‘পেট্রোল বোমা’ এবং ‘সাধারণ জনগণ’
লিখেছেন লিখেছেন গাজী সালাউদ্দিন ২৯ জানুয়ারি, ২০১৫, ০৬:৫৩:৩৯ সন্ধ্যা
কে মারে, কার গায়ে পড়ে আর কেইবা ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ ভূষণে ভূষিত হয় সে তর্ক পরে হবে। আগে দেখার চেষ্টা করি পেট্রোল বোমায় হতাহত ‘সাধারণ জনগণ’ কারা?
‘সাধারণ জনগণ’ কথাটি আবেগে ভরপুর। তাদের কেও পুড়লেই আবেগ উথলে উঠে, ঝর ঝর অশ্রু ঝরে আখি পাতে। সমস্বরে উচ্চারিত হয়, ‘রাজায় রাজায় লড়াই হয়, উলু খাগড়ার প্রাণ যায়’। ‘সাধারণ জনগণ’ কেন রাজনীতির বলী? প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন, উত্তর জানার আগে দরকার ‘সাধারণ জনগণ’ কারা দেখে নেওয়া।
যারা রাজণীতির বাইরে, তারাই ‘সাধারণ জনগণ’? রাজনৈতিক দল দ্বারাই সরকার গঠিত হয়, সে সরকার দ্বারাই রাষ্ট্র পরিচালিত। রাষ্ট পরিচালিত মানে জনগণ পরিচালিত। যদিও গণতান্ত্রিক পন্থায় সরকার জনগনের জন্য, জনগণের দ্বারা পরিচালিত হওয়ার কথা, কিন্তু বাস্তবতা হল সরকারের জন্য জনগণ, তাই সরকার যেভাবে নাচায়, জনগণ সেভাবেই নাচবে, ব্যত্যয় হলে বেতের বারি খাবে। ইচ্ছে হোক অথবা অনিচ্ছায়, জনগণ রাজনীতির বৃত্তের মাঝেই ঘুরপাক খেতে থাকে। কেও নিরপেক্ষ থাকতে পারে না।! তবু ‘সাধারণ জনগণ’ বলে সব দোষ রাজনৈতিক দল গুলোর উপর চাপানো কতটা যৌক্তিক!
পৃথিবীতে আছে দুইটা পথ। ১,হক ২, বাতিল। হয় হকের দিকে নয়ত বাতিলের দিকে মানুষের সহজাত যাত্রা। নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা সম্ভব না। কেও যদি থাকতে চায় কিংবা আছে বলে জোর দাবী করে, সে নিরপেক্ষ নয়, বরং নিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে সুবিধাভোগী।
রাজনৈতিক কর্মী কি সাধারণ জনগণের একজন নয়? পরিবার, সমাজ, দেশের কেও নয়? কি অমার্জনীয় অপরাধে র্যা ব-পুলিশের গুলিতে তার বুক ঝাঝড়া হয়? আগুনে তার শরীর মৃত্যু যন্ত্রণায় চটপট করলেও শুধু রাজনৈতিক পরিচয় থাকার কারণে আপনার মন ব্যথিত হওয়ার পরিবর্তে খুশিতে নেচে উঠে, সোৎসাহে চিল্লাতে থাকেন সন্ত্রাস-জঙ্গী নিধন হয়েছে বলে!
প্রতিদিন কারও বাবা, ভাই, অথবা কারো সন্তান কে আনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ধরে নিয়ে মেরে যেখানে সেখানে লাশ ফেলে কীট পতঙ্গের খাদ্য বানায়, কথিত বন্দুক যুদ্ধের নাটক সাজায়, প্রচার করে নিহতের বিরুদ্ধে ২০/২৫টা মামলা ছিল। তো কি হয়েছে, তাই বলে মেরেই ফেলতে হবে? আইন আদালত কিসের জন্য? এরকম হাজারটা মামলা রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের উপর থাকে। মামলার অজুহাত দেখিয়ে মারতে হলে সব রাজনৈতিক নেতা কর্মীকে মেরে ফেলাই সমীচীন হবে? বন্দুক যুদ্ধ, আত্মরক্ষায় গুলি চালাতে বাধ্য, এইসব কথা শোনলে গা জ্বলে ঊঠে, এতো মিথ্যাচার, বারংবার একি ডায়ালগ একি মুখে উচ্চারণ করে কেমন করে? লাজ লজ্জার মাথা না খেলে কেও এমন হরদম মিথ্যা বলতে পারে না।
রাজশাহীতে অধ্যক্ষ ধরা পড়ার একদিন পর খুন অথচ আগের দিন ডিবি অফিসে পরিবারের লোকজন দেখাও করে এসেছেন। পুলিশ জানায় পালিয়ে যাওয়ার সময় বন্দুক যুদ্ধ হলে আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি চালায়। আমার প্রশ্ন, একজন লোক পুলিশের হাতে জিম্মী থাকার পরেও তার হাতে অশ্র থাকে কেমন করে? এমন সব প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন লোক কেন অশ্র ব্যবহার করে নিজের মৃত্যু ডেকে আনবে? একদিন সত্য উন্মোচিত হবেই, যতই সত্যকে সমাধিস্থ করা হোক। বন্দুক যুদ্ধে সবসময় ‘কথিত সন্ত্রাসীরাই’ মারা যায়, পুলিশ কিন্তু মারা যায় না!!! এ কেমন যুদ্ধ, এক পক্ষই সবসময় জিতে যাবে?
এমন সব হৃদয়বিদারক ঘটনা যখন সকাল বিকাল ঘটেই চলেছে, তখন ‘কথিত সাধারণ মানুষ’ কেন বসে বসে তামশা দেখে? বড় গলায় যখন বলে, “লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ৭১এ স্বাধীনতা এনেছি”, তখন লজ্জা করে না? ৭১এ অন্যায়, জুলুম নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বসাধারণ ময়দানে ঝাপিয়ে পড়ে। আজ কেন নিরপেক্ষ সেজে নিজেদের নিরাপদ দুরত্বে রাখা? আজও ছেলের রক্ত স্রোতে মায়ের কোল রঞ্জিত, আজ ও অসংখ্য বোন বিধবা হয়, দুধের শিশু হয় পিতৃহীন। দেশ স্বাধীন হয়েছে, কিন্তু অরক্ষিতই রয়ে গেছে। উপর দিয়ে ফিটপাট মনে হলেও দখলদাররা তলে তলে শিকর কেটে মূলোৎপাটনের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে। বিজয় দিবসের আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান দেখে ‘সাধারণ জনতা’ মুগ্ধ, দেখেছি কি অনুষ্ঠানস্থল আর সবার পোষাক ভিন দেশী পতাকায় সয়লাব হয়েছে? এসব ভাল লক্ষণ নয়। তবু ‘সাধারণ জনগণ’ আঙ্গুল চুষাতেই ব্যস্ত!
আরব বসন্তসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সর্বসাধারণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। শাহবাগে কোন একজন থুতু ফেলে থুতুর দিকে তাকিয়ে দেখল থতুর সাথে রক্ত পড়েনিতো? পথচারী একজন জিজ্ঞেস করল, ভাই নিচে কি দেখেন? এমনি করে একজন দুইজন আসে, জিজ্ঞেস করে ভাই কি হয়েছে? এভাবে লোক জড়ো হতে হতে কিছু না জেনে বুঝে সবাই কথিত জাগরণের অংশ হয়ে পড়ল! এখন রাজনৈতিক দলগুলো যৈক্তিক দাবী নিয়ে কিংবা দৃশ্যমান অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও ‘কথিত সাধারণ জনগণ’ নীরব? কেও মিছিল মিটিং করে বুক চেতিয়ে দিয়ে দুঃশাসনের অবসান ঘটাবে, আর ফল ভোগ করবে সব অনাচার দেখেও হাত ঘুটিয়ে বসে থাকা ‘কথিত সাধারণ জনগণ’? রাজনৈতিক কর্মীদের জীবনের কোন মূল্য নেই, তাদের খুব আছে! এমন কৃতঘ্ন ‘সাধারণ জনগণ রাস্তায় পুড়ে মারা গেলে এতো দরদ দেখানোর কিছু নেই! হরতাল অবরোধে জ্বালাও পোড়াও ভাংচুর হবেই, তবু কেন সদর্পে বের হয়ে অকারণ, অপ্রয়োজনে বানিজ্য মেলা, উদ্যান, পার্ক অথবা কারো বাড়িতে যাওয়া? একান্তই জরুরী কাজ হলে ভিন্ন কথা।
এবার আমি পেট্রোল বোমা কে মারে তা নিয়ে আলোচনা করব। নিরপেক্ষ হয়ে কথা বলা কঠিন। আমার কথা কখনো সরকার পক্ষে, কখনো বিরোধী পক্ষে কখনো বা তৃতীয় পক্ষেও যেতে পারে। তবে সর্বশেষ ন্যায়ের পক্ষেই হবে আমার অবস্থান।
অনেকেই মনে করে জ্বালাও পোড়াও বিরোধী পক্ষের কাজ। মনে করা এক জিনিস, আর বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সত্যকে উপলব্দি করা ভিন্ন জিনিস। প্রতিবাদের নিয়মতান্ত্রিক ভাষার প্রয়োগ এখন কোনভাবেই করা যায় না যেমন মিছিল মিটিং, মানব বন্ধন, অনশন। তাই অহিংস থেকে প্রতিবাদের ভাষা বারবার সহিংসতায় রূপ নেয়। আমি বিশ্বাস করি, অহিংস পন্থায় যদি আন্দোলনের ফসল ঘরে আসে, তবে সহিংস হয়ে উঠার প্রয়োজন পড়বেই না। যখন অহিংস আন্দোলনের সব পথ বন্ধ করে দেয়া হয় তখন সহিংস পন্থায় কিছু ক্ষয় ক্ষতি মেনে নিয়ে হলেও আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া সময়ের দাবী এবং তা অযৌক্তিক ও নয়।
উস্কানী! এই উস্কানীতে বেশি বিভ্রান্ত বিরোধী পক্ষ। মিডিয়া প্রচার করে হরতাল ঢিলেঢালা! কোন হতাহত হয় নি, ভাংচুরের খবর নেই! মানে তারা চায় আরো ভাংচুর হোক, অসংখ্য মানুষ মারা যাক, নয়ত হরতালের স্বার্থকতা কোথায়! বিরোধীদের ব্যার্থতার করুণ চিত্র মিডিয়ায় ভেসে উঠে। সরকার তাচ্ছিল্য করে, “কোথাও হরতালের প্রভাব পড়ে নি, হরতাল কার্যত ব্যার্থ!” তার মানে দুই একটা লাশ নয়, হাজার খানেক লাশ পড়লেই হরতাল সফল হবে। বিরোধীরাও ভাবে, এতো কিছু করলাম, তাতেও নাকি হরতাল ব্যার্থ! আরো বেশি বেপড়োয়া হতেই হবে।
আবার যখন দেখা যায়, মিডিয়া আর সরকারের উস্কানীতেও জ্বালাও পোড়াও আশানুরূপ হয় নি তখন সরকার নিজেই ভাড়াটে লোক দিয়ে ভাংচুর বোমাবাজি করিয়ে দোষটা বিরোধীদের উপর চাপিয়ে দেয়। বিরোধী দল দোষ করলেও বিপদ না করলেও বিপদ। যাবে কোথায়? পুলিশ সারাদিন অলস বসে দেখে ভাংচুর কিছুই হলনা, তখন নিজেরাই কক্টেল ফাটিয়ে জানান দেয় হরতাল অবরোধকারীরা এখনো রাস্তায় টিকে আছে, আরো চাই ভাঙ্গন, দহন, টাকা কামানোর এমন মহৌতসব বারবার আসে না।
সম্প্রতি পেট্রোল বোমায় ব্যাপক হতাহত হচ্ছে। এইসব ঘটনায় ব্যাপক পুলিশের উপস্থিতি থাকা সত্ত্বেও পেট্রোল মেরে নিরাপদে চলে যাওয়া, কাওকে ধরতে না পারা, কখনো কেও ধরা পড়লেও সরকারের ছ্যালাদের নাম উঠে আসায় এটা পরিস্কার হয়ে যায় সরকার জড়িত। তবুও বিরোধী পক্ষ দায় এড়াতে পারে না। তারাও কোথাও না কোথাও পেট্রোল মেরে থাকে। ককটেল ফাটিয়ে আতংক ছড়িয়ে জনাকীর্ণ জায়গায় ফাকা করে মিছিল করা অথবা রাস্তায় ট্রায়ারে আগুন দিয়ে আতংক সৃষ্টি করে মিছিল করা অনন্যোপায় আন্দোলনের অংশ, তাতে সবার মাঝে আতংক ছড়িয়ে পড়লেও হতাহত হয় না কেও। কিন্তু পেট্রোল বোমা মারা কোনভাবেই মানতে পারি না।
পেট্রোল যাত্রীভরা গাড়িতেই মারতে হবে কেন? পেট্রল কারা মারে আমি শতভাগ জানি না। তবে যেই মারুন, আপনাকে বলছি, আপনি কাকে মারছেন? দেখে মারছেন তো? একটা পাবলিক বাসে আপনার দলের, বিরোধী দলের অথবা নিকটাত্মীয় কেও থাকতে পারে। শত্রু মিত্র না দেখেই আপনার ছোড়া পেট্রোলের আগুনে যদি আপনার দলের কেও, আপনার নিকটাত্মীয় কেও দগ্ধ হয় সে কি আপনাকে কখনো ক্ষমা করবে ? হয়ত বলবেন, হরতাল অবরোধে বের হয় কেন?
তাহলে আপনাকে বলব, সবাই বিপদ জেনেও অকারণ ঘুরে বেড়ানোর জন্য বের হয় না। আপনি বলুন না, ২৩ দিনের অবরোধে আপনার কি একবারো জরুরী কাজ পড়ে নি? ভাই অনেকের জরুরী কাজ থাকে, কারো হসপিটালে রোগী থাকে, কারো অফিস না করলে চাকুরী চলে যাবে, কেও পরীক্ষা দিতে বের হয়। আরো নানা জরুরী কাজ থাকে। তাই এমন কারো গায়ে পেট্রোল মারা কি উচিত, যার জরুরত সারার আগেই আপনার কল্যাণে জীবন প্রদীপ নিভে যায়!
পেট্রোল বোমা এড়িয়ে অন্যসব উপায় ব্যবহার করে আন্দোলন চালিয়ে গেলে খারাপ হয় না। কি বলেন? ঠিক তো?
বিষয়: বিবিধ
১১৮১ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সাধারণ জন গণ বলে কিছুই নেই বর্তমানে!
কোন না কোন দলের সাপোর্টার অবশ্যই সবাই!
দায় সবারই আছে!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন