চাঁটনি মাখানো আম
লিখেছেন লিখেছেন এস এম আবু নাছের ২৯ অক্টোবর, ২০১৪, ০৪:১৪:০৭ বিকাল
গ্রীষ্মের দুপুর। দাবদাহের সাথে যেন একাকার হয়ে মিশেছে আম-কাঁঠালের সুমিষ্ট সুবাস। বাড়ির পূর্ব পাশে রয়েছে কয়েকটি আম-কাঁঠালের গাছ। আমার পড়ার ঘরটাও ঠিক তার পাশেই। বসন্ত থেকে শুরু করে গ্রীষ্মের শেষ পর্যন্ত এই ঘর আর জানালা ঘেঁষা চেয়ার-টেবিল আমার বেশ পছন্দের জায়গা। আমের মুকুল, কাঁঠালের মোচা আসা থেকে শুরু করে গাছ পাকা আম পড়ার প্রতিটা সময় যেন কাটে এক দারুন অপেক্ষা আর উচ্ছাসে ভরে।
বাড়ির বাইরেই আম-কাঁঠাল গাছে ঘেরা ছাঁইয়া সুনিবিড় এক বাগান। সারাদিন পাড়ার কোথাও বাতাস না পেলেও যেন এই জায়গায় বাতাস পাওয়া যায়। হৃদয় জুরায়। তাই দুপুরের খাবার খেয়ে, অবসন্ন বিকেলে অথবা রাতের প্রথম কিছু অংশে বাগানের মাচা হয়ে উঠে পাড়ার পুরুষ-মহিলাদের জন্য বেশ আড্ডা দেওয়ার জায়গা।
বয়ষ্করা গল্প করতে থাকে আগেকার দিনে কোথায় কোন মাঠে আগুন জ্বলতে দেখা যেত, কার ইরির ধান এবার কেমন হল ইত্যাদি, ইত্যাদি। আর মহিলাদের মধ্যে থাকে গত সপ্তাহে শাবানার কোন সিনেমায় কি দেখেছে তার পর্যালোচনা বা তখনকার সময়ে বিটিভিতে প্রচারিত নাটক ‘এবং বিয়ে’, ‘অন্য কোথাও’, ‘জীবন মোহনা’ বা কোথাও কেউ নেই’ এর মুখরোচক আলোচনা।
কথার মাঝেই হয়ত ও পাড়ার পিলু’র মা একজনকে পাশে খোঁচা দিয়ে বলে-
- ও বু, তুমি ঐ ছবিডা দেখিচিন? ঐ যে শেষ সময়ে ফাঁসি হতে হতেও হয়না। মা যায়ে ওকালিতি করে......ইত্যাদি ইত্যাদি।
আর আমাদের বয়সের ছেলে মেয়েদের তখন একটাই পছন্দ “Adventure of Sindabad”। এ নিয়ে চলতে থাকে কথা। যদিও আমি পছন্দ করতাম “Splelllbinder” টাই বেশি।
দাদু মাস্টার ছিলেন বলে আমাদের বাড়ি মাস্টারবাড়ি নামেই সবার কাছে পরিচিত। আর এ বাড়ির গার্জিয়ান আমার বুবুও তাদের বেশ শ্রদ্ধেয়। দাদু মারা যাওয়ার পরে বুবু একাই আগলে রেখেছেন পুরো পরিবার আর ছেলে মেয়েদের। জীবনযুদ্ধের কঠিন সংগ্রাম করে টিকে রয়েছেন আল্লাহর অশেষ কৃপায়। আজ ছেলেরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় চাকুরি করে। বাড়ি জুড়ে রয়েছি বুবু, আম্মু, আমি, ছোট ভাই রিয়াদ আর ছোট বোন উর্মি। সারাদিন আমাদের সাথে নিয়েই কেটে যায় বুবুর বেলা।
গ্রীষ্মের ছুটির এমনই এক দিনে বসে আছি পড়ার টেবিলে। বাইরে থেকে ডাক এল-
- এই, রিয়াল, রিয়াল। (আমার ডাক নাম)
বুঝলাম বুবু ডাকছে।
- হ্যাঁ বুবু আসছি।
ছোটবেলা থেকে দাদীকে বুবু ডাকতেই শিখেছি আমরা।
- শোন, একটা ঝাঁকা নিয়ে আয়।
বাড়ি থেকে একটা প্লাষ্টিক ঝাঁকা নিয়ে দৌড়ে বাইরে গেলাম। বুঝতে বাঁকি রইলোনা এর পরে কি হবে।
- লগা আনলি? বুবু জিজ্ঞেস করল-(বাঁশ ও তার মাথায় ত্রিকোনা কঞ্চি লাগানো যা দিয়ে আম পাড়তে সুবিধা হয় তাকে আঞ্চলিক ভাষায় লগা বলে)
- নাতো? তুমি বললে আনতে?
- যা, লগাটা নিয়ে আয়। আম পাড়ি। দেখিস আবার লাগেনা যেন।
পড়ার ঘরের জানালার পাশে ছোট একটা আম গাছ। নাম উল্লেখ করার মত তেমন কোন জাত নয়। তবে তার আমের অবয়ব আর পাকলে মিষ্টি লাল গন্ধ সবারই বেশ পছন্দের। আরও একটি বিষয় তা হল- গাছটির আম খাওয়ার সময় বা কাউকে দেওয়ার সময় জনপ্রতি একটা বা দুইটা করে ভালভাবেই হাতে দেওয়া যায়। কখনও বা ডাল এত নিচে আসে যে হাত দিয়েই টেনে পাড়া যায়।
- বুবু, এই যে লগা।
- দে। বলে সামনে এগোতে লাগলো বুবু। আর তার সাথে আমিও।
বুবুর সাথে আম গাছতলায় আসতে না আসতেই গুটুল গাটুল শরীরে দৌড়াতে দৌড়াতে ছোট ভাই রিয়াদের দেখা। তখন পর্যন্ত ও বাড়ির প্রানভোমরা ঐ নাদুস নুদুস পিচ্চিটাই। ছোট বোন উর্মি বাবু তখনও হাঁটতেও শিখেনি।
এদিকে রিয়াদ গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচিয়ে দেখছে যে কোন আমটা পাকা আর কোনটা বা পাকবে আগামী দুই একদিনের মাঝেই। স্কুল থেকে ফিরে বড় ভাই ও দাদীর সহায়তায় তার কাজই এইটা।
ধুপধাপ, ধুপধাপ করে পাকা আম পড়ছে, সাথে কাঁচা আমও রয়েছে। আর গাছতলায় সেই আম কুড়ানোয় আমরা ব্যস্ত দুই ভাই। রিয়াদ কখনও দৌড়িয়ে এসে কোন আম দেখিয়ে বলছে
- বুবু, দেখ কত্ত লাল। খুব মজা।
- হুম, নে কুড়িয়ে নে, কুড়িয়ে নে। আর তোর আম্মুকে বল কয়টা লংকা পুড়ে রাখতে। গিয়েই মেখে খাবো।
রিয়াদ বাড়ি দৌড় দিল আম্মুককে জানাতে আর আমি চিৎকার করতে থাকলাম-
- আম্মু, আম্মু আম্মু- কয়টা ঝাল (মরিচ) পুড়ে রাখ। আমরা আম মাখা খাবো।
- অতো গগাসনাতো (চিৎকার করার আঞ্চলিক শব্দ ‘গগানো’)। রিয়াদ বাড়ি গেছে। ও গিয়ে বলবে বৌকে। পাড়া সুদ্ধ বেবাকে আসবে তোর আম মাখার কথা শুনে। মনে হয় মিলাদ দিবে। আম কুড়া।
আম পাড়া শেষ করে বুবু নিজেই ডাক দিল
- আলম, আলম, এদিকে শুনে যা।
আলম, আমার ফুফাতো ভাই। এ পাড়াতেই বাড়ি। এক ক্লাসে পড়লেও বছর তিনেকের বড় হবে।
- বুবু বলল; নে চল, আজকে এই হবে। আবার কাল পাড়া হবে। আবার কাল দেখা যাবে।
- না বুবু আর কয়েকটা। ও বুবু, ঐ দ্যাখো, ঐ যে ওই ডালে আরও কয়েকটা পাকা আম আছে বুবু। ওগুলোও পাড়।
- তোর অত্যাচারে কাল থেকে আর আমি আম নামাতেই আসবোনা। দেখি তোদের কে পেড়ে দেয়। যে কয়টা কুড়িয়ে পাবি তাই খাস।
তাও বুবু আমার জিদ রাখতে আরও কয়েকটা আম পাড়ল। এদিকে আলম ভাইও এসে গিয়েছে।
- নে তো, ঐ আম কয়টা নিয়ে চলতো বাড়িতে।
আলম ভাই এগিয়ে আসতেই বললাম-
- না, আমিই নিয়ে যাবো। একাই পারবো। যে কয়টা আম।
- পারবিনা ভাই, দে ওকে দে। খাঁচাটা ভেঙ্গে যাবে।
ও কয়টা আম নিয়ে যেতে পারবনা তা নয়, কিন্তু অতি আদরের নাতিকে এতটুকু কষ্টও করতে দিবেনা তাই বুবুর এই অযুহাত। বাসায় ঢুকেই –
- ক্যা বৌ, কই মরিচ পুড়েছো? দাও মরিচ দাও। আর সেদিন তোতা যে দানা গুঁড় আনলো। কই রেখেছো? দাও।
তোতা, আমার মেজো কাক্কু। প্রতিসপ্তাহে চানপুর হাট থেকে কেজি দেড়েক গুঁড় কিনে রাখে শুধু আমার জন্যই বলা চলে। কারন আমি পুরো দস্তুর এক মিষ্টিখোর- বলা চলে গুঁড়খোরও বটে। তাই প্রানাধিক প্রিয় ভাতিজার জন্য বরাদ্দ থাকে এক কেজি গুঁড় যা খালি মুখেই শেষ।
- কই বৌ- দিলে? বলে বুবু আবারও ডাক দিল।
- আম্মু, আম্মু, দাও-
- হ্যাঁ আম্মা, দেই। বলেই হেঁসেল ঘর থেকে আম্মু সব জিনিস-পত্র নিয়ে চলে এলো ডাইনিংয়ে।
একপাশে একটা চৌকি রাখা আছে। যেখানে ছোত বোন তখনও ঘুমাচ্ছে। আর ফাঁকা জায়গাটায় গোল হয়ে বসে আমরা সবাই। বুবু নিজ হাতে আমের খোসা ছাড়িয়ে, চাঁটনী করে গুঁড় দিয়ে মাখিয়ে ডাক দিল আম্মুকে। ততক্ষণে সবার জিভে জল এসেই ক্ষ্যান্ত নয় বরং তা কয়েকবার গলাধঃকরনও করতে হয়েছে বৈকি।
- রিয়াদ ঘর থেকে দৌড়ে গিয়ে একটি বাটি নিয়ে এসে বলল, দাও আমাকে এখানে দাও।
- তিনটি আম তুলে দিয়ে বুবু আবারো বলল- ধর, একটু রস নে। তবে এমনি এমনি বেশি খাসনা কিন্তু। পেট জ্বলবে।
- হুঁম। বলে ঘাড় নাড়ালো রিয়াদ।
আসলে আমের চাঁটনি মাখানো ঐ রসেই যেন মিশে থাকে সব স্বাদটুকু। কিছুটা মিষ্টি, কিছুটা ঝাল যে অমৃত সুধার মত মনে হয় ঐ সময়।
সবাই খাচ্ছে। কেউ উশ... ঊশ... আ... করছে আর কেউ আবার বলছে এত্ত ঝাল দেয়...বাপরে। জব্দ নাড়ির খবর উঠে গেলো।
আর আমি একপাশে চুপ করে বসে ভাগের একটা আম হাতে নিয়ে খাচ্ছি আর অপেক্ষায় আছি সবার ভাগ গুলো ফুরোলে রসসুদ্ধ গামলাটাই দখল করবো বলে। চাঁটনি মাখানো রসের কী যে মজা! আহ!
পাশে থেকে সবার কথাবার্তাই ছোট বোনের ঘুম উধাও। প্যাঁ পোঁ করে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে আমের রস মাখানো আঙ্গুল মুখের কাছে ধরলাম। ছোট ভাই রিয়াদও অনুসরণ করল-
- বাবু, বাবু, খাবে? খাবে? আমরা আম খাচ্ছি। দ্যাখো, কত্ত মজা।
- এই ওর মুখে হাত দিওনা। ঝাল লাগবে। আম্মু শাষিয়ে দিল।
- বুবু বলছে, হাত দিসনা রে ওর মুখে। পেটের দুধ ছানা হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে সবার খাওয়া শেষ। ছোট ভাইটিকে সাথে নিয়ে গামলাটা দখল করে আরও অনেকক্ষণ ধরে চেটেপুটে আম আর রস মিশিয়ে খেলাম দুই ভাই। কী দারুন! কত্ত স্বাদ! আর মজা।
আজ সকালে আলম ভাই এসে কয়টা আম দিয়ে গেছে। এখন ওরাই দেখাশোনা করে বাড়ির সবকিছুর। বুবু মারা যাওয়ার পরে আমরা চলে এসেছি।
দুপুরে আম কেটে দিচ্ছিল আম্মু। এখন বাসায় সেই আগের চারজন- আমি, রিয়াদ, উর্মি বাবু আর আম্মু। বসে আছি আবারও গোল হয়ে। আবারও সেই গাছেরই আম খাচ্ছি। কিন্তু বুবু নেই। প্রতিমুহুর্তের সাথী আমার বুবু আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমাদের প্রতিটি ভালো লাগা আর আনন্দের উৎস যেন হারিয়ে গেছে অজানা কোন এক জায়গায়।
সেই গাছ, সেই আম আজও আছে। কিন্তু নেই সেই আনন্দ, নেই উচ্ছাস আর ভালোবাসা মাখা বুবুর হাতের সেই চাঁটনি মাখা আম---
(পুনশ্চঃ পুরোনো স্মৃতির ঝাঁপি খুলে কথাগুলো লিখেছিলাম গত গ্রীষ্মের এক বিকেলে। আজ ডায়েরির পাতা থেকে তুলে দিলাম সবার সাথে শেয়ার করবো বলে)
বিষয়: সাহিত্য
১৭৮১ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কেন এত আবেগ জড়ানো কথা বলেন আমার তো কান্না পাচ্ছে। ভাবলাম একটু চাটনি খাবো কিন্তু তারপরিবর্তে খেলাম লোনা জল
গরমের দুপুরে কাচা আম
খুব সুন্দর লিখেছেন! অসাধারণ অনুভূতি! ভালো লাগা রেখে যাচ্ছি।
মন্তব্য করতে লগইন করুন