ফেরা (ছোট গল্প)

লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০২:০২:০১ দুপুর



Roseএকটু আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে।

রাস্তাটা কাঁদা না হলেও পিচ্ছিল হয়ে গেছে।এর ভিতরেই লাইন দিয়ে সবাই খালের দিকে আগাচ্ছে। লঞ্চ আসার সময় হয়ে গেছে। যে কোনো সময় ছোট্ট লঞ্চটি খালের বাঁক থেকে বের হবে। মা ছেলের শরীরের সাথে মিশে আছেন। বাবা এবং ভাই-বোনেরাও মন খারাপের চূড়ান্ত অবস্থায় দুজনকে অনুসরণ করছে। দূর থেকে লঞ্চ আসার পরিচিত শব্দ শোনা গেলো।

ছোট্ট একটা লাগেজ। সদ্য সাবেক হওয়া এ.এস.পি মাহবুব বুকের সাথে লেপ্টে থাকা মাকে এক হাতে এবং লাগেজটি অন্য হাতে ধরা অবস্থায় বাবার দিকে অসহায় ভাবে তাকায়। ছেলের চোখের ভাষা বাবা বুঝতে পারেন। এগিয়ে আসেন। মাহবুবের ক্রন্দনরত মাকে একটু জোর করেই ছেলের থেকে সরিয়ে আনেন। ভাই-বোনেরাও কাঁদছে। সবাইকে ছেড়ে কাল মাহবুব দেশের বাইরে চলে যাবে। তাই গ্রামের বাড়িতে দেখা করতে এসেছিল। সবাই অবশ্য এয়ারপোর্টে ওকে বিদায় জানাতে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু মাহবুব নিজেই নিষেধ করেছে। মাকে ছেড়ে ঘাটে অপেক্ষমান লঞ্চের কাঠের সিড়ি বেয়ে লাগেজ হাতে মাহবুব লঞ্চে উঠে যায়। পরিচিত সুকানি ওকে দেখে সালাম দেয়। হাত থেকে লাগেজ নিয়ে নির্দিষ্টি একটি যায়গার দিকে রওয়ানা হয়। মাহবুব লঞ্চের খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে পরিবারের সব থেকে আপনদেরকে বিমর্ষ অবস্থায় দাঁড়ানো দেখতে পায়। হাত নাড়ে... তারাও প্রতিউত্তর দেয় হাত নেড়ে। লঞ্চটি একটা ইউ-টার্ণ দিয়ে সামনের অনিশ্চিত গন্তব্যের পানে এগিয়ে চলে। পিছনে কিছু প্রিয় মানুষদেরকে ফেলে রেখে যায়। যতক্ষণ দেখা যায় মাহবুব তাকিয়েই থাকে... বাঁক ঘোরার আগ মুহুর্তেও দেখতে পায় মা একাকি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বুকের ভিতর থেকে কিছু একটা পাক খেয়ে উঠে আসতে চায়। দম বন্ধ করা এক অনুভূতি ক'ফোটা লোনা জলের সাথে বের হয়ে আসে। সে চোখ মুছে কেবিনের দিকে আগায়।

ছোট লঞ্চের কেবিন কিন্তু বড় লঞ্চগুলোর মতো নয়। এখানে কেবিন হল চারকোনা এক বড় রুম। এর ভিতরে মাঝখানটি খালি রেখে দেয়াল ঘেষে চারপাশে বসার বেঞ্চ এক সাথে ফ্রেমের মতো লাগানো। সুকানি ওর লাগেজকে একপাশে রেখে দিয়েছে। সাথেই জানালা। বেশ বড়। লঞ্চের একটানা শব্দের সাথে নদীর পানিকে পেছনে ফেলে আরো পানির ভিতর দিয়ে সামনে এগিয়ে চলা... মাহবুবের কাছে দেখতে বেশ লাগছে। কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রোদের তীব্রতা বেশী লাগাতে সানগ্লাস পড়ে নেয়। এখন অনেক আরাম বোধ করে।

বিভিন্ন বয়সের মানুষ... বিভিন্ন তাদের বেশভূষা। গায়ের রঙে ভিন্নতা। মাথার চুলের পার্থক্য কিংবা কথা বলার ঢং এক একজনের এক এক রকম। তবুও তাদের ভিতর কমন একটি জিনিস রয়েছে। সেটা হল তারা সবাই বাংলাদেশী! এই দেশের মানুষ এরা। কম-বেশী যাই-হোক নিজেদের ভিতরে এই দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা নিয়েই তারা পড়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মাহবুবের। দেশকে ছেড়ে যাবার যন্ত্রণা ওকে সবদিক দিয়ে কষ্ট দিতে থাকে। মানুষগুলোর দিকে আরো ভালো করে তাকায়। ওই যে মধ্যবয়ষ্ক লোকটি মাথা নীচু করে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে, সেকি আসলেই ঘুমন্ত? সাময়িক চোখ বন্ধ করে আশেপাশের অনেককিছু না দেখার জন্যই হয়তো সে চোখ বুজে আছে। মাহবুব নিজেও যদি ওনার মতো চোখ বন্ধ করে থাকতে পারতো!! তবে আজ সবাইকে ছেড়ে দেশের বাইরে যেতে হতো না। বোরখায় আবৃত এক মহিলার সাথে দু'সন্তান। একজন আট বছরের হবে। অন্যজন একেবারে শিশু। এই তিনজনকে পাশে নিয়ে কর্তা ভদ্রলোক খুব সন্তর্পণে বসে আছেন। যেন চারপাশে সবকিছু অচ্ছুৎ এবং তিনি তার পরিবারকে সেগুলো থেকে রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। কেউ ওনার বোরকাওয়ালির দিকে তাকালেই চোখ গরম করে তার দিকে দৃষ্টিবাণ নিক্ষেপ করছেন। মাহবুব মনে মনে হাসে। যার সবকিছু আবৃত, তাকে দেখারই বা কি আছে।

দুজন যুবক। মনে হয় কলেজ ছাত্র হবে। নিজেদের ভিতর আস্তে আস্তে কথা বলছিল। ওদের আলোচনার বিষয়বস্তু হয়তো ওদের ঠিক অপজিটে বসা সবুজ ওড়না দিয়ে বুক-মাথা ঢেকে রাখা ওই তরুনীকে নিয়ে। মাঝে মাঝে ওরা চোরা চোখে তাকে দেখছে। আবার নিজেদের ভিতর কথায় ফিরে যাচ্ছে। একজন অন্যের পেটে গুতো দিয়ে নিঃশব্দ হাসিতে ফেটে পড়ছে। দু'জনে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। হয়ত সিগ্রেট টানবে। না হলে নীচের চা-বিস্কিট ওয়ালার কাছে গিয়ে হাল্কা নাস্তা করবে। একজন চশমা চোখের ভদ্রলোক চোখের সামনে একটা বই মেলে বসে আছেন। হয়তো কোনো শিক্ষক হবেন। জার্ণির সময়টাতে নিজের জ্ঞানকে আরো একটু ঝালিয়ে নিচ্ছেন।

মাহবুব এদের সবাইকে দেখে একটা জিনিস কল্পনা করে। এই যে আপাতদৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন এই মানুষগুলো যাদের একের অপরের সাথে কোনো লিঙ্ক নেই। আচরণত কোনো মিলও হয়তো নেই। চেনা-অচেনার গন্ডী হয়তো কখনোই ওদের পার হওয়া হবে না। কিন্তু যখনই এরা আমাদের দেশের নষ্ট রাজনীতির ব্যাপারে লিঙ্কড হবে- একটা কমন উদ্দেশ্য তখন ওদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াবে। সরকারী দলের কোনো ইস্যুকে সামনে রেখে বিরোধী দলের নেত্রী যখন জ্বালাও -পোড়াও আন্দোলনের ডাক দিবে, তখন এই সাধারণ লোকগুলি নিজেদের ভেতরের সুপ্ত অসাধারণত্বকে বের করে আনবে। যখন বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা আন্দোলনের কর্মসূচী দিয়ে নিজেদেরকে মাঠের ত্রিসীমানায়ও দেখা দেওয়ায়না- বোরখার অন্তরালে নিজেদেরকে লুকিয়ে নিয়ে বেড়ায়... এই লোকগুলো তখন আগুন দেখে পতঙ্গ যেভাবে বেহুঁশ হয়ে ঝাপিয়ে পড়ে, সেভাবে সহিংস কর্মকান্ডে নিজেকে জড়ায়। ওই বোরকাওয়ালির কর্তা ব্যক্তিটি-ই হয়তো রাতের আঁধারে যুবক দুইজনকে সাথে নিয়ে কোনো রেলের ফিশপ্লেট উপড়ে ফেলায় ব্যস্ত থাকবে। অথচ সেই রেলে করে তার দুই সন্তানকে সাথে নিয়ে বোরকাওয়ালিও আসতে পারে এটা সে বেমালুম ভুলে যায়। চশমা পরিহিত শিক্ষকই কোনো এক বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে দেবার নির্দেশ দিতে পারেন। নিজের ছেলেও বাসভর্তি অন্যদের সাথে পূরে কয়লা হতে পারে, সেটা একবারও ভাবেন না। আজকাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে রাজনীতি চলেছে তাতে এই শিক্ষক শ্রেণীই তো সব থেকে বেশী জড়িত এবং ধ্বংসের কফিনে শেষ পেরেকটি তারাই মেরে দিচ্ছেন।

এই মানুষগুলো তাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের থেকে দল এবং দলের নেতা-নেত্রীদের নির্দেশের প্রতি বেশী নিবিষ্ট থাকে। নিজেদের টাকা খরচ করে বছরের পর বছর রাজনীতি করে আসছে এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। মাহবুবের মনে হয় এদের সংখ্যাই বেশী হবে। কারণ যারা রাজনীতিকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে তারা মুষ্টিমেয়। আর ধান্দাবাজিটাও তাদের আয়ত্তে থাকায় সিংহভাগ ইনকাম তাদের পেটেই যায়।

নিজের কথা ভাবে। ইউনিভার্সিটির পাঠ চুকিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশে জয়েন করল। এই ডিপার্টমেন্টের প্রতি মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই। সে নিজেও ছাত্রাবস্থায় অনেক আলোচনা-সমালোচনায় অংশ নিয়েছে... এদের বিপক্ষে অবশ্য। সেই ডিপার্টমেন্টে নিজের চাকরি হওয়াতে মনের ভিতরে নিজেকে অন্য আর দশজনের মতো না বানানোর এক দৃঢ় সংকল্প ছিল। নিজের মেধায় চাকরিটা হওয়াতে অন্য কোনো বার্ডেন ছিলো না। দেশের জন্য একজন সৎ পুলিশ অফিসার হবার টার্গেট নিয়ে সে জয়েন করে। কর্মস্থলের প্রতিটি যায়গাতেই সে ছিল সকলের চক্ষুশূল। তার সততা অন্যদের হাসির উদ্রেক করত। তাকে একজন সৎ পুলিশ অফিসার হিসাবে রেস্পেক্ট না করে তাকে অথর্ব- ল্যাবা, যে উপরি নিতে ভয় পায়, এমন মানুষ মনে করে ঘৃণা করে। আসলে যুগটাই-তো এখন সম্পুর্ণ উলটো পথে চলছে। সে এবং তার মতো কয়েকজন সোজা পথে চললে তো আর গোটা সিস্টেমটাই পাল্টে যাবে না কিংবা সোজা হয়ে যাবে না।

সর্বশেষ চাকুরিস্থল ছিল হত্যাকান্ডের জন্য সাম্প্রতিক সময়ে বহুল আলোচিত এক শহরে। যেখানে পরিবারকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণে চলছে দেশীয় অপরাজনীতি। সেই এলাকার এমপি মারা যাবার পরে উপ-নির্বাচন এর তফসিল ঘোষিত হয়। ওর পোষ্টিংও তখন সেখানে হলো। নির্বাচনে প্রভাবশালী পরিবারটির এক ছেলে সরকারি দলের মিত্রদের ব্যানারে দাঁড়ায়। তবে তার ভাই-ই আসলে এই শহরের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। ভাইয়ের নির্বাচনের সবকিছুও সে নিজের হাতে তুলে নেয়। নির্বাচনের দিন মাহবুবের আন্ডারে যে কয়েকটি ভোটকেন্দ্র ছিল, সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল কোনোভাবেই ভোটারবিহীন সীল-মারার নির্বাচন মেনে নেবে না। তবে একসময়ে সেই প্রভাবশালো এমপির লোকজন তার ভাইয়ের পক্ষে ভোটকেন্দ্র দখল করতে আসে। মাহবুব বাঁধা দেয়। মোবাইলে সেই এমপি'র কল আসে। মাহবুবকে হুমকি-ধামকি আর গালিগালাজের বর্ষণে একাকার করে ফেলে সে। মাহবুব শুধু বলে, 'আমাকে আমার কাজ করতে দিন।' ব্যাপারটা অনেকদূর গড়ায়। মিডিয়া নিজেদের প্রচারের জন্য এই এক্সক্লুসিভ ঘটনাটি বারবার তাদের চ্যানেলগুলোতে প্রচার করতে থাকে।

মাহবুব কেবিনের ভিতরের মানুষগুলোকে দেখে আবারো। সবাই যার যার ভূবনে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এরা হয়ত তাকে চিনতে পারেনি। সে বিগত দিনগুলোতে মিডিয়ার কল্যানে কি কম জনপ্রিয় হয়েছে? আমাদের দেশে দুটো দলের উত্তরাধিকারের রাজনীতির সুবাদে যুগ যুগ ধরে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যা কিছু সব-ই এই দু'দলে বিভক্ত হয়ে যাওয়া। দেশের বুদ্ধিজীবীদের কলমের ক্ষুরধার লেখনিও নিজেদের স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তিমূলক লেখায় রুপ নিচ্ছে। বাবা-ছেলে, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন থেকে শুরু করে সাধারণ জনগনের প্রতিটি স্তরেই এই বিভক্তি। সেজন্যই বিরোধী দলের শীর্ষস্থানীয় পদ থেকে শুরু করে একেবারে নিম্ন পর্যায়ের সমর্থকদের কাছে মুহুর্তেই মাহবুব একজন হিরোতে পরিণত হয়ে যায়। তাকে নিয়ে লেখালিখির হিড়িক পরে। যারা তার সৎ হবার কারণে, নিজেদের উপরি আয়ের পথ রুদ্ধ হওয়াতে তাকে ঘৃণা করেছে, এখন তারাও ভোল পালটে তার সহকর্মী হওয়ার জন্য নিজেদেরকে গর্বিত মনে করছে- এ জাতীয় বক্তব্য বিবৃতিও সে শুনতে পেলো। আর সরকারী মহলের কাছে তো সে ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে উঠলো। যেখানে দেশের প্রধান নির্বাহী জাতীয় সংসদে সেই প্রভাবশালী লোকটির পরিবারকে আশ্রয় দেবার ঘোষণা দিয়েছেন, সেখানে তার মত একজন সামান্য পুলিশের এ.এস.পি'র কি স্পর্ধা তাদের বিরুদ্ধে যায়! আর আজ যারা তাকে মাথায় তুলে নাচতে চাইছে , যদি এই ঘটনাটি তাদের সরকারের আমলে হতো? তখনো কি এভাবে মাথায় নিয়ে নাচতো?

নিজেকে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে সেই প্যাট্রিয়ট কবিতার দেশপ্রেমিক মানুষটির মতো মনে হল। সময়ের পরিবর্তনে একই রাস্তায় সে দুই ভিন্ন রকমের অভ্যর্থনা লাভ করে। মাহবুব তার অন্তরদৃষ্টি দিয়েও নিজেকে সেই কঠিন সময়ের ভিতরে নিষ্পেষিত হতে দেখে। তাই বাবা-মা'র সাথে আলোচনা করে চাকরিটা ছেড়ে দেয়। কিছুদিন গ্রামে বাবা-মায়ের সাথে কাটায়। কিন্তু অলস সময় কি আর কাটতে চায়। যে উত্তেজনাকর জবের ভিতরে নিজেকে উজাড় করে দিয়ে দেশের ও দশের জন্য কিছু একটা করার প্রত্যয় নিয়ে মাঠে নেমেছিল, আজ সেই উত্তেজনা থিতিয়ে গিয়ে গ্রামের নিস্তদ্ধ পরিবেশে আর কতক্ষণ ভালো লাগে? মাস দুয়েক এভাবে কাটায়। এরপর ওর বড় মামার কথায় কানাডাতে একটা ভালো অফার পেয়ে সেখানের জন্য চেষ্টা করে। একসময় গোলামির সেই অফারটির সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। আগামিকাল সেই দেশে উড়ে যাবার দিন।

বসে থাকতে ভালো লাগছে না। মাহবুব কেবিন থেকে বের হয়। খোলা ডেকের উপর দিয়ে হেঁটে লঞ্চের পিছনদিকে যায়। নামাজের যায়গাটিতে কেউ বসে নেই। পায়ের জুতো জোড়া সিড়ির লাছে রেখে সেখানে উঠে যায়। বড় নদী দিয়ে লঞ্চ চলছে। এখন মাঝখানে। দু'পাড় অনেক দূরে। মাহবুবের কাছে মনে হয় জীবনের পাড়। সমান্তরালে চলছে যেন দুই পাড়। মাঝখানে জীবন। দুই পাড় ভালো এবং মন্দের প্রতিনিধি। আর লঞ্চটি আমাদের মুল্যবান সময়। সে থেমে নেই। মাথার উপরে নীল আকাশ নদীর ঘোলা পানিতে নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টায় রয়েছে। প্রচন্ড বাতাসে মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বাতাস রৌদ্রের তাপকে তেমন প্রচন্ডভাবে অনুভব করতে দিচ্ছে না।

লঞ্চ পানি কেটে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে। মাহবুব লঞ্চের শেষ প্রান্তে বসে পিছন দিক মুখ করে বসে আছে। ফেলে আসা ট্রেইলের দিকে তাকিয়ে ওর ভিতরে এক অদ্ভুদ অনুভূতির জন্ম হতে থাকে। সেই কোন শৈশবে শোনা একটি গানের কলি যা ওর হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে ছিল! আজ দেশত্যাগের এই চরম কষ্টকর মুহুর্তে কোনো কারণ ছাড়াই ওর মনের গভীর থেকে বেজে উঠল-

'আমার দেশের মাটির গন্ধে

ভরে আছে সারা মন

শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে

নেই কিছুর প্রয়োজন।'

এক বোবা অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে মাহবুব চমকে উঠে। এ সে কি করছে? পিছনে ফেলে আসা ট্রেইলের কথা চিন্তা করে... সেখানে সে ফেলে এসেছে ওর মমতাময়ী মাকে। মা! শেষ সময়ে ওর আসন্ন বিচ্ছেদ কল্পনায় মা কতটা অসহায় হয়ে পড়েছিলেন... নিজের নাড়ী ছেড়া ধনকে নিজের থেকে দূর করতে কি নিদারুন কষ্টই না পাচ্ছিলেন। হোক না তা কিছু দিনের বা এক নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য। তবে কোনো মা-ই চায়না যে তার সন্তান তার থেকে দূরে থাকুক।

তবে মাহবুবের দেশ যাকে সে নিজের মায়ের চেয়েও কোনো অংশে কম ভালোবাসে না- তাকে ছেড়ে সে কিভাবে চলে যেতে চাইছে? ওর জন্মদাত্রী মায়ের মতো সেও তো ওর বিচ্ছেদে কষ্ট পাচ্ছে! এজন্যই তো থেকে থেকে মাহবুবের মনকে চলার পথে তার সকল সৌন্দর্য দেখিয়ে সে ওকে যেতে নিষেধ করছে। এই আকাশ-বাতাস, নদী আর তার দুই পাড় এবং সবুজ গাছপালা সব কিছু মিলিয়েই তো এই দেশ। মাহবুবকে জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত সব কিছু দিয়ে চলেছে... সেই দেশকে ছেড়ে কত সহজে সে চলে যেতে উদ্যত! গুটিকয়েক মানুষের কালো হৃদয়ের কাছে হেরে সে পলায়নপর মনোভাবি হয়ে দেশান্তরী হবে? এই সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা বসুন্ধরা তার বুকের ভিতরে মাহবুবের মত কত সু-সন্তানকে বুকে ধরে রেখেছে, তাদের সকলেই যদি দু'একটি প্রভাবশালী কালো মানুষদের ভয়ে মাকে ছেড়ে চলে যায়- তবে এই মায়ের ঋণ শোধ হবে কিভাবে? আর ঋণ শোধের কথা বাদই থাকুক... মায়ের ঋণ কখনো সন্তান শোধ করতে পারে না। কিন্তু মায়ের কাছে থেকে মাকে দেখাশুনা তো করতে পারে।

নিজের ভিতর থেকে চলে যেতে চাওয়া নিজেকে ফিরিয়ে আনাটা এতো সহজ নয়। মাহবুব একটি লঞ্চের নামাজের যায়গায় বসে চলে যাওয়া নিজেকে ফিরে পায়। নতুন মন্ত্রে উজ্জীবিত মাহবুব নব বলে বলীয়ান হয়। বাতাসের মৃদু খুনসুটিতে পরম আবেশে ওর হৃদয়ের ভেতর থেকে কোণ সে ডাক শুনতে পায় সে। লঞ্চের শব্দকে ছাপিয়ে বাতাসে মিশে যায় ওর উদাত্ত কন্ঠের আওয়াজ-

' শুনিলাম আপনা অন্তরে

অসংখ্য পাখির সাথে

দিনে রাতে

এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে

কোন পার হতে কোন পারে।

ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে---

হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে!' Rose

--------------------------------------------------------------

[কবিতাঃ বলাকা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]

বিষয়: সাহিত্য

৯৫৯ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

260353
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০২:৩৫
কাহাফ লিখেছেন : এমনি শত শত বোবা কান্না গোমরে মরছে প্রতি টি দেশ প্রেমিক মানুষের অন্তরে। এ অবস্হার আবসান হবে কবে.............?
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:০৯
204114
মামুন লিখেছেন : আমার জানা নেই কবে এর অবসান হবে। কিন্তু আশায় বুক বেঁধে আছি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Good Luck
260365
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:০০
আজিম বিন মামুন লিখেছেন : ভাল লাগলো আবারো...।
শুভ কামনায়...
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:০৯
204115
মামুন লিখেছেন : আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভেচ্ছা সব সময়ের মত।Good Luck
260370
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:০৫
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:১০
204116
মামুন লিখেছেন : আপনাকে ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা।
জাজাকাল্লাহু খাইরা।Happy Good Luck
260381
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : It is a heart touching writing with beautiful story. Jajakallahu khairan vaiya.
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:১১
204117
মামুন লিখেছেন : আপনার জন্যও অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
ভালো থাকবেন।Happy Good Luck
260385
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:৪৭
মাহফুজ আহমেদ লিখেছেন : হৃদয় ছুঁয়ে গেলো।অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:১১
204119
মামুন লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ মাহফুজ ভাই সঙ্গে থাকার জন্য।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck
260394
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৪:২৬
মেঘ ভাঙা রোদ লিখেছেন : 'আমার দেশের মাটির গন্ধে
ভরে আছে সারা মন
শ্যামল কোমল পরশ ছাড়া যে
নেই কিছুর প্রয়োজন।'

গল্পটা পড়ে প্রাণ ছুঁয়ে গেলো।
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ বিকাল ০৫:১২
204120
মামুন লিখেছেন : ব্লগে সাথে থাকার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।Happy Good Luck
261005
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১২:১৯
অয়ন খান লিখেছেন : প্রতিটি বিদায়ই আমাদেরকে অবচেতনে মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দেয় - এজন্যই বিদায় কষ্টের। আমার কাছে বিদায় হল আংশিক মৃত্যু - তাই এই বিদায়গুলোকে চূড়ান্ত বিদায়ের প্রস্তুতি হিসেবে নেয়া ভালো। সালাম।
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৭:৫৫
204907
মামুন লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনার সুন্দর মন্তব্যের জন্য।
আপনার সাথে সহমত।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো।Happy Good Luck

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File