পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-২৯)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৮:০৮:৫৯ সকাল
গ্রামে এসে দেখলাম, এখানেও শোষণ।
সেই নিরন্তর চলে আসা একটা পদ্ধতিগত চক্রে ইচ্ছা অনিচ্ছায় আবৃত কিছু চরিত্র কেবলি সামনে এগিয়ে চলেছে। পেছনের পথ রুদ্ধ। পরিবর্তনের পথে হাজারো বাঁধা। প্রগতি আসার রাস্তা ছিল না।
একটা চলে আসা ‘Systematic Error?’
আমরা তরুণেরা শপথ নিয়েছিলাম। এই ভুলটাকে শোধরাবো।
নগরকেন্দ্রিক জীবনে অভ্যস্ত আমরা কিছু শিক্ষিত তরুণেরা সত্যি সত্যিই দিনবদলের স্বপ্ন দেখেছিলাম। যদিও আমাদের গোপন দলগুলোর তাত্ত্বিকেরা চাইছিলেন আমাদেরকে ব্যবহার করতে। আমরা জেনে শুনেই তাদেরকে সে সুযোগটা করে দিয়েছিলাম। অন্য অর্থে বলতে গেলে, আমরাও তাদের বিশাল নেটওয়ার্ক এবং শক্তিকে আমাদের স্বপ্ন পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলাম।
তবে হৃদয়ে একটা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে।
মিথিলা বাবু!
ইটপাথরের জীবনে প্রাণ ফিরিয়ে দিতে... দৃশ্যমান আলোর গভীরের অন্ধকারকে দূর করতে যখন একটা ‘একমুখী টানেল’ দিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ একটা আঘাত নিজের শেকড়ের কেন্দ্রে টেনে আনতেই দেখলাম- আমি আমার উৎসমূলেই চরম আঁধারে নিস্প্রাণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বুঝলাম নিজ এলাকাতেই আগে বিপ্লব প্রয়োজন। একটা পরিবর্তন জরুরী তবে প্রগতিশীল পদ্ধতিতে।
গর্ভধারিনী বইটি পড়েছিলাম। এ বইটি আমাকে অনেক প্রভাবিত করেছিল। আমি একজন তরুনী এবং কয়েকজন তরুনের দিনবদলের শপথে বলীয়ান হয়ে নিজেদেরকে স্যাক্রিফাইস করার চিত্রটি আমার হৃদয়ে বসিয়ে নিয়েছিলাম। সেই অনুভূতি নিয়ে আমার গ্রামেও আমি একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া এনে দিতে চাইলাম।
ঐ রাতে বাবা আমাকে তার রুমে ডাকলেন। গ্রামে চাচার সাথে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা ধীরে ধীরে আমাকে জানালেন। আমি কোনো মন্তব্য না করে সব শুনলাম। তার কথা শেষ হলে অস্ফুটে শুধু জানতে চাইলাম,’ কি করতে চান এখন?’
বাবা আমার চোখে চোখ রাখলেন। ওনার সেই দৃষ্টির প্রখরতায় আমি নিজের অজান্তেই কেন জানি কেঁপে উঠলাম। এক পলকের জন্য চোখ নামিয়ে নিলাম। আবার যখন তাকালাম, সেই প্রখর দৃষ্টি অনেকটা নরম হয়েছে। আমাকে বললেন, ‘ তোকে আমার সাথে গ্রামে যেতে হবে।‘
একটা অপ্রতিরোধ্য আনন্দে মনটা মুহুর্তে ভরে গেলো। আমার চেহারায় বুঝি সেটা ফুটে উঠেছিল। বাবা জ্বলন্ত সেই আমাকে দেখলেন। কিন্তু এরপর যা বললেন তাতে আমার কিছুক্ষণ আগের আনন্দঘন মুহুর্তটার সলিল সমাধি ঘটল।
‘তুই আমার সাথে যাচ্ছিস, আমি তোর সাথে নই। আমার সাথে আমার ছেলে যাবে, কোনো ‘ভাই’ নয়। তোর গোপন দলবল আর শক্তি এই খুলনাতেই রেখে যাস।‘ আমাকে কিছু বলতে না দিয়েই পাশে রাখা খবরের কাগজে চোখ রাখলেন। মানেটা পরিষ্কার। আর কথা বলার কিছু নেই। আমি কয়েক মুহুর্ত স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। এরপর নিজের রুমের দিকে ফিরে এলাম।
বাবা যতই বলুন না কেন, নিজেকে একেবারে অপ্রস্তুত অবস্থায় যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে যাওয়া যাবে না। সিদ্ধান্ত নিলাম, বাবাকে না জানিয়েই কিছু প্রস্তুতি রাখতেই হবে। আমার নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারটিও ছিল।
মিথিলা বাবু!
তোমাকে আগেই বলেছিলাম, ‘ম’ আদ্যাক্ষরের একজন ১৯৮৭ এর দিকে ডুমুরিয়া এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করে আশপাশের জেলা ও উপজেলায় বিশেষ করে কেশবপুর, তালা, সাতক্ষীরা, ডুমুরিয়া ও খুলনা এলাকায় দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে ভয়ংকর জনপদ হিসেবে চিহ্নিত করে। পরবর্তীতে বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বের হয়ে সে নিউ বিপ্লবী পার্টি গঠন করে। তবে আমাদের গ্রামে তখনো পর্যন্ত কার্যত চরমপন্থি দলগুলো তাদের নেটওয়ার্ককে বিস্তৃত করতে পারে নাই। এই লোকের নামটি ইচ্ছে করেই জানালাম না তোমায়। এদের নামে কিছুই যায় আসে না বাবু। এরা সকলেই কোনো না কোনো একটা ক্যারেক্টার। যে কোনো ভাবেই হোক এরা সকলেই শোষিত হয়েছে। তাই শোষকের বিরুদ্ধে আদি থেকে চলে আসা বিপ্লবের তাড়নায় এরা একেকজন সময়ের প্রয়োজনে উল্লেখযোগ্য চরিত্রে পরিণত হতে বাধ্য হয়েছে। এজন্য এদেরকে বিচার করার সময় আলোর অপর পিঠকে শুধু অন্ধকার না ভেবে যুক্তি দিয়ে সেখানেও আলো খোঁজার চেষ্টা করতে হবে আমার বাবু!
এই গোপন দলটির প্রভাবিত এলাকা থেকে আমাদের গ্রাম বেশী দূরে ছিল না। তবুও যে কোনো কারণেই হোক, এরা তখনো পর্যন্ত আমাদের এলাকায় ঘাটি বানাতে পারে নাই। এলাকাটা ছিল প্রধানত যোগাযোগের দিক থেকে খুবই অনুন্নত। নদী-খাল এবং কাঁচা রাস্তার আধিক্য থাকায় চলাচলে অনেক অসুবিধা হতো। তবে গোপন দলগুলোর নির্বিঘ্নে কর্মকান্ড চালানোর জন্য এর থেকে আদর্শ স্থান আর হয় না। কিন্তু আমাদের এলাকায় নিজেদের ভিতরে যতই অভ্যন্তরীণ গোলমাল থাকুক না কেন, বাইরের যে কোনো গন্ডগোলে এলাকাবাসী সবসময়েই এক ছিল।
তবে এবার বোধহয় সেই একতাকে আর রাখা গেল না।
সামান্য জমির একটা সীমানা আইলকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সংঘর্ষে একটা গ্রাম যে চরমপন্থি দলের একটা ঘেরাটোপে পরিণত হবে... ভেবেছিল কি কেউ? অশান্তির বীজ আগেই বোনা হয়েছিল। এখন চারাও গজিয়ে গেল।
বাবা গ্রামে এসেই সবার আগে নিজেদের লোকদের সাথে কথা বললেন। আমাদের বংশের লোকেরা চেয়ারম্যানদের সাথে সংঘাতে যেতে চাচ্ছিল। নিজেদের উপর আঘাত আসাতে এটা একটা বংশের মান-মর্যাদার ও ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু বাবা সকলকে উত্তেজিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় একটা সমাধান বের করতে বললেন। বড় চাচাও বাবাকে সমর্থন করলেন। তবে যুবক যারা ছিল সবাই উত্তেজিত হলেও বাবার সামনে ওরা অভদ্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটালো না। কিন্তু ওদের মনোভাব আমিসহ অন্যরা জেনে গেলাম। তবে বাবা যা চাইছিলেন সেটাও অনেক চিন্তা-ভাবনা করার পরেই।
আমাদের এলাকার ক্ষমতার চালচিত্রটা একটু যদি গভীরভাবে দেখা যায়, তবে সেদিক থেকে বাবা ঠিকই চিন্তা করেছিলেন। ক্ষমতাসীনদলের রাজনীতির ধারক-বাহক ছিল নুরু খলীফার পরিবার। ওদের বিস্তর জমিজমার সাথে রাজনৈতিক কানেকশনও ছিল অনেক মজবুত। সেদিক থেকে আমাদের গ্রামের পারিবারিক অবস্থান ছিল অনেক নিচুতে। যদিও বাবা শহরে গিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন... খালুর রাজনৈতিক কানেকশন ব্যবহার করা গেলে ওদের সাথে টক্কর দেয়া যায়। কিন্তু আমাদের ছেলেরা ছিল সাধারন যুবক। এরা নিজেদের পরিবারের কর্তাব্যক্তির উপরে আঘাত আসাতে সাময়িকভাবে এখন জ্বলে উঠছে ঠিকই। কিন্তু চেয়ারম্যানদের দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত ক্যাডারদের সাথে সংঘর্ষ হলে এরা কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবে সেটা বাবা বুঝতে পেরেছিলেন।
আর একটা লড়াই শুরু করা যায় অতি সহজেই। তবে সেই লড়াই এর জেরটা রয়ে যায় দীর্ঘসময় ব্যাপী। এলাকায় ওদের সাথে আরো শত্রুতা করে বাস করাই কঠিন হয়ে যাবে। আমাদের পরিবারের নতুন প্রজন্মের উপর ওদের এই চলে আসা শত্রুতা একসময় বিষাক্ত ছোবল হানবেই।
সুতরাং সমাধান ছিল দুটো।
হয় ওদের সাথে মিলে যাও। এজন্য যদি ছোট হতে হয়, তাও হও।
আর না হয় ওদেরকে বংশ সমেত একেবারে নির্মূল করে দাও।
বাবা আজীবন শান্তি চেয়ে এসেছেন। তিনি তো প্রথমটাই চাইবেন। এটাই স্বাভাবিক।
যাহোক, বাবা চেয়ারম্যান নুরু খলীফার সাথে দেখা করলেন। তিনি বাবার সাথে ভালো ব্যবহার করলেন। অথচ এই লোকের সাথেই গোল বাধাতে সেই স্কুল শিক্ষক থাকাকালীন বাবাকে এই গ্রাম ছেড়ে যেতে হয়েছিল। তবে ওনাদের দুজনকে সেদিন অন্তরঙ্গভাবে কথা বলতে দেখে আমার মনে হচ্ছিল,’বাবা কি সেদিনের অপমানের কথা ভুলে গেছেন?’ কিংবা ‘নুরু খলিফাও কি ভুলে গেছেন তার কথা অমান্য করেই বাবা সেদিন সেই মেয়েটির আত্মহত্যাকে ওনার ছোট ছেলের দ্বারা করা মার্ডার বলে আইনকে সামনে নিয়ে দৃঢ় হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন?’
পরক্ষণেই আমার মনে হল, না, ওনারা দুজনেই ভুলেন নাই। বাবা সেই অপমান ভুলেন নাই বলেই আজ নিজেকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পেরেছেন। একজন প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা হয়ে নিজের যোগ্যতাকে প্রমাণ করেছেন। যদিও নিজের স্কুল মাস্টার চরিত্রটিতে সময়ের প্রয়োজনে-টিকে থাকার নিরন্তর প্রয়াস চালাতে গিয়ে দাগ লাগিয়ে ফেলেছেন। একইভাবে নুরু খলীফাও ভুলেন নাই। তাই তার যোগ্যতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে সেরকম যোগ্য ব্যবহারই করেছেন।
বাবা এই সমস্যার কি হাল সেটা জানতে চাইলে চেয়ারম্যান সাহেব জানালেন, সবার আগে মনিরকে নিয়ে আসতে হবে। ওকে নিয়েই বিচার-সালিশ যা হবার হবে। প্রসঙ্গক্রমে বাবা জানতে চাইলেন একটা ব্যাপারে। সেটা হল, চেয়ারম্যানের ছেলেরা আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে এবং চাচাকে অপমান করেছে, যদি আমরা ভুলে গিয়ে একটা আপোষ রফায় আসতে চাই, তবে কি মনিরকে এবারের মত রেহাই দেয়া যায় না? উত্তরে তিনি অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। কিন্তু তার জবাব দেবার আগেই ওনার বড় ছেলে চীৎকার করে উঠে না-বোধক জবাব দেয়। তার দুই ছেলেই মনিরের হাতে মার খেয়ে এখনো মারাত্বক অবস্থায় উপজেলা কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। একজনের একটা চোখ একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তার ক্ষোভটাও বেশী। আর মনিরই আগ বাড়িয়ে কেন মারামারিটা শুরু করলো? যেখানে চেয়ারম্যান সাহেব আসা পর্যন্ত সবাই অপেক্ষা করতে রাজী ছিল? বাবা ওনার কথার উত্তর না দিয়ে নিঃশব্দে ফিরে এলেন।
চলে আসার সময় বাবাকে দু’দিনের সময় দিলেন চেয়ারম্যান নুরু খলীফা। এর ভিতরে মনিরকে সালিশে হাজির করতে না পারলে, তিনি অন্য ব্যবস্থা নিবেন।
বাবা শুধু তার দিকে একবার তাকালেন। কিছু বললেন না।
আমি বাবার সাথে হেঁটে চলেছিলাম। মাটির রাস্তার দু’পাশে বিস্তীর্ণ ধানি জমি। রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন জাতের গাছপালা। কত জাতের পাখির কিচিরমিচির শব্দ মনকে ব্যকুল করে তোলে। নিঃশব্দে বাবার দিকে তাকালাম। কেমন গম্ভীর হয়ে আছেন। আমি হঠাৎ তাঁকে বললাম,’ আমরা খালুকে ব্যাপারটা জানাতে পারি না?’।
আমার কথায় যায়গায় দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। আমার দিকে সোজা হয়ে ফিরলেন। আমার চোখে সরাসরি তাকিয়ে বললেন,’এটা আমাদের লড়াই। ওকে কেন ডাকবো?’
আর দাঁড়ালেন না। সোজা বাড়ির দিকে চলে গেলেন। আমি ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই বাবার বলে যাওয়া কথাগুলোর দ্বারা যা তখনো আমার মস্তিষ্কের কোষে কোষে অনুরণন তুলছিল, ভাবনার অন্য এক জগতে চলে গেলাম।
তাই তো, এ আমার নিজের গ্রাম। আমার জন্মস্থান। অথচ আমি কিছুদিন শহরে কাটিয়েই শহুরে কালচারে অভ্যস্ত এই আমি, আমাদের নিজেদের সমস্যাকে শহুরে ঢঙেই মিটাতে চাইছি? কেন নিজেকে এলাকার মানুষ বলে ভাবছি না? আমিও কি তবে একজন আউটসাইডার হয়েই রয়ে গেলাম?
আমি নিজের ভিতরে এক চতুর্মুখী ভাবনায় আন্দোলিত হতে থাকলাম।
একটা গ্রাম্য মেঠো পথে এক বিষন্ন বিকেলে আমি নিজের ভিতর অন্য একধরণের অনুভূতিতে বিদীর্ণ হতে লাগলাম। আমার কাছে এই অনুভূতি একেবারে অচেনা লাগল। আগে কখনো এমনটি অনুভব করিনি।
সম্পুর্ণ অজানা ভাবে প্রগলভ হয়ে দূরে অপসৃয়মান বাবার অবয়বকে অনুসরণ করে চললাম।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
৭৮০ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একজন 'বাবা' সময়ের সাথে মেপে মেপেই স্বীয় চিন্তা-সিদ্ধান্ত কে চালিয়ে থাকেন! সূদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহনে বরাবরই মুন্সিয়ানা 'বাবা'রাই দেখাতে পারেন!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান মামুন ভাই!!
বারাকাল্লাহু ফীহ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন