ব্লগ প্রতিযোগিতাঃ প্রিয় খাবার বাদশাহী খানা
লিখেছেন লিখেছেন তিমির মুস্তাফা ১৪ জুন, ২০১৫, ১০:২০:০৯ সকাল
[b]
জীবন বাঁচানোর জন্য, মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে খাদ্য বা খাবার! প্রথমতঃ খাবার হল দেহের চাহিদা, এরপর রসনার পরিতৃপ্তি ! মানুষের মৌলিক ইন্দ্রিয় অনুভূতি সমূহের একটি হল রসনা বা স্বাদ! আর এই রসনা পরিতৃপ্তির জন্য খানা বা খাবার কয় ধরণের?
পুষ্টি ধারনার ভিত্তিতে উত্তর হতে পারে- দুই ধরণেরঃ পুষ্টিকর এবং অপুষ্টিকর বা Junk food! না, আমরা খাবারের পুষ্টিভিত্তিক আধুনিক শ্রেণীবিন্যাস করছি না। প্রকৃতিগত দিক থেকে, কেতাবী ধারনায় সাধারনতঃ আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে খানা- চার ধরণেরঃ
ক) চর্ব্য – যা চিবিয়ে খেতে হয়।
খ) চোষ্য – যা চুষে খেতে হয়
গ) লেহ্য – যা লেহন করে বা চেটে খেতে হয়
ঘ) পেয়- যা পাণ করতে হয়!
(অবশ্য আমরা বাংলাদেশে শরবত বা পানিও ‘খাই! – পাণ করি না! সে গল্প অন্য দিন!)
এই গেল মুখের, জিভের বা দাঁতের ব্যবহার বা গলাধঃকরণের ভিত্তিতে খাদ্যের শ্রেণী বিন্যাস! পৃথিবীর অন্যান্য দেশের থেকে আমাদের উপমহাদেশীয় জিহবায় স্বাদের ব্যপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ! অমৃত হলেও যদি স্বাদ না থাকে – আরও অনেকের মত আমি সে ‘বস্তু ঠেলে দূরে সরিয়ে রাখব! ইংরেজদের ফিশ এণ্ড চিপস! আমেরিকানদের ‘বার্গার নাকি গরম কুত্তা বা হট ডগ-!(মাফ করবেন, এ বস্তু খাদ্য হয় কি করে!)
আমরা সত্যি সত্যি স্বাদের বন্দনায় এগিয়ে! মশলার প্রয়োগ সে কারণেই! আর একারনেই আমেরিকার আবিষ্কৃত হয়েছে- আমাদের উপমহাদেশের মশলার সন্ধানে আসছিলেন ভাসকো দা গামা! ঘটনাক্রমে আমেরিকা আবিস্কার! অবশ্য প্রায় স্ব আবিস্কারের পেছনেই এমন ঘটনা বা দুর্ঘটনা রয়েছে।
এক্ষেত্রে খাদ্যের আলোচনায়, সর্বপ্রথম আরিস্ততল পাশ্চাত্য ধারনায় দুটি মৌলিক স্বাদ যোগ করেন, মিষ্ট এবং তিতা; বাকি গুলো নাকি এই দুয়ের সংমিশ্রণে !
আমাদের কাছে (উপমহাদেশীয়) পেট পূজা বা রসনাবিলাস বা রসনাপ্রেম অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় এই স্বাদভিত্তিক শ্রেণী বিন্যাসে আমাদের খাবার ষড়ব্যঞ্জন যুক্ত বা ছয় ধরণেরঃ
ক) টক
খ) ঝাল
গ) মিষ্টি
ঘ) তিতা
ঙ) লোনা এবং
চ) কষা বা কটুস্বাদ! বা কড়া ঝাঁঝ যুক্ত স্বাদ (Pungent) ! আয়ুর্বেদিকরা বলেছেন, স্বাদ ছয় রকম । কষা এবং কটু- এরা আলাদা- ঝাল বাদ দিয়ে; ঝালকে কটু স্বাদের মধ্যে ফেলেছেন। যাহোক আমাদের তথ্য অনুযায়ী এই দুটি স্বাদকে আলাদা শ্রেণী বিন্যাস না করে একসাথে রাখাই ভাল ! এখন অবশ্য জাপানিজদের কল্যাণে স্বাদের ক্ষেত্রে আরও এক পদ যোগ হয়েছে ‘উমামী বা সুস্বাদু! ‘উমামী হচ্ছে উপরোল্লেখিত আইটেম গুলোর সম্মিলিত এক ‘ভারসাম্যপূর্ণ রূপ- যা আমাদের স্বাদ ইন্দ্রিয়কে মোহিত করে! জাপানী টেস্টিং সল্ট বা আজি নো মোতো ( আজি অর্থ স্বাদ, মোতো –অর্থ মূল, দুটো মিলে- “স্বাদের মূল ) এখন আমাদের রান্না ঘরেও সহজ লভ্য! অনেকের মতে প্রতিটি খাদ্য উপাদানের আলাদা স্বাদ রয়েছে! জাপানিজরা মাছ বা মাংস খায় সরাসরি, অনেক ক্ষেত্রে কাঁচাই- তবে খাওয়ার আগে একটু ঊপাচার লাগিয়ে নেয়- সয়া সস ।
আরও অনেক খাবার ওরা সরাসরি ওভাবেই খেতে চায়, হয়তো একটু সেদ্ধ করে; তাদের জনপ্রিয় ধারণা, তেল মশলা মিশালে ‘সেই উপাদানের নিজস্ব স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়! আমাদের ধারণায়, আমার মত হয়তো আরও অনেকের কাছেই, খাদ্য উপাদান সমূহের যেমন মাছ মাংস বা শব্জীর আলাদা কোন স্বাদ নেই। স্বাদ হচ্ছে- ঝাল, লব্ তেল ও মসলার এক ভারসাম্য পূর্ণ অবস্থা যা সেই খাদ্য উপাদান সমূহের সাথে মিশে তাকে আমাদের রসনার উপযোগী করে! অবশ্য জাপানিজদের অনেকেই আমাদের ‘কারী রাইস খেয়ে তাদের সে ‘জনপ্রিয় ধারণা’ পাল্টে ফেলেছে, দেরী হয়নি !
অনেক দিন মানুষ জানতো -আমাদের জিহ্বার বিভিন্ন অংশে, বিভিন্ন স্বাদ অনুভূত হয় - । এখন এক গবেষণা ফলাফল থেকে আমরা জানি – যে এ ব্যাপারে এখনও আমরা খুব কম জানি! এতদিন যা জানতাম- কমপক্ষে, সেটা ভুল, (http://www.nytimes.com/2008/11/11/health/11real.html?_r=2&) । স্বাদ নেয়ার জন্য গোটা জিভেই ‘স্বাদ কুঁড়ি’ বা টেস্ট বাড ছড়িয়ে আছে, কিছু এলাকায় বিশেষ স্বাদের স্পর্শকাতরতা একটু বেশী এই যা!
যা হোক, ভুমিকা শেষ, মূল গল্পে আসি।
আমার বড় আব্বু একজন ডাকাবুকো মানুষ, আক্ষরিক অর্থে ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের হিউম্যান ভার্সন । তাঁর গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরও শুনা যেত বহু দূর থেকে! ছেলেবেলায় তাঁর চোখের মোটা চাহনীতে আমি হাজারো ‘ব্যাঘ্র গর্জন শুনতে পেতাম! তিনি যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবেন সে রাস্তার আশেপাশের মানুষ জেনে যাবে এদিক দিয়ে বিশেষ কেউ যাচ্ছে! ছোটবেলায় আমরা ভাই বোন কাজিনরা মিলে যৌথ পরিবারের বড় উঠানে খেলায় মসগুল থাকতাম, হঠাৎ কেউ বলল, বড় আব্বু আসছেন! মুহূর্তের মধ্যে সবাই উধাও! যে যার রুমে, পড়ার টেবিল; কিম্বা অন্য কোথাও- যেখানে তাঁর নজর যাবে না! সবকিছু সুনসান! সবকিছু নিয়ন্ত্রিত! যেন কখনো ‘অন্য কিছু হচ্ছিল না এখানে! রান্নাঘরে মহিলা মহল এবং –কাজের মেয়েরা একেবারে নিশ্চুপ, অথচ একটু আগেও কলরব হচ্ছিল !
তিনি ঘরে ফিরলে –সব হাতের কাজ রেখে বড় আম্মু একটা হাত পাখা নিয়ে এগিয়ে আসবেন, বাতাস করবেন বড় আব্বুকে! তাঁর হাতে ঠাণ্ডা শরবত বা পানি তুলে দেবেন। গরমের সময় তাঁর খুব প্রিয় বেল এর শরবত। এবার গোসল হবে – সেটাও বেশ ঘটা করে! এরপর তিনি বসবেন তাঁর প্রিয় আসনে – বাড়ির ভেতরে নয়, বাইরের- বৈঠকখানা ঘরে। তাঁর সামনে এক জলচৌকী!
প্রসঙ্গতঃ বৈঠক খানা সম্বন্ধে কিছু বলতে হচ্ছে! এ এক বারোয়ারি ঘড়, খড় দিয়ে ছাওয়া বিশাল ‘আট চালা । পরিবেশ বান্ধব, গরমের সময় ঠাণ্ডা, ঠাণ্ডার সময় গরম। চাকর কিষাণরা ঘুমাত এর ভেতরের এক রুমে আর বাইরের বারান্দায় কমপক্ষে পচিশ ত্রিশ জন মানুষ বসতে পারত! দাদার আমল থেকেই বারান্দার এক কোনায় তামাক – সে সময়ে প্রচলিত হুঁকা সেবনের ব্যবস্থা! ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর – এ বিজ্ঞাপন তখনও চালু হয়নি! ঘরের সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে, তা পেরিয়ে এক ছোট নদী। বৈঠকখানায় বসলে সামনে দৃষ্টি অবারিত হবে! বাড়ির সামনের এই রাস্তা দিয়ে কেউ গেলে তাকে এখানে একবার পদধুলী দিতে হবে –বড় আব্বুর চোখে পড়লে এবং তামাকের অভ্যাস থাকলে, তামাক খেয়ে যেতে হবে। বারান্দার অন্য কোনায় ঘিরে রাখা এলাকায় গৃহশিক্ষক কিম্বা মৌলবি এলে বসত ছোটদের পড়াতে! বাইরের লোকজন এলেও এই বৈঠকখানা ঘরেই বসানো হত, অনুমতি ছাড়া হুট করে কেউ বাড়ির ভেতরে যেতে পাড়ত না, বৈঠকখানা থেকে অনুমতি নিয়ে তবেই! চাকর বাকরদের জন্য একই নিয়ম! এক ধরণের পর্দা রক্ষা হত – এভাবে!
হুকা সাজানো হত, তামাক সেবন হত, অথচ আমার বড় আব্বু অধূমপায়ী ছিলেন, ঐ আয়োজন অন্যদের জন্য- নেহায়েত সামাজিকতা! । এবার তামাক খেয়ে যখন সে সুস্থির – তখন আস্তে আস্তে গল্প শুরু হত, সে কি করে – কোথা থেকে আসছে- কোথায় যাচ্ছে, তাঁর বাবার নাম কি- কিম্বা দাদার নাম কি, কোন গ্রামে বাস, কি করে, আত্মীয়তা আছে কাদের সাথে ইত্যাদি! পুলিশী জেরা নয়, খুব আড্ডাঘই, মজলিসী, আন্তরিক পরিবেশ! বড় আব্বুর মাথা – মাশা আল্লাহ- যেন ছোট খাট এক বিশ্ব কোষ! আশেপাশের দশ বিশ পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে এমণ কোন গ্রাম নেই যেখানকার জোতদার বা বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে তিনি নামে চিনতেন না! কার সাথে কাদের আত্মীয়তা, কার আচরন কেমন, কার সাথে কার মনোমালিন্য, কার ঘরে কেমন সমস্যা- এমনকি পারিবারিক স্ক্যান্ডালের তথ্যও বাদ নেই! এখন বুঝি সে যুগে, অন্তঃজাল (ইন্টারনেট!) গুগল ছিল না, এভাবেই মানুষ নিজেদের মধ্যে সংবাদ আদান প্রদান করত! তথ্য বিনিময়- বা মাস মিডিয়ার যা কাজ – এ বারান্দায় বসেই তা হয়ে যেত!~ আমিও অনেক সময় বড় আব্বুর পাশে বসতাম – তিনি পাণ খেতেন। তার পান আনা, বড় আম্মুর কাছে তাঁর প্রয়োজনে ‘মেসেজ পাঠানো, একে তাকে ডাকার খুচরো কাজ করতে হত! আমি তাঁর অতি আদরের, স্নেহধন্য মানুষ হিসেবে খুশী মনেই করতাম এসব!
এমনই একদিন গোসল শেষে তিনি এলেন বৈঠক খানায়! দুপুরের খাবার আয়োজন হয়ে গেছে!– সেদিন ছিল আমার ছুটির দিন। আমিও তাঁর পাশে বসে! এবার হূকূম হলে তার খাবার পদগুলো একের পর এক আসতে থাকল। সেগুলো যথাক্রমেঃ
১। মাঝারী এক ডিশে আমণ ধানের চাউল থেকে রান্না – সাদা ভাত । সরপোষ তুললেই একটু লালচে ছোঁয়া দেখা যেত সাদা ভাতের উপরে, ‘এলিউরোণ এর স্তর, – সেদিক থেকে বর্তমানের ফকফকে সাদা ভাতের চেয়ে স্বাস্থ্যকর!
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের মত আমাদের পূর্বপুরুষগণও কৃষিনির্ভর ছিলেন, সে সময়ে আমাদের বাড়ীতে আমণ ধানের চালই বারো মাস খাওয়া হত । আমণ ধানের মধ্যে, কাল বর্ণের এক ধরণের ধানের চাল ব্যবহৃত হত- নিয়মিত ভাত রান্নার জন্য। পোলাও, পায়েস বা অন্য স্পেশাল রান্নার জন্য ছিল ‘কালজীরা বা চিনিগুড়া, কিম্বা কাটারি ভোগ! । পান্তা ভাতের জন্য ছিল আর এক ধরণের ধান, মূড়ি ভাজতে ব্যবহৃত হত ভোজণ কর্পূর – একটু সরু, এবং লম্বা মত ধান। চিড়া কূটতে আরেক ধান, পিঠা বা পার্বণের জন্য বা আতপ চাল করতে আরেক ধরণের ধান! মোট কথা কমপক্ষে বারো রকমের ধানের কথা আমি জানতাম – এখনকার দিনে ‘অল ইন ওয়ান’ নয়। মানুষের খাওয়ার শৌখিনতা ছিল, অবশ্য সামর্থ অনুযায়ী।
২। টাকী মাছের ভর্তাঃ
ভর্তা অন্য মাছেরও হতে পারে, তবে টাকী মাছ ভর্তা হচ্ছে স্পেশাল! তরতাজা টাকী মাছ কেটে, ছিলে (আক্ষরিক অর্থেই) , লবণ, পেঁয়াজ, কাচা মরিচ, হলুদ, সরিষার তেল ও আরো কিছু ঊপাচার সহযোগে প্রথমে সেদ্ধ করা হত! এবং ধীর- তাপে পানিকে শুকিয়ে ফেলা হত। বেশী শুকিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা হলে সরিষার তেল যোগ করা হত, সম্পূর্ণ না শুকাতে দিয়ে মাছের টেক্সচার/ ময়েসচার ঠিক রাখা এবং তেলের ফ্লেভার যোগ করার জন্য! এবার ঠাণ্ডা করে, নিখুঁত ভাবে একটা একটা করে কাঁটা বেছে –আগের সে সেদ্ধ কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ – তেল ও লবণ সহ হাতে মেখে ভর্তা করা হত। নিখুঁত পেস্ট –নরম নয়, শক্তও নয়, এক সেমি সলিড ডেলীক্যাসী ! অবশ্য বাড়তি ফ্লেভার এর জন্য শুকনো লাল মরিচ আলাদা ভাবে তেলে ভেজে মূচমূচে করে- তা যোগ করা হত!
৩। শীল আলুর ভর্তাঃ
সাধারণ আলুর মত গোলাকার নয়, এই শীল আলুর বর্ণ কালচে লাল, –লম্বাটে ধরণের, কিছুটা ডাম্বেলের আকৃতি, গায়ে ‘চোখের গর্ত গুলো দৃশ্যমান । এই আলু ভর্তারও কিছু ‘তরীকা রয়েছে। ভাতের মধ্যে সেদ্ধ করে - সে আলু ভর্তা হবে না, স্পেশাল ভাবেই তা সেদ্ধ করতে হবে। এরপর ‘কাঠের হামান দিস্তায় গরম গরম তা স্ম্যাশ করতে হবে! এদিকে ফ্রাই প্যানে তেল গরম হচ্ছে, তাতে প্রথমে শুকণা মরিচ মুচমুচে করে ভেজে তুলে রেখে, এবার পেঁয়াজ ভাজতে হবে! যখন গাঢ় বাদামী রং নেবে এবং মূচমূচে হবে, তখন কাঠের ‘শীলের তলায় মেশানো আলূর পেস্ট এর সাথে ভাল মত সেই মুচমুচে মরিচ ও পেঁয়াজ মেশাতে হবে! এবার পরিমাণ ও স্বাদ অনুযায়ী লবণ ও খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে হাতে মেখে তা ভর্তা করতে হবে! উত্তম রুপে মথিত হয়ে তা প্রকৃত বাদশাহী খানার ‘ভর্তায় রূপ নেবে। সময়, প্র্যাকটিস ও নিষ্ঠা –ছাড়া এ জিনিষ তৈরি করা যাবে না! শীল আলুর ভর্তা হয়তো যে কেউ করতে পারবে, তবে বাদশাহী খাণার ‘মান সম্মত শীল আলুর ভর্তা সেটা হবে না! উল্লেখ না করে পারছি না, কারমাইকেল কলেজে ইসলামের ইতিহাস পড়ান আমার এক মামা। শীল আলুর ভর্তার কথা মনে হলেই সেই সেই মামীর হাতের ‘ভর্তার কথা মনে পরে যায়! অতীত দিনের স্মৃতি! আহা!
৪। মসূরের ঘণ ডালঃ
বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হলে সরবরাহ করা ডাল নামের অপভ্রংশ - যা দিয়ে হাত মূখ ধোয়া চলে, এমণ ডাল দিয়েতো আর বাদশাহী খাণা হবে না! আমার আম্মূ, বড় আম্মূ রান্না করতেন –নিজেদের ক্ষেতের ‘কীটনাশক বিহীন মসূর ডাল! যা পানিতে ভিজালে সদ্যোত্থিত সূর্যের মত লাল দেখাত! এর ঘণ সিরায় ডূবে থাকতো ভাজা পেঁয়াজ এর ক্বাথ! যখন পাঁচ ফোঁড়ন দিয়ে বাগাড় দিতেন- গোটা পাড়ায় খবর হয়ে যেত! দু চারটে লাল সবূজ কাঁচা মরিচ সে ডালের মধ্যে এদিক সেদিক খুশিতে ডূব সাঁতার কাটতো! সেদিন আর কোথায় । এখন পেঁয়াজ একটু কড়া করে ভাজলেই ‘ঘরের স্মোক ডিটেক্টর (Smoke Detector) চিল্লাপাল্লা শুরু করে আর ধেয়ে আসতে নেয় ফায়ার ব্রিগেড!
৫। শিং মাছের ঝোলঃ তিন ইঞ্চি সাইজের শিং মাছের বাচ্চা নয়, প্রমাণ সাইজের তরতাজা শিং মাছ। মরা মাছ হলে তা ভক্ষণের অযোগ্য! ( সে সময়ে আমাদের বাড়ির রীতি অনুযায়ী)। কেটে পেটের নাড়ীভুঁড়ি বের করার পরে, মাটির হাঁড়ির পেছন দিকে কিম্বা পানির ‘চাড়ীর পেছনে ঘষে ঘষে এর কালো রং দূর করতে হবে! কাজের মেয়ের হাতের নখ ক্ষয়ে যেত এ কর্ম করতে গিয়ে! এবার সে মাছ ফিরে আসবে- এবং বড় আম্মূ বটী নিয়ে আবার বসবেন -। সফল সার্জনের দক্ষতায় পীঠের দু পাশ থেকে ‘দুটো শিরা মাছের গা কেটে উঠিয়ে নেয়া হবে (শুনা কথা এই শিরার মধ্যে নাকি বিষ থাকে, শিং মাছের কাঁটার ঘা যারা খেয়েছেন, তাদের জানার কথা শিং মাছের শিং এর এই বিষের কি যন্ত্রণা !) এবং পছন্দমত টুকরো করা হবে! এবার তা রান্নার জন্য তৈরি! বেশীর ভাগ সময়ে শুধুই মাছ রান্না হত-। লাল হলুদ ঝোলের মধ্যে শিং মাছ, কখনো সখনো ‘সিজণাল তরকারী এতে ঢুকতে পেত! পাটায় পেষা মশলাদির সহযোগে রান্না করা শিং মাছের ঝোলের স্বাদ ও গন্ধ এখনো মনে পড়ে!
এর সাথে যোগ হয়েছে বাড়ির পেছনে লেবু গাছ থেকে সদ্য পেরে আনা লেবুর টুকরা! মসূর ডালে লেবু যোগ করে দেখবেন – এ কেমিস্ট্রি যেন সোনায় সোহাগার মত, খিচুড়িতে ঘি এর মত! এর মজাই আলাদা!
তাঁর জন্য সেদিন এসেছিল এই পদ গুলোই- আমন ধানের চালের ভাত, শীল আলু ভর্তা, টাকি মাছের ভর্তা, ঘন মসূরের ডাল, শিং মাছের ঝোল, দুই টুকরা কাগজি লেবু- । এলাকার প্রভাবশালী জোতদার হিসেবে গণ্যমান্য হলেও, আমার বড় আব্বু কোন রাজা বাদশাহ ছিলেন না। এগুলো কোন রাজা বাদশাহের দরবারের খানাও নয়, এখানে নেই কোন মুঘলাই আয়োজন, নেই পোলাও কোরমা – বিরিয়ানী মাংস! সেগুলো খাওয়ার সামর্থ তাঁর যথেষ্ট ছিল এবং খেতেনও। তবু এই অতি ‘সাধারন খাবার গুলো তাঁর অতি পছন্দের খাবার ছিল এবং সেই সাথে তাঁর মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ ! তাঁর পছন্দের পদগুলো এক সাথে দেখেই উচ্ছসিত হয়ে তিনি মন্তব্য করলেন – “এই হচ্ছে আমার বাদশাহী খানা”!
এই হল সেই বাদশাহী খানা!!
বড় আব্বু বেহেশতবাসী হয়েছেন। কেউ পছন্দের খাদ্য বা বিশেষ খানার কথা মনে করিয়ে দিলেই আমার মনে পরে যায় - বড় আব্বুর সেই বাদশাহী খানা! প্রবাসী মন নিমেষে ফিরে যায় সেই ছেলেবেলায়! চলন বিলের এক প্রান্ত ঘেঁষে এক ছায়া সুনিবিড় গ্রামে! পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ – বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরার সুযোগ হয়েছে- পায়ে চাকা লাগানো থাকলে- হয়তো ‘ওডোমিটার বদলাতে হত দু-একবার! ভিন্ন ভিন্ন দেশের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির- ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়েছে- এবং এখনও খেয়ে যাচ্ছি ( শুধু হালাল হলেই !) কিন্তু সেই ছেলেবেলায়, মনের উপরে গভীর ছাপ ফেলা যাওয়া, বড় আব্বুর স্পেশাল পছন্দের সেই খাবার, তাঁর সেই দিনের সে আবেগ প্রবণ, উচ্ছসিত মন্তব্য কখনো বিস্মৃত হই নি! গ্রামের সরল সহজ জীবন যাত্রায়, –অধিকাংশ মানুষের ‘ সামর্থের মধ্যে- এই সাধারন আইটেম গুলো মিশে এক বিশেষ আবহ তৈরি করেছে আমার মস্তিস্কে, মননে!
নাই বা থাকল ষড় – ব্যঞ্জন সমৃদ্ধ রসনা বিলাস, নাইবা থাকল মোরগ মূশাল্লাম – কিম্বা আলীশাণ বিরিয়ানি কোর্মা – কাবাব কোফতা - চর্ব্য – চোষ্য – লেহ্য- পেয়, সব কিছু মিলিয়ে, সেই সাধারণ ঘরোয়া খাবারগুলোই আমার কাছে এখনও বাদশাহী খানা!!
বিষয়: বিবিধ
২৩১৯ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যেসব খাবারের ছবি দিলেন হেডিংয়ের সাথে মিলাতে কষ্ট হচ্ছে , বিশেষ করে
কে মনে হয়েছে বুটের ডাল এবং
এ শিং মাছ এর টুকরো আছে কি না বা ঝোলের কালার এরকম সাদা হয় কি না মনে হয়েছে । এটাকে বরং চিংড়ির কোন কারিকুরিই মনে হয়েছে ।
তো মনে হয় নি , মনে হয়েছে চিংড়ি মাছের কোন স্পেশাল কারিকুরি । টাকি মাছের ভর্তার কালার আজীবন সবুজাভ দেখে এসেছি।
বর্ণনা শুনে মনে হল যে এই আলু বাজারে দেখেছি । এত কাহিনী করে ভর্তা করা যায় নাকি আজকাল ?
পোস্ট ভালই লেগেছে ।
একটা ছড়া মনে পড়ে গেল!
মালয় দ্বীপে একযে –- শেয়ালে
ক্ষুধা পেলে মূরগী এঁকে দেয়ালে
আপন মনে চাটতে থাকে খেয়ালে!
সৌভাগ্য আমাদেরকে ছবি ‘লেহন করতে হবে না, হাতের কাছেই উপাদান গূলো রয়েছে !
আপনার বিশ্লেষন দেখে মজা পেয়েছি ! ধন্যবাদ আপণাকে!
হুমম, সাধারন খাবারের অসাধারন কম্বিনেশন। লেখাটা অনেক দীর্ঘ হলেও পড়ে ভাল লাগল.....।
রোযার পড়ে আবার পড়ার সুযোগ তো থাকছেই। রামাদান মুবারক!
মন্তব্য করতে লগইন করুন