রাজনীতিকদের প্রতি মজলুম জনতার শেষ কথা
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ আসাদ আলী ১৯ নভেম্বর, ২০১৩, ১২:২০:৪৯ দুপুর
হে রাজনৈতিক নেত্রীবৃন্দ,
আমি আপনাদের দ্বারা নির্যাতিত এবং আপনাদের হাতে নিষ্পেষিত আপনাদের লাখ লাখ প্রজাদের একজন প্রতিনিধি। আজ আমি অনেক দুঃখ আর ক্ষোভ নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। জানি, আমাদের মত অসহায় মানুষের কথা শোনার সময় আপনাদের নেই। আমরা শুধু হতাশা-দুঃখ-দারিদ্র্য এবং ক্ষোভের কথাই আপনাদের শোনাই যা আপনাদের আরামের জীবনযাপনে বাধার সৃষ্টি করে। আপনারা সুখে থাকেন তাই সুখী কথা-ই শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু আমাদের এই দুর্বিসহ জীবনে সুখের কথা বলি কী করে? আমরা অশিক্ষিত, মূর্খ। রাজনীতির জটিল মারপ্যাঁচ আমরা বুঝি না। গণতন্ত্র, তত্বাবধায়ক, নির্দলীয়, সর্বদলীয়, সংবিধান ইত্যাদি জটিল জটিল শব্দ আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। আমরা চোখের সামনে যা দেখি তাই বিশ্বাস করি, বুঝতে চেষ্টা করি। যদিও আপনাদের কর্মকাণ্ডগুলো আমাদের কাছে একেক সময় একেক রকম মনে হয় তথাপিও একটি সাধারণ বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। সেটা হল ক্ষমতা। আপনারা ক্ষমতার পূজারী। ক্ষমতা ছাড়া আপনারা কিছুই বোঝেন না। কিন্তু আপনারা কি বুঝতে পারেন আপনাদের এই ক্ষমতায় থাকা আর ক্ষমতায় যাওয়ার নীতিহীন রাজনীতির খেলায় ঝলসে যাচ্ছে আমাদের জীবন? রাজপথে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা। আমরা আজ আতঙ্কিত। বাড়ির বাইরে যেতে আজ আমাদের ভয় করে। কিসের ভয়? জীবন হারানোর ভয়। এই জীবনটাই তো আমাদের একমাত্র সম্পদ। কিন্তু আজ আমাদের এই একমাত্র সম্পদটাও আপনারা কেড়ে নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। জীবন জীবিকার তাগিদে শত বাধা অতিক্রম করে আমরা কর্মক্ষেত্রে যেতে বাধ্য হচ্ছি। মনের ভেতরে আতঙ্ক, মৃত্যুভয় নিয়ে হরতাল নামক যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝ দিয়েই আমাদের রাস্তায় বের হতে হয়। কেউ জানে না কখন কোথা থেকে ছুটে আসবে ককটেল, পেট্রলবোমা বা আগুনের লেলিহান শিখা। আপনারা বিদেশ থেকে যে গণন্ত্রকে আমদানি করেছেন সেই গণন্ত্রের নীতি নাকি “ভাগ হওয়া”। যত বেশি সম্ভব ভাগ হতে হবে। তাই নিয়ম অনুসারে আপনারা বিভিন্ন জোটে জোটভুক্ত হয়ে কেউ হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ করছেন আর কেউ আমাদের টাকায় কেনা অস্ত্র দিয়ে, গুলি দিয়ে তাদেরকে মারছেন। নিজ নিজ অবস্থান থেকে পরষ্পরের পক্ষে বিপক্ষে তর্জন-গর্জন করছেন। আপনাদের একেক পক্ষের গর্জন আমাদের কাছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জনের চেয়েও বেশি ভীতির উদ্রেগ করে থাকে। সরকারি দলে থাকলে আপনাদের ভাষা থাকে একরম, আর বিরোধীদলে গেলে ভাষা হয়ে যায় অন্যরকম। আপনারা গিরগিটির মত রং বদলান। কিন্তু এতে আমরা এতদিন কোন আপত্তি করি নি। আপনাদের কাজে বাধা দেবার কোন ক্ষমতা আমাদের নেই। যদিও বাধা দিয়েই থাকি তবে আপনারাও গণতন্ত্র, সংবিধান ইত্যাদির মারপ্যাঁচে ফেলে প্রমাণ করে দেন যে আপনারাই ঠিক। আমরা তখন আর কোন কথা বলতে পারি না। কারণ সংবিধান ও গণতন্ত্রের উপরে আমাদের কোন কথা চলে না। আবার “জনগণের জন্য সংবিধান” কথাটি পাল্টে “সংবিধানের জন্য জনগণ” প্রতিস্থাপন করেছেন। এতেও আমরা কোন বিরোধিতা করি নি। অবশ্য, করলেও কোন লাভ হবে না জানি। কিন্তু আজ যেন আর সহ্য করতে পারছি না। আমরাও তো মানুষ! এই দেশেরই মানুষ! আপনারা যে সকাল সন্ধ্যা গণতন্ত্র, সংবিধান ইত্যাদি কঠিন কঠিন শব্দের খই ফুটান সেই শব্দগুলো সম্ভবত জীবনে একবারের জন্য শোনে নি কিশোর মনির। তারপাও আগুনে ঝলসে গিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে। মনির, কাশেম, মন্টু পাল মরে বেঁচে গেছে কিন্তু যারা আগুনে ঝলসানো শরীর নিয়ে মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে তাদের কী হবে? কে দেবে তাদের চিকিৎসা খরচ? কে দেখবে তাদের সংসার? আপনারা?
সহিংসতা না করলে, আমাদের না মারলে ক্ষমতাসীনরা বলেন বিরোধী দলের কোমড়ে জোর নেই। তাই আমাদেরকে মেরে, আগুনে পুড়িয়ে হরতালকারীরা প্রমাণ করে দিচ্ছেন যে তাদের আন্দোলন অনেক চাঙা। আপনারা এক দল যা বলছেন অন্যদল সেটাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে ব্যস্ত। দুই পক্ষের মিথ্যে তথ্য, মিথ্যা কথার মাঝে সত্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। আপনাদের একটি সত্য কথা বা একটি ওয়াদার বাস্তবায়নই আমাদের মত লাখ লাখ ভুক্তভোগীর মুখে হাসি ফোটাতে পারতো, কিন্তু সেটা আপনারা করেন নি। এটার কোন প্রয়োজনীয়তা আপনাদের কাছে নাই। শত দুঃখ, দুর্দশার মাঝে থেকেও হাসি আটকাতে পারি না যখন আপনাদের মুখে আমাদের অধিকারের কথা শুনি। আপনাদের জন্য আছে সুরক্ষিত বাড়ি, নিরাপদ রাস্তা, সুচিকিৎসা, মজাদার খাবার, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল আর আমাদের জন্য আছে মৃত্যুর ফাঁদ যানবাহন, কাজের অভাবে অনাহারে থাকা, অর্থের অভাবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ এবং সময়মত পরীক্ষা দিতে না পারায় খারাপ ফলাফলের দায়ভার। আপনাদের অন্ধ ও বধির গণতন্ত্র আমাদের কান্না শোনে না, মৃত্যুর মিছিল দেখে না, দানবীয় কর্মকাণ্ড অবলোকন করে না। গণতন্ত্র নামক এই রণক্ষেত্র
কেবল যুদ্ধ, মারামারি, খুনাখুনি, রক্তারক্তিই দিতে পারে। তবুও আমরা এতদিন এটাকে প্রত্যাখ্যান করি নি কারণ আপনারা বারবার আমাদেরকে আশা দিয়ে রাখেন। আমরা ভাবি এবারি বুঝি আমরা শান্তি পাব, নিরাপত্তা পাব। এবারই বুঝি আতঙ্ক থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু না, আপনারা আমাদের নাকের সামনে বরাবরের মতই শান্তির মুলো ঝুলিয়ে রেখে অশান্তির বীজ বপন করে চলেছেন। আজকে নিরুপায় হয়ে প্রশ্ন করছি কেন আমরা এই গণতন্ত্রকে মেনে চলবো? এই গণতন্ত্র আমাদেরকে কী দিয়েছে? লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, শিশুরা স্কুলে যেতে পারছে না, প্রতিনিয়তই আহত-নিহত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মহীন শ্রমিক ঘরে শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে, অসুস্থ রোগী ঘরে ছটফট করছে চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছে না। আমাদের এই দুর্বিষহ দিনানিপাত করার কি কোন মানে হয়? কেন আমরা এই গণতান্ত্রিক আন্দোলন নামক যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মৃত্যুর সাথে পঞ্জা লড়ব? অনেক হয়েছে, আর নয়। গত দুই দশকের অধিক সময় থেকেই আমরা নিয়মিতভাবে আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে আসছি। এক দলকে নামিয়ে আরেক দলকে বসাচ্ছি। কিন্তু কি পেলাম আমরা? রক্তস্নাত পথে লাশের মিছিলের মাঝে প্রতিবারই ক্ষমতাবানেরা ক্ষমতার মসনদে অধিষ্ঠিত হয়ে তৃপ্তির হাসি হেসেছেন। বিরোধীদল কিছুদিন যেতে না যেতেই খুঁজে পেয়েছে ক্ষমতাসীনদের ব্যর্থতা, শুরু করেছে আমাদের অধিকার আদায়ের নামে আন্দোলন। যেখানে আমাদের খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার ভূলুণ্ঠিত সে দেশে জনগণের ভোটাধিকারের নামে আন্দোলন, সংবিধানের নামে ঔদ্ধত্য আমরা কিভাবে সহ্য করতে পারি? সংবিধান রক্ষার নামে ক্ষমতাসীনদের যে স্বেচ্ছাচারিতা এবং বিরোধীদের যে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড তাতে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিচ্ছে। কতখানি নির্লজ্জ হলে এরপরও আপনারা আমাদেরকে ভোট দিতে আহ্বান করতে পারেন! আমাদের ভোট আপনাদের কাউকে না কাউকে ক্ষমতায় বসাবে কিন্তু আমাদের কি হবে? প্রতি পাঁচ বছর পর পর একই সংবিধান, একই গণতন্ত্র, একই আন্দোলন। কেবল ছেড়ে যায় মৃত মানুষের সংখ্যা, আহত মানুষের সংখ্যা, হিংস্রতার ছোবল। এভাবে আর চলতে পারে না। একটি সমাধানে আজ আমাদের আসতেই হবে। হতে পারে সে সমাধান আপনাদের বিপক্ষে। আমাদের ক্ষমতার দরকার নেই, অধিকারের দরকার নেই, বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন নেই আমরা শুধু বাঁচতে চাই, মানুষের মত বাঁচতে চাই। যে সিস্টেম আমাদের জীবন-সম্পদের নিরাপত্তা দিতে সক্ষম আমরা সেই সিস্টেমই বেছে নেব। অনেক হয়েছে, আর নয়।
বিষয়: রাজনীতি
৯২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন