চতুর্দিকে আবু জাহেলের উদ্যত নখর, তুমি সেজদায় বেহুশ হয়ে থাকো মুমিন!

লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫, ০৪:২৮:১৮ রাত



আসগর সাপুড়ে ওস্তাদ লোক। মাথায় খড়মের ছাপ ওয়ালা – চক্রধারী কেউটে সাপের দুর্বলতা সে জানে । কোনক্রমে একবার ধরে – পাতিলের মধ্যে অন্ধকারে এক সপ্তাহ বন্দী করে রাখলেই তা প্রায় নিবীর্য হয়ে যায়। চক্কর দেখালেও কামড় দেয় না! এরপর তার বিষদাঁত ভেঙ্গে ফেলে, তপ্ত লোহা দিয়ে মুখে কয়েকবার ছ্যাঁক দিলেই তার কাজ সারা! এবার একটা শিশু ও যদি তার টুথব্রাশকেও ঐ সাপের সামনে এগিয়ে ধরে, কামড় দেয়া দূরে থাকুক, ভয়ে সে পালাতে পথ পায় না!

একই প্রক্রিয়ায় কলোনিয়ালিজম আর সম্রাজ্যবাদের চক্রান্তে বলী হয়ে গেছে এক সময়ের মর্দে মুজাহিদ, মুমিন, মুসলিম সমাজ! প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তার শুরু হয়েছে। যদিও তুরস্ক প্রথমে যুক্ত ছিল না, তুরস্ককে জড়িয়ে ফেলা হয়! সাইকস পিকট চুক্তির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে। মক্কার শরীফ সহ আঞ্চলিকতার অগ্রদূতগন ইঙ্গ ফরাসী শয়তানী চক্রান্ত বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল, অথবা নিজেদের ক্ষমতার লোভ তাদের অন্ধ করে ফেলেছিল! অটোমান শাসনের ইতি ঘটিয়ে মুসলিম বিশ্বকে টুকরো টুকরো করে, পশ্চিমাদের তাবেদার এক সামন্ত শ্রেণীর মুসলিম শাসকদের হাতে নামে মাত্র শাসনের দায়িত্ব দিয়েছে, যারা মুসলিম ভূমিতে পশ্চিমাদের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করবে! এজন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক শয়তান কুরআন হাতে নিয়ে দাখিয়ে বলে উঠেছে, আমরা তুরস্কের উসমানীয় সম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছি! বিচ্ছিন্ন করেছি তাদেরকে তাদের স্পিরিট থেকে- এই কুরআন তাদের স্পিরিট! তারা আর কক্ষনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না! পশ্চিমা সাপুড়েরা আমাদের নিবীর্য করে ফেলেছে !

একসময়ে যারা কেবল আল্লাহ্‌র তাবেদারি করেছে, যাদের কিবলা ছিল ক্কাবা, সেই মুসলিম এখন পশ্চিমা প্রভু খুঁজে নিয়েছে, তাদের ক্কাবা হয়েছে পশ্চিম! এরা ইসলামকে নিবীর্য করে – প্রার্থনা নির্ভর, প্রথা নির্ভর এক ইসলামের বীজ বুনে, তা লোভের পানি আর দুনিয়ার লালচের সার দিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে তুলেছে। মুসলিম নামের এই সামন্ত শাসকগণ ইসলাম থেকে দূরে, তারা বেতনভোগী পেশাদার ইমাম তৈরী করেছে, যারা জমিনে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধিত্ব নয়, ঐ শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে। যেন আরও অনেক পেশার মত ‘ইমামত একটা পেশা মাত্র! আল্লাহ্‌র হুকুমের চাইতে, রুটি রুজীর যোগানদার এই পেশার নিয়োগকর্তার হুকুম তাদের আগে মানার দরকার হয়! নিয়োগকর্তার বিরোধিতা করলে সমূহ বিপদ! আল্লাহ্‌র কাছে সেজদায় পরে মাফ চাইলে আল্লাহ্‌ মাফ করবেন, নিয়োগকর্তা মাফ করবে এই গ্যারান্টি নেই! কাজেই তারা আর সাহসের সাথে ইসলামের সাম্যের বানী কিম্বা জুলুম আর অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য বিশ্ব মুসলিমকে আহবান জানাতে পারে না! তারা নামাজ রোজা হজ্জ যাকাত এর নিয়মিত রুটিন ঘটিত প্রথা গুলো নিয়ে নিজের ঘরে প্রয়োগের কথা বলে, কিন্তু আল্লাহ্‌র আইন দুনিয়ায় বা দেশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কথা বলে না! আর এই ইমামদের পেছনে নামাজ পড়া – মুক্তাদী, আমরা – তাদেরই অনুসরণ করি- “এক্তেদাইতু বেহাজাল ইমাম”! তাই আজকের এই মুসলিম আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে একত্রিত হয় না, প্রতিরোধে বা প্রতিবাদে গর্জে উঠে না বরং নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে সেজদায় পরে যায়, সমস্ত দায় আল্লাহ্‌র ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে! আল্লাহ্‌ তুমি দেখ! আমি নাচার! আজকের মুমিন যেন আল্লাহ্‌র জন্য এক দায়ভার!

এক সময় যারা ছিল কেবল মুসলিম, এখন তারা হয়েছে- আরব, কুর্দি, সিরিয়ান, প্যালেস্টিনিয়ান, পাকিস্তানী, বাংলাদেশী! মিল্লাতে ইব্রাহীম হয়ে, জাতীয়তা ইসলাম না হয়ে, এখন জাতীয়তা কেবল প্রাদেশিক বা আঞ্চলিক জাতীয়তায় রুপ নিয়েছে। তাতে হয়তো সমস্যা ছিল না, কেবল অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের মেরুদণ্ড যদি না ভেঙ্গে যেত, তারা অবিচার আর জুলুমের বিরুদ্ধে –যদি পাহাড়ের মত অবিচল থাকতে পারত ! দুনিয়ার দুই পয়সা লাভের ভয়, অত্যচার – জুলুম বা মৃত্যুভয় তাদেরকে গর্তের মধ্যে লুকোতে যদি বাধ্য না করত!

আজকের মুসলিমের মত, রাসূল (সাঃ) যদি আবু জাহেলের বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি সশস্ত্র মুকাবিলা না করে, – ৩১৩ জন মাত্র সাহাবি নিয়ে সেজদায় পড়ে থাকতেন তাহলে কি ঘটত? কিম্বা চিল্লায় চলে যেতেন অন্যদিকে, যে মানুষ গুলো ইসলাম গ্রহণ করে নাই তাদের দাওয়াত দিতে, কিম্বা মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই বা তাদের সমর্থকদের দাওয়াত দিতে – তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে মসজিদে নিয়ে আসতে?

সেজদায় রাসূল (সাঃ) ঠিকই পড়েছিলেন। তিনি কেঁদেছেন, মিনতির সাথে দুয়া করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য সাজিয়ে, তাদের কাতার বন্দী করে রেখে এসে তিনি আল্লাহ্‌র কাছে দুয়া করেছেনঃ

“হে আল্লাহ্‌! তুমি যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছ তা পূর্ণ কর! হে আল্লাহ্‌! আমি তোমার ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতির পূর্ণতা কামনা করছি”! শত্রু পক্ষের তুলনায় নিজেদের সৈন্যবল মাত্র এক তৃতীয়াংশ! উভয় পক্ষের মধ্যে যখন তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল, তিনি তখনো দুয়া করছিলেনঃ

“হে আল্লাহ্‌! তুমি যদি আজ ঈমানদারদের এ দলকে ধ্বংস করে দাও, তবে এ জমিনে আর তোমার ইবাদত করা হবে না! হে আল্লাহ্‌! তুমি কি এটা চাও যে আজকের পর আর কখনও তোমার ইবাদত করা না হোক!”

তিনি বিনয়ের সাথে, এত আত্মনিমগ্ন হয়ে, এত আকূল হয়ে প্রার্থনা করছিলেন যে তার কাঁধ থেকে চাদরটা পড়ে গেল এবং তিনি তন্ময় ভাবে প্রার্থনা করেই চললেন! এ অবস্থা দেখে আবু বকর (রাঃ) ছুটে এসে চাদর খানা তুলে তার গায়ে জড়িয়ে দিলেন আর তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলেনঃ ইয়া রাসুলুল্লাহ! যথেষ্ট হয়েছে! বড়ই কাতর কণ্ঠে আপনি প্রতিপালকের নিকটে প্রার্থনা করেছেন! এ প্রার্থনা ব্যর্থ হবে না! শীঘ্রই তিনি তার ওয়াদা পূর্ণ করবেন!

আজ আমাদের মুমিন মুসলিম সেই নিবীর্য, বিষহীন – ঢোরা সাপ হয়ে গেছে ! তাদের ঈমানের এমন জোর নেই যে, জুলুম আর অন্যায়ের প্রতিরোধ দূরে থাকুক, প্রতিবাদের ভাষাও তাদের স্তব্ধ হয়ে গেছে! যদি এই সাধের চাকুরি চলে যায়, আমার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়! আমার সাধের জীবনটা চলে যায়! দুই পয়সার জীবনের দাম কি এতই বেশী! আল্লাহ্‌ তো কুরআনে সে ডিক্রি ও জারী করেছেন- আল্লাহ্‌ তো আমার জান মাল খরিদ করে নিয়েছেন, জান্নাতের বিনিময়ে! ঐ জান তো আমার নয়!

আমাদের সেজদাকারীর সংখ্যা বেড়েছে এবং ক্রমেই বাড়ছে, আলহামদুলিল্লাহ্‌! মসজিদ গুলোতে স্থান সঙ্কুলান হয় না জুম্মার দিন। কিন্তু চোখের সামনে আমার আরেক ভাই জুলুমের শিকার হলেও – আমি তা পাশ কাটিয়ে মসজিদের দিকে জোরে দৌড়াই – যেন নামাজের জামাত না ছুটে যায়! নাকি দায়িত্ব এড়িয়ে পালিয়ে যাই! অবশ্য সেটাই সহজ! মসজিদে বসে দুনিয়ার সমস্ত অন্যায়, জুলুম আর অনাচারের বিরুদ্ধে আল্লাহ্‌র কাছে হাত তুলে প্রার্থনা করব! সেজদায় পড়ে বেহুশ হয়ে যাব! চারিদিকে আবু জাহেলরা অত্যাচার, অবিচার আর জুলুমের লাল আগুনে পুড়িয়ে মারছে আমার ভাইকে, ধর্ষণ করছে তোমার বোনকে, লক্ষ লক্ষ মুসলিম আজ গৃহহীন, উদবাস্তু রিফিউজি, বোমারু বিমান, ড্রোন হামলা, আল গারিব- গুয়ান্তানামো – ফিলিস্তিন, কাশ্মির- আফগানিস্থান, ভারত, পাকিস্থান, বাংলাদেশ, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, শিয়া সুন্নি- আরব কুর্দি, মরছে মুসলিম! যখন তখন! তুমি সেজদায় বেহুশ হয়ে যাও, মুসলমান! কিম্বা লেখো প্রেমের উপন্যাস !

এ লেখার উদ্দেশ্য সেজদার শক্তিকে খাটো করে দেখা নয়, সেজদা তো মুমিনের দৈনন্দিন জীবনের এক অতি জরুরী অনুষঙ্গ, মাছের ফুল্কা দিয়ে মাছ যেমন পানির মধ্যে অক্সিজেন সংগ্রহ করে, একজন মুমিন তো তার সালাত, তার সেজদা আর দুয়ার মাধ্যমে ঈমানের শক্তি আর মজবুতি সংগ্রহ করবে, আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করবে! সেজদায় গিয়ে এমন বেহুশ হয়ে নিজের দায়িত্ব ভুলতে চাইবে – এই পলায়নবৃত্তির জন্য তো সেজদা নয়! আমরা কি শুধু ইসলামের প্রথা (Ritual ) টুকুকে গ্রহণ করছি, পার্ট টাইম চাকুরীর মত পার্ট ইসলাম! এর মূল সূর আমাদের কাছে অধরাই থেকে যাচ্ছে! ইসলাম ধরেছি কেবল ইসলামের স্পিরীট বাদ দিয়ে!

একজন মুমিন তো দুনিয়াতে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি, দুনিয়াতে সে আল্লাহ্‌র আইন প্রতিষ্ঠা করবে নিজের বাহুবলে, আল্লাহ্‌র শাসন কায়েম করবে দুনিয়াতে – জুলুম অত্যাচার আর অনাচারের নিঃশেষ করবে, নির্যাতিত মানুষের – পাশে দাঁড়াবে, আর্ত বিশ্ব মানবতার সেবা করবে! আজ কোথা সে মুসলমান!

বিষয়: বিবিধ

১২৯১ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

303064
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০৪:৫৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : Chalam vaiya. Mashallah-mashallah very strong writing. I do believe and expect Muslim ummah will wake up vaiya. Jajakallahu khair.
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০৩:৩৭
245322
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : সালাম! অনেক ধন্যবাদ !
303071
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৫:৫৫
শেখের পোলা লিখেছেন : আরাফাতের সমাবেশ কিংবা ইজতেমার সমাবেশীরা যদি এক কমাণ্ডারের অধীনে এক হয়ে ইসলামের আসল কর্তব্যের দিকে এগিয়ে যেত, তবে কি হত ভাবা যায়!
০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:১২
245585
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : মানুষকে ‘আক্কল ব্যবহার করতে আল্লাহ্‌ পাক আদেশ করেছেন, উৎসাহিত করেছেন ( আফালা তাক্কিলুন!) । প্রশ্ন করেছেন, কেন সে আক্কল ব্যবহার করে না, কেন চিন্তা করে না!
আমি আপনি চিন্তা করছি, অন্যরাও করবে আশা করা যায়
303074
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৭:১১
দ্য স্লেভ লিখেছেন : ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এক শয়তান কুরআন হাতে নিয়ে দাখিয়ে বলে উঠেছে, আমরা তুরস্কের উসমানীয় সম্রাজ্য ধ্বংস করে দিয়েছি! বিচ্ছিন্ন করেছি তাদেরকে তাদের স্পিরিট থেকে- এই কুরআন তাদের স্পিরিট! তারা আর কক্ষনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না! পশ্চিমা সাপুড়েরা আমাদের নিবীর্য করে ফেলেছে !
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০৯:৩৩
245211
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : এখন সময় হয়েছে---!
303075
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৭:২৫
মোতাহারুল ইসলাম লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম। খুব সুন্দর সময়োপযোগী পোস্ট দিয়েছেন। ধন্যবাদ।
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০৯:৩৩
245213
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ !
303088
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ সকাল ০৯:৪১
ঈগল লিখেছেন : বাহুবলে!! গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে (এই ব্যবস্থায় স্থায়ী সত্য বলে কিছু নেই, আজ সেটা চূড়ান্ত কাল সেটা প্রত্যাখাত) আমরা আমাদের উথানের সিড়ি ধরে নিয়েছি। আরেক দল আবার শুধু দাওয়াহ নিয়ে ব্যস্ত (তাবলীগ জামাআত এবং আহলে হাদিস।)

মজার ব্যাপার হচ্ছে উপরের তিন গোষ্টীই সংখ্যাগরিষ্ঠে বিশ্বাসী।
=================
303124
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ দুপুর ০২:৫৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : শুধু আবেগ দিয়ে তো এই সত্য কে প্রতিষ্ঠিত করা যাবেনা
303168
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ রাত ০৯:৩৫
তিমির মুস্তাফা লিখেছেন : ঠিক! আবেগের সাথে বেগ ও দরকার!

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File