঢাকার কলতাবাজারে ২ মাস রিকশা চালিয়ে খেয়েছি। ... টাকার অভাবে হোটেলে না থেকে বাহাদুর শাহ পার্কে রাত কাটিয়েছি। ... অর্থাভাবে বেশিদূর পড়াশোনা করতে পারিনি। ভাইদের ভাতের ফ্যান খেয়ে বাঁচতে হয়েছে।’
২০১৩ সালের ১৮ মার্চ ঢাকার সিএমএম আদালতে একটি মানহানি মামলার শুনানিতে কথাগুলো বলেছিল বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী। এমন কথা সে টাঙ্গাইলের জনসভায় হরহামেশাই বলে। তাদের বাস্তব অবস্থাও ছিল তা-ই। সেই কাদের সিদ্দিকীরই বড়ভাই মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবী।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবীর বাবা আবদুল আলী সিদ্দিকী স্বাধীনতার আগে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টাঙ্গাইল শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় বসবাস শুরু করে। সে পাট কর্পোরেশনে চাকরি করতো সামান্য বেতনে।
এই টাকা দিয়ে ছেলে মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবী ও আবদুল কাদের সিদ্দিকীসহ অন্য সন্তানদের পড়াশোনার খরচ যোগান দিতে হিমশিম খেতে হতো। পরে আবদুল আলী সিদ্দিকী ওই চাকরি ছেড়ে দিলে দুর্নীতির মামলায় জেল খাটে।
১৯৫৫ সালে সে মোক্তারি শুরু করে টাঙ্গাইল আদালতে। সে সময়ও তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই করুণ। তখন দুই স্ত্রী ও আট ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ যোগাড় করতে পারেনি। সেই সময় মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবী ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করে বাবার সংসার থেকে কিছুটা দূরে চলে যায় আর্থিক সঙ্কটের কারণে। অন্যের আর্থিক সহায়তা নিয়ে মানুষ হয়েছে সেসহ তার চার ভাই ও বোন।
তারা আরো জানায়, মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবী এক সময় টাঙ্গাইল আর্টিজেনের পরিচালক হয়। সেখানে সে সুতা বিক্রি কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতির মাধ্যমে সুতা বিক্রির ঘটনায় তার নামে মামলা হয়। এই মামলায় ১৯৭৫ সালে তার যাবজ্জীবন কারাদ- হয়। ১৩ বছর সে কারাগারেই কাটায়। ১৯৮৮ সালে এরশাদ সরকারের আমলে নির্বাচনে তার স্ত্রী লায়লা টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসন থেকে স্বতন্ত্র এমপি নির্বাচিত হয়। এরপর এরশাদের সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি পায় মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবী। ১৯৯৬ সালে কালিহাতী থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবীর ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৮ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাট ও বস্ত্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পায় টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সংসদ সদস্য মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবী। তার কয়েক মাসের মাথায় স্থান পায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামেও। এরপর থেকে মন্ত্রী তার নির্বাচনী এলাকা কালিহাতীসহ জেলার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি, জমি দখল ও টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। কামিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, ১৯৮৮ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্তও মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবীর দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস ছিল না। সে জেলে থাকার সময় বন্ধু, রাজনৈতিক সহকর্মী ও অন্যদের অনুগ্রহেই তার সংসার চলেছে। ৯৬ সালের আগ পর্যন্ত তার কোনো বৈধ আয়ের উৎস ছিল না। সেই লতিফ কাজ্জাবীর এখন কয়েক হাজার বিঘা জমি, গাড়ি, বাড়িসহ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। কেউ কেউ অভিযোগ করেছে যে, সে বিদেশেও টাকা পাচার করেছে।
কালিহাতি উপজেলায় যমুনা সেতুর পুর্বপাড়ের যোগারচর এলাকায় মুরতাদ লতিফ কাজ্জাবীর সাড়ে চার হাজার বিঘা জমি আছে। তার ছেলে অনিক সিদ্দিকীর প্রতিষ্ঠান ম্যাজিকটিকার নামে এই জমি ক্রয় করা হয়। অনিক এই জমির তদারকির কাজে এখন ঘণ্টায় ৬০ হাজার টাকা ভাড়ায় হেলিকপ্টার নিয়ে সপ্তাহের ২-৩ দিন ওই এলাকায় যায়।
গাজীপুর পাঠাগার করার নামে বন বিভাগের ২০ বিঘা জমি অবৈধ দখল করে নিয়েছে লতিফ কাজ্জাবী। এছাড়া টাঙ্গাইল শহরে শতাধিক শতাংশ জমি রয়েছে।
২০০৯ সালে বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী থাকার সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের নামে জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে। এভাবে বিএনপি ও জামাত সমর্থিতদেরও চাকরি দিয়েছে। এমন হাজার হাজার দুর্নীতির ফিরিস্তি রয়েছে লতিফ কাজ্জবীর নামে।
বিষয়: বিবিধ
৯২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন