আধুনিক যুগে কি ইসলামের প্রয়োজন আছে?
লিখেছেন লিখেছেন কালজয়ী ০৭ জুন, ২০১৪, ০২:৩৫:৪৫ দুপুর
বর্তমানে দেশে ধর্ম ও ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় আলোচনার প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। আর সেটা ইসলাম ধর্ম। এখন অহরহই বলা হচ্ছে ধর্ম মধ্যযুগের। ধর্মকে মেনে নেওয়া মানে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া ও পশ্চাৎপদটার নামান্তর। আমরা আধুনিক যুগের। তাই মানব প্রণীত আধুনিক নিয়ম-কানুনই এখানে চলবে। আমার বড় পরিচয় আমি মুসলিম- এটা নয় আমার বড় পরিচয় আমি একজন মানুষ। আমি ধর্মের মত পুরোনো কোনো কিছুকে অবলম্বন করে নিজেকে অনুন্নয়নের সমর্থক প্রমান করতে পারি না। উপর্যুক্ত কথাগুলো প্রতিনিয়তই শোনা যাচ্ছে। একজন স্বাধীন মানুষের বৈশিষ্ট্য কি? ইসলাম ধর্ম মানুষকে স্বাধীন করেছে কি? ইসলাম ধর্ম একজন মানুষকে কিভাবে গড়ে তুলতে চায়? ইসলাম ধর্ম মানুষকে পশ্চাৎপদ নাকি উন্নয়নমূখী করতে চায়? একজন পরাধীন মানুষের বৈশিষ্ট্য কি? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট হলে ধর্ম ও উন্নয়ন সম্পর্কিত মানুষের ভূল ধারণার মীমাংসা হবে।
আমরা একজন মানুষের মাঝে দুই ধরনের সত্তাগত অবস্থান স্পষ্টভাবে দেখি। একটা বস্তুগত আরেকটা অবস্তুগত। বস্তুগত সত্তা মানুষকে বলে, তুমি পেট পুরে খাও, আরাম করে ঘুমাও, আনন্দ করো, ধন-সম্পদ জমা কর নিজের জন্য(সুন্দরী নারী, প্লট, ফ্লাট, টিভি, ফ্রিজ, দামি আসবাবপত্র), মানুষের মধ্যে নিজের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতা প্রদর্শন করো, মানুষের উপর অন্যায় আধিপত্য বিস্তার করো, নিজের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনে ঘুষ গ্রহণ কিংবা সম্পদ লুণ্ঠন করো। সর্বোপরি প্রবৃত্তির সন্তুষ্টির সাধনায় তোমরা দিবারাত্র সংগ্রাম পরিচালনা করো। আর বস্তুগত অবস্থান কি বলে? এটি বলে, তুমি অভাবীকে আহার্য দানের পর অবশিষ্টাংশ গ্রহণ করো, কম ঘুমিয়ে মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য চিন্তা-জ্ঞানসাধনা করো, তোমার প্রতিবেশী তথা দেশের মানুষ কষ্টে থাকলে আনন্দ বর্জন করো, ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত না করে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কিংবা ইচ্ছামাফিক তার অতিরিক্ত অসহায় মানুষের মাঝে বিতরন করো, মানুষের সামনে ঐশ্বর্য প্রদর্শন করে নিজেকে দাম্ভিক, অহঙ্কারী করো না, মানুষের উপর আধিপত্য বিস্তার করে তাকে দাসবৃত্তিতে বাধ্য করো না, কোনো মানুষকে (নারী কিংবা পুরুষ, উভয়ই) নিজের বস্তুগত স্বার্থ পূরণের হাতিয়ারে পরিণত করো না, প্রত্যেক মানুষকে(নারী পুরুষ উভয়ই) তার নায্য হক বা অধিকার প্রত্যর্পণ করো, কোনো মানুষকে কামনা-বাসনার দাসে পরিণত করো না, শুধুমাত্র সবল হওয়ার কারনে অন্যায়ভাবে কারও উপর নির্যাতন করো না, ঘুষ, দুর্নীতি, লুণ্ঠনসহ সর্বপ্রকার অন্যায়, জুলুম কর্ম বর্জন করো।
অনেকে বলেন, উপর্যুক্ত দুই ধরণের মানুষই স্বাধীন। যদি আমরা একটু গভীর অন্তর্দৃষ্টির সাথে পর্যবেক্ষণ করি তাহলে দেখব, একজন মানুষ যে কিনা তার বস্তুগত অবস্থানকেই সেরা মনে করে সে সারাক্ষণ প্রবৃত্তির তাড়নায় লিপ্ত থাকে। এই প্রবৃত্তি তাকে নিজের ভাললাগার চর্চায় উৎসাহ দানের মাধ্যমে তাকে তার স্বার্থোন্নয়নের পথে অন্যায়কেও সমর্থনে বাধ্য করে। অর্থাৎ পুরোপুরি প্রবৃত্তিপ্রবণ মানুষ নিজেকে অন্যায় থেকে মুক্ত করতে পারে না। সে প্রবৃত্তির দাসে পরিনত হয়। যাকে বলা যায় আমীত্বের হাতে বন্দী একজন মানুষ। এই বন্দীদশা তার পরাধীনতাকে নিশ্চিত করে। পক্ষান্তরে অবস্তুগত অবস্থান তাকে প্রবৃত্তির দাসত্ব হতে মুক্ত হওয়ার প্রেরণা দেয়, উৎসাহ দেয়, সংগ্রামের শক্তি দেয়। এই অবস্তুগত অবস্থান ব্যক্তির প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আহবান জানায়। এই নিয়ন্ত্রণের অর্থ প্রবৃত্তির আকাঙ্ক্ষাকে সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়। যেসব বস্তুগত চাহিদা মানুষের জীবন ধারনের জন্য অপরিহার্য তা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তবে প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে এজন্য যে, প্রবৃত্তি যদি নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয় তবে মানুষ তার প্রকৃত চেতনা বহির্ভূত কাজ তথা চরম অন্যায় কাজে লিপ্ত হবে। তাই অবস্তুগত অবস্থান তার উপর্যুক্ত বৈশিষ্ট্যের কারনে প্রবৃত্তির উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এর ফলে যে মানুষ অবস্তুগত অবস্থানের প্রাধান্য দেয়, এর বিকাশের জন্য চেষ্টা করে সে সফল হয় প্রবৃত্তির চেতনাকে হ্রাস করে মানুষের কল্যানে নিজেকে সমর্পিত করতে। এ কাজগুলো সম্পূর্ণ তার স্বাধীনতা থেকে উদ্ভূত। সে স্বাধীনভাবে তার কামনাকে মানুষের সমস্যা সমাধানের উন্নয়নমূলক চেতনা দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে।
ইসলাম ধর্ম মানুষের অবস্তুগত উন্নয়নের উপর জোর গুরুত্ব দেয়। এ ধর্ম এক ধাপ এগিয়ে এসে বলেছে, এই অবস্তুগত অবস্থানের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য প্রচুর জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ইসলাম ধর্ম এর অনুসারীদের জন্য জ্ঞান অর্জন ফরজ করেছে। অর্থাৎ সব ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে হবে। পবিত্র কোরআন ভিত্তিক অবস্তুগত ও বস্তুগত জ্ঞান এবং দুনিয়ার অন্যান্য বস্তুবাদী লেখকদের অর্জিত ও প্রণীত জ্ঞান। ইসলাম ধর্মের কথা হল এই জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষ তার স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ কি রকম তা অনুধাবন করতে পারবে, স্বাধীনভাবে সমাজ উন্নয়নের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারবে। পবিত্র কোরআনের সুরা রাদের ১১ নং আয়াতে মানুষের স্বাধীনতার সপক্ষে বলা হয়েছে- “আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেরাই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে অগ্রসর হয়”। এ ধর্ম মানুষের জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথেই তার দায়িত্ব শেষ করে দেয় নি। এটি আরও বলছে, তুমি যততুকু অবস্তুগত জ্ঞান অর্জন করবে ঐ জ্ঞান দ্বারা সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে সংশোধিত হতে হবে। সংশোধন ব্যতীত ঐ জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। কেননা সংশোধিত না হলে সমাজ ঐ জ্ঞান ও ব্যক্তির দ্বারা উপকৃত হতে পারবেনা। অর্থাৎ কল্যাণপন্থী জ্ঞান অর্জনের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে ঐ ব্যক্তি ও জ্ঞানের সৃষ্টিকর্তার প্রতি আনুগত্যের ভিত্তিতে আত্মসংশোধন প্রক্রিয়ায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সমাজ তথা মানুষের উন্নয়ন। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে- “তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব হয়েছে; তোমরা সৎ কাজে আদেশ দাও, অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং আল্লাহে বিশ্বাস কর”(সুরা আলে-ইমরানঃ ১১০)। অর্থাৎ তারাই শ্রেষ্ঠ যারা ন্যায়ের পক্ষে থেকে অন্যায়ের বিরধীতা করে এবং আল্লাহে বিশ্বাসের মাধ্যমে নিজের দম্ভকে বিসর্জন দেয়। একজন মানুষ যদি প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে তবেই সে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারবে। এই শৃঙ্খল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই একমাত্র মানুষের মানবিক মুক্তি অর্জন সম্ভব। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মানুষকে প্রার্থনা করতে বলছেন এভাবে- “হে আমার প্রতিপালক! তুমি সামর্থ্য দাও যাহাতে আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি,-----,যাহাতে আমি সৎকার্য করিতে পারি যাহা তুমি পছন্দ কর,-------,আমি আপনারই অভিমুখী হইলাম এবং আমি অবশ্যই আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত”। আরবিতে ‘আত্মসমর্পণকারী’কে ‘মুসলিম’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে। অর্থাৎ যারা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মুসলমান হয়েছে তাদের মধ্যে যারা অন্যায়ের মুলোৎপাটন করতে চায় ন্যায়ের পথে সমাজ তথা মানুষের কল্যাণের জন্য তারাই শ্রেষ্ঠ উম্মত। যারা পৈতৃক সুত্রে মুসলমান তারা নয়।
যারা স্বাধীন হবার এই প্রক্রিয়াকে বর্জন করতে চায় তারা নিজেকে অনেক গুলো গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ করে। তারা বহু দল, উপদলের সাথে যুক্ত। দলীয় স্বার্থের উর্ধেব উঠতে এরা সংকোচ বোধ করে। কারণ এখান থেকে তারা বস্তুগত সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। বস্তুগত সুবিধা প্রাপ্তির কারনে দলীয় অন্যায়ের বিরোধীতাকে এরা অকৃতজ্ঞতা বলে গন্য করে। সাথে সাথে এরা এদের অবস্থানের পক্ষে অনেক যুক্তি দাড় করাতে চায়। এটাকে তারা প্রগতি বলে প্রচার করলেও এর গভীরে থাকে প্রগতিহীনতার বীজ। এই শ্রেণী প্রকৃত প্রগতিশীল মানুষদের সহ্য করতে পারে না, তাদের পথের কাঁটা বিবেচনা করে। এরা প্রবৃত্তির সাধনাকে উপেক্ষা করে না বরং উৎসাহ দেয়, পৃষ্ঠপোষকতা করে। এই শ্রেণীই কুইক রেন্টাল, হলমার্ক, শেয়ারবাজার, বিসমিল্লাহ গ্রুপ সংশ্লিষ্ট অন্যায়ের পক্ষে যুক্তি দাড় করায়। নিজেদের মানুষ দাবি করলেও দেশজুড়ে যখন বি এন পি, জামাত, আওয়ামী লীগ, হেফাজত কিংবা নির্দলীয় সাধারণ লোকদের হত্যার উৎসব শুরু হয় এরা প্রতিবাদ সংগ্রামে প্রবাদপুরুষ হতে পারে না। চিহ্নিত ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীকে যখন মুক্ত ঘোষণা করে হয় তখন এরা সেই সেক্যুলারিজম তথা ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশের আড়ালে মুখ লুকিয়ে থাকে। ফ্রি করিডোর, ফ্রি তিস্তা, ফ্রি টিপাইমুখ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়নকে পেছনে ঠেলে দেওয়া হলেও এরাই সেই শ্রেণী যারা কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ন হয় না। আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো আমাদের সমুদ্র সম্পদ জবরদখল করলেও রাষ্ট্রীয় প্রতিবাদ হয় না। আংশিক সমুদ্র জয়ের ঢেঁকুর তুলেই সন্তুষ্ট থাকে। যারা নিজেদের মানুষ দাবি করে তারাও এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় নির্লিপ্ততার প্রতিবাদ করে না। আজ যদি ইসলামী সরকার কাঠামো এবং জ্ঞানী, আদর্শিক, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের শাসন থাকতো তাহলে কি এই পরিস্থিতি দেখতে হত? ঐ নিস্ক্রিয়রাই প্রবৃত্তিপ্রবণ। ওরাই পরাধীন। পরাধীনতার বিষবাস্প ওদের মন-মগজে মিশে গেছে। ওদের কাছ থেকে কোনো আশা করাও অবান্তর।
তাই আশা করব এখন থেকে কেও ইসলাম ও মুসলিমদের উন্নয়নবর্জিত পশ্চাদমুখী বলবে না। ইসলাম যে আধুনিক যুগের জন্য সবচেয়ে যুগোপযোগী তা আর প্রমাণ করার প্রয়োজন পরবে না।
তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, প্রবৃত্তির দাসত্বের মাধ্যমে কি নিজের পরাধীনতাকে নিশ্চিত করব নাকি অবস্তুর বৈশিষ্ট্যকে ধারণ করে তা উর্ধেব তুলে মুক্তির জয়গান গাইব?
বিষয়: বিবিধ
১২৫২ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর বলেছেন।
তারা যদি জিবীত থাকত দেখত ইসলাম আগের মত গ্রহনযোগ্য বরং বহু ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রভাবশালী। উল্টো তাদের মতবাদ ভ্রান্ত ও পরিত্যাক্ত বলে প্রমাণিত হল। সুতরাং ইসলাম আজো আধুনিক এটার দরকার এখন যেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে, দুই হাজার বছর পরেও দরকার হবে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন