Rose Good Luckভালবাসার সাতকাহন (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৯) Rose Good Luck

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২১ অক্টোবর, ২০১৪, ০১:৩৪:৩৯ দুপুর



Good Luckবন্ধের দিনটা শাহেদের কাটে পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে। সদস্য বলতে মোটে তিনজন। বিথী, সে আর ওদের একমাত্র সন্তান মিনহাজ।

মিনহাজুল করীম অন্তর।

শাহেদ ওর বাবার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে। আর বিথী ছেলের ডাক নামটি নিজের পছন্দে রেখেছে। এই নাম রাখা নিয়েও কত কি!

জীবন এতো জটিল কেন?

শাহেদ যত সহজভাবে জীবনকে পেতে চায়, ততই পদে পদে জটিলতা এসে ভীড় করে।

উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে থাকে ওরা। তিনজন সদস্যের জন্য ফ্ল্যাটটি অনেক বড় হয়ে যায়। কিন্তু বিথীর কথা একটাই। স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হবে। বিথীর ভিতরে দেখানোর প্রবনতা অনেক বেশী। আর এই প্রবনতা ধীরে ধীরে বিথীর ভিতরে এমন এক মানসিকতার জন্ম দিয়েছে যে, ওর কাছের মানুষেরাও কিভাবে যেন দূরে সরে যাচ্ছে।

কিন্তু তাতে বিথীর কিচ্ছু যায় আসে না। সে তার নিজের চাওয়া-পাওয়ার গন্ডীকে নিজের মত করে নিয়েছে। স্বামী-সন্তান আর নিজেকে ঘিরেই ওর পৃথিবী। সেখানে চতুর্থ কারো ঠাই নেই।

এভাবেই চলে যাচ্ছে সময়।

একটু আগে প্রাতঃভ্রমণ সেরে এসেছে শাহেদ। বিথী কিচেনে। ছুটা কাজের লোকের সাথে ব্যস্ত। শাহেদের জন্য নাস্তা তৈরী করছে। অন্তর নিজের বিছানায়।

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে শাহেদ। আজ একটু বেশী সময় ঘুমাচ্ছে ছেলেটা। ওরও তো আজ বন্ধের দিন। ক্লাশ ওয়ানে পড়ে। উত্তরারই একটি নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে সে। এই বয়সেই এতো বেশী চাপ সহ্য করতে হচ্ছে বেচারাকে।

থাক, আর একটু ঘুমাক। নাস্তা তৈরী হলেই ডেকে তোলা যাবে ভেবে শাহেদ বারান্দায় চলে আসে।

ওদের ফ্ল্যাটটি এই কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলায়। বারান্দায় এলেই শাহেদের মনটা জুড়িয়ে যায়। বহুদূর পর্যন্ত এখান থেকে দেখা যায়। দু'পাশে সারি সারি বিল্ডিং। ইটপাথরের নগরজীবন! এরই মাঝ দিয়ে লম্বা কালো পীচ ঢালা মহাসড়কটি চলে গেছে বহুদূর। এই সকালেও রাস্তায় গাড়ি-ঘোড়ার ভীড় দেখতে পেল।

আচ্ছা, গাড়ির সাথে ঘোরা শব্দটিও কেন মনে এলো? ঘোড়া কি রাস্তায় সচরাচর দেখা যায়? সেই গুলিস্তানে গেলে পুরনো ঢাকার পথে পথে এখনো কিছু ঘোড়ার গাড়ি চোখে পড়ে অবশ্য।

নীচের দিকে তাকায়।

একটা দৃশ্য দেখে শাহেদের খুব ভালো লাগে। একজন বাবা তার ছেলেকে কাঁধে চড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। ছেলেটি ওর বাবার কাঁধের দু'পাশ দিয়ে পা দু'টি ঝুলিয়ে দিয়েছে। কত নির্ভয়ে রয়েছে ছেলেটি! আর ওর বাবাও কি স্বাচ্ছন্দ্য গতিতে এগিয়ে চলেছেন ছেলের সাথে খুনসুটি করে করে। কেন জানি শাহেদ দৃশ্যটি থেকে নিজের চোখ ফেরাতে পারে না। আজকাল এমন দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়। মোড় ঘুরে তাঁরা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত একভাবে সে তাকিয়ে থাকে। একসময় চোখ জ্বালা করতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।

বুকের ভিতরেও কি একটু জ্বালা করে উঠে?

বেশ আগের কথা মনে পড়ে যায় শাহেদের।

নিজের বাবার হাত ধরে ঘুরে বেড়ানো... বিছানায় শুয়ে থাকা বাবার দু'পায়ের পাতায় চড়ে দোল খাবার নস্টালজিক মুহুর্তগুলো... বাবার শরীরের বড্ড চেনা সেই ঘ্রাণ... আদর মাখা জনকের শরীরের উত্তাপ আজ এই কার্ত্তিকের এক শীতল ভোরে ওর চেতনায় বড্ড মূর্ত হয়ে উঠে!

কি করছে বাবা এখন?

তিনিও কি ওর কথা ভাবছেন?

এই চিন্তাটা শাহেদকে দম বন্ধ করা এক কষ্টকর অনুভূতিতে বিলীন করে দেয়। মোবাইল হাতে নিয়ে অতি পরিচিত নাম্বারে ডায়াল করে।

কয়েকবার রিঙ বাজতেই ওপাশ থেকে বাবার গলার আওয়াজ শুনতে পায়-

: হ্যালো, কে শাহেদ?

: হ্যা বাবা! তুমি কেমন আছ?

: আলহামদুলিল্লাহ! তোরা সবাই ভালো আছিস? বউমা কেমন আছে?

: আমরাও সবাই ভালো আছি বাবা।

: আমার দাদা ভাই কোথায়?

: ও এখনো ঘুমে। কথা বলবে?

: না, থাক। ঘুমাক। আমি পরে ফোন করব।

: আচ্ছা বাবা। মা কোথায়?

: আমার পাশেই আছে। নে, কথা বল।

কয়েকমুহুর্ত চুপচাপ কেটে যায়। পরক্ষণেই মা কথা বলেন,

: হ্যালো।

: হ্যা মা। ভালো আছ তুমি?

: আছি বাবা। তোরা ভালো আছিস?

এভাবে বাবা-মা'র সাথে মোবাইলের মাধ্যমে শাহেদের সাথে যোগাযোগটুকু রয়েছে। প্রতিদিনই সে কয়েকবার ওনাদের সাথে কথা বলে। অদৃশ্য এই যোগসূত্রটিকে সে কঠিনভাবে ধরে রেখেছে। নিজের জীবিকার প্রয়োজনে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাতে হয় শাহেদকে। তারপরও বাবা-মা'র উপস্থিতি সে নিজ হৃদয়ে ধারণ করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। মোবাইল ফোন এই কাজটি করতে ওকে সাহায্য করে। দুই ঈদের একটি সে গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের সাথে করে। অন্যটি বিথীর বাবা-মায়ের সাথে। ওনারা চট্টগ্রামে থাকেন। কালে ভদ্রে ঢাকায় আসেন তাঁরা। তখন বিথীর সময়গুলো খুব ভালো যায়। তবে তার মানে এই নয় যে, এখন বা বছরের অন্য সময়গুলো বিথীর খুব খারাপ কাটে। শাহেদও সময়টা খুব উপভোগ করে। ওদের শূন্য ফ্ল্যাটটি তখন বেশ জমে উঠে।বিথীর আনন্দে শাহেদও আনন্দিত হয়।

কিন্তু বিথী কি শাহেদের আনন্দকে এভাবে উপভোগ করে?

সে কি আসলেই জানে কিসে শাহেদের আনন্দ?

কিংবা শাহেদ কি চায়?

সেভাবেই কখনোই কি বিথী ভাবে?

তবে এগুলো নিয়ে শাহেদ দুঃখ করে না। সে খুবই বাস্তববাদী মানুষ। যথাসম্ভব সব দিক মানিয়ে চলার চেষ্টা করে। সংসারের সুখ শান্তি যাতে বজায় থাকে,সেই চেষ্টাই করে যায় সবসময়। শাহেদের জীবন দর্শণ হল, এক একটি দিন করে করে বেঁচে থাকা...সবাই মিলে... আনন্দের সাথে।

: নাস্তা দিয়েছি। খাবে এসো। বিথীর ডাকে ভাবনার জগত থেকে শাহেদ ফিরে আসে। প্রবেশ করে ওর নিজের তিন সদস্যের একান্ত ভূবনে। ডাইনিং টেবিলে বসে মোবাইল সেটটি পাশে রাখতেই বিথী জিজ্ঞেস করে,

: কার সাথে কথা বললে?

: বাবা-মা'র সাথে।

: ও।

ব্যস। এইটুকুই। বিথী শাহেদের বাবা-মায়ের ব্যাপারে কখনোই এর বেশী আগ্রহ দেখায় না। এই একটি শব্দ 'ও' অনেক অপ্রকাশিত কথাকেই তুলে ধরে যেন। ছোট্ট একটি শব্দে বিথীর শ্বশুর শ্বাশুড়ির ব্যাপারে ওর নির্লীপ্ততারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ঠিক এই মুহুর্তগুলোতে শাহেদ দীর্ঘশ্বাসও ফেলে না। বিথী সব লক্ষ্য করে। শাহেদের ব্যাপারে সব কিছুই সে সুক্ষ্ণ ভাবে অনুভব করে। তাই নিজের কষ্টগুলোকে শাহেদ বড্ড নির্মমভাবে গিলে ফেলে। হৃদয়ে কষ্টকর অনুভূতিগুলোর নগ্ন খোঁচাগুলোও সে সহ্য করে যায় হাসিমুখে।

বিথী কি এসব বোঝে?

মহানগরের একটি সুদৃশ্য ফ্ল্যাটে এক দম্পতি নিজ নিজ চিন্তা-চেতনায় বেঁচে থাকে... যার যার মত করে। জীবনের আসল দিকটি এখন আয়নার অপর পীঠে পরিণত হয়েছে যেন। তাই ইদানিং বিপরীত দিকটিকেই আসল ভেবে নিরন্তর এক যান্ত্রিক সুখানুভূতিতে ভেসে যেতে যেতে ওরা নিজ নিজ হৃদয়ের ওপরেও কেমন এক প্রলেপ ফেলে যাচ্ছে। আয়নার পিছনের পারদের মত। তাই এখন সেখানে নিজেদেরকে ছাড়া অপর কেউই আর তাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। নিজেদেরকে নিয়েই ভীষণ ব্যস্ত তারা। তবে শাহেদ এই মুখোশ জীবনের ভিতরেও আরো একটি মুখোশ পরে থাকে। তবে সেই মুখোশটি আসল। আর মেকী মুখোশ থেকে সময়ে সময়ে সে বের হয় এবং জীবনের আসল দিকটি দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু বিথী এসবের কিছুই জানতে পারে না।

আসলে সে জানার চেষ্টাই করে না।

জীবনের একমুখী রাস্তায় একেলা ড্রাইভ করতেই সে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। Rose Good Luck

(ক্রমশঃ)

বিষয়: সাহিত্য

৮৯৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

276693
২১ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০১:৪৫
আফরা লিখেছেন : ভাইয়া আপনার এই গল্পে সংসারের বাস্তব চিত্রটা ফুটেছে । অনেক ভাল হয়েছে ।
২১ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০১:৫৯
220662
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে।
কয়েকটি পরিবারের ভিতরের কিছু একটা বের করে আনতে চাচ্ছিলাম, যা আমাদের চারপাশে রোজই দেখতে পাই।
ভালোলাগার অনুভূতি রেখে গেলেন, অনেক শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
276710
২১ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০২:১৮
কাহাফ লিখেছেন :
ভাল লাগার অনুভূতি সব সময়ে বজায় রাখতে পারি না। আপনার অসাধারণ লেখনী অনুভূতির দরজা ডিংগিয়ে উপলব্ধিতে নাড়া দেয়। বাস্তবিকের নান্দনিক রুপায়ণ একটা অভাব কে জাগিয়ে তুলে যেন.......।
পরিকল্পিত চিন্তা কি পাল্টে যাচ্ছে.......!!
Rose Rose Rose
২১ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৫:০৪
220775
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর অনুভূতি রেখে যাবার জন্য।
তবে আমার মনে হয়, এই পরিকল্পিত চিন্তা যে পাল্টে যাচ্ছে মনে হচ্ছে, এটা হয়তো সাময়িক। তাই ও নিয়ে চিন্তা-ই করার প্রয়োজন নেই।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck
276754
২১ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ০৩:৩১
ঘাড় তেড়া লিখেছেন : ভালো লাগলো তাই পিলাচ ও অনেক ধন্যবাদ।
২১ অক্টোবর ২০১৪ বিকাল ০৫:০৫
220776
মামুন লিখেছেন : ভালো লাগার অনুভূতি রেখে যাবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
আমার ব্লগে আপনাকে স্বাগত!
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File