ডোল--শস্য সংরক্ষণের জন্য বাঁশের তৈরি বড় আকৃতির পাত্র বিশেষ

লিখেছেন লিখেছেন গোলাম মাওলা ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ১২:০৯:৫৬ দুপুর

ডোল-- শস্য সংরক্ষণের জন্য বাঁশের তৈরি বড় আকৃতির পাত্র বিশেষ



ঐতিহাসিক ভাবে আমরা ও আমাদের সংস্কৃতি অনেক পুরানো। আর আমাদের এই হাজার বছরের সংস্কৃতি পরিপূর্ণ শত শত উপাদান দিয়ে। সেই উপাদান গুলি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে। আর কিছুদিন পর এই উপাদান গুলির নাম হয়তো কেও মনেও রাখবে না। হয়তো পুরানো কারো কারো স্মৃতিতে ঝলক দিয়ে যাবে হঠাৎ হঠাৎ। আসুন আজ জানি --- প্রায় হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার জনজীবনের সঙ্গে এক সময় ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে থাকা একটি উপাদান ডোল সম্পর্কে। একে চট্টগ্রামের ভাষায় কাইজ্জ্যাও বলা হয়।



শুরুর কথাঃ ঐতিহ্যবাহী ধান মজুত রাখার পাত্র হিসাবে ব্যবহৃত বাঁশের তৈরি ডোল ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮০ দশকেও কৃষকের ঘরে ঘরে ডোলের চাহিদা ছিল প্রচুর। কৃষকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎপাদিত বার মাসের ধান বাঁশের তৈরি ডোলে মজুদ রাখা হতো। পোকামাকড় ও ইঁদুরের হাত থেকে ধানরক্ষার বিকল্প না থাকায় তৎকালীন সময়ে এখানকার হাজারো পরিবার ডোল তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসত। দু’চারজন বড় গেরহস্থ ছাড়া ছোট-খাটো কৃষকরা এখন আর সেভাবে ধান মওজুদ রাখতেই পারেননা। খাওয়া-সাংসারিক সব খরচ মিটিয়ে যে সামান্য ধান থাকে তা কেউ বস্তায় কেউবা অন্য বাসন-কোসনেই রেখে দেন। ফলে এক সময়কার কৃষকদের অতি প্রয়োজনীয় ধানের ডোল এখন আর সচরাচর চোখেই পড়েনা। আর ৫-১০বছর পর হয়তোবা নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা হঠাৎ দেখে ধানের ডোল চিনতেই পারবে না। বাঁশ দিয়ে তৈরি ডোলে গেরহস্তরা সারা বছর ধান-চাল ও অন্যান্য শস্য সংরক্ষণ করতেন। যা ছিল গ্রামবাংলার প্রধান বৈশিষ্ট। কিন্তু কালক্রমে তা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। ধানের মওসুমে ধান কেটে তা শুকিয়ে করা হতো ডোলজাত। এমন এক সময় ছিল, যখন ডোলভরা ধান বা চাল না থাকলে গ্রামবাংলার গেরহস্তরা সেই বাড়ীতে বিয়েই করাতেননা বা দিতেননা। এখন ও এসব কথা শুনা যায় মুরব্বিদের মূখে-মূখে। এমন কথাও শোনা যায় চোর-ডাকাতের ভয়ে অনেক গেরহস্ত ডোলের ধানের বা চাউলের মধ্যে টাকা-পয়সা এমনকি স্বর্ণালংকার পর্যন্ত লুকিয়ে রেখে সংরক্ষণ করতেন। যাতে চোর-ডাকাতরা টাকা-পয়সা বা অলংকার চুরি-ডাকাতি করে না নিতে পারে।

বাঁশ দিয়ে ধানের ডোল তৈরী করা হতো। অত্যন্ত মজবুত করে তৈরী করা হতো যাতে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। এসব ধানের ডোল ২০-১০০মন, পর্যন্ত ধান মজুদ রাখা যায়। এসব ডোল তৈরি করা হয় গেরহস্তের প্রয়োজন অনুযায়ী। হাট-বাজারেও বিভিন্ন প্রকারের ডোল কেনা বেচা হয় এখনো কালে-ভদ্রে।



ডোল কি ভাবে তৈরি হয়ঃ

ডোল তৈরির মুল উপাদান হল বাঁশ। তবে অনেক এলাকায় বেতও ব্যাবহার করা হয়। বাঁশের লম্বা লম্বা পাট হতে তৈরি হয় ডোল। তবে অনেক আগে প্রাচীন মানুষেরা নলখাগড়া বা নরম লতা জাতীয় উদ্ভিদ হতে নিজেদের প্রয়োজনে তৈরি করত পাত্র বিশেষ। আর তারই ধারাবাহিকতায় ডোল। এই ডোল কৃষিজীবী গ্রামীণ পরিবারের একটি অপরিহার্য উপকরণ । কুটির শিল্পীরা বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে বাঁশ-বেত দিয়ে এসব ডোল তৈরি করেন।ওজনের চাপে ডোল যাতে ভেঙ্গে না যায় সেজন্য চারপাশ চতুর্ভুজ আকৃতির ঘন ঘন বাঁশের ফ্রেম দিয়ে বেঁধে দেয়া হয়। ভাল বাঁশের তৈরি ডোল দশ বছরেও নষ্ট হয় না। একেকটি ডোলের ধারণ ক্ষমতা থাকে কমপক্ষে দশ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ মণ পর্যন্ত। কিন্তু প্লাস্টিক ও টিন জাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধিসহ বাঁশ-বেতের সঙ্কট ও দুর্মূল্যের কারণে ডোল এর প্রয়োজন দেশের কৃষকদের কাছে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে।



ব্যবহারঃ

কৃষকের উৎপাদিত কিংবা ক্রয় করা ধান-শস্য সংরক্ষণ করার কাজে বাঞ্ছিত অন্যতম বাঁশ দিয়ে তৈরি ডোল । এ ছাড়া আর এক কাজে এই ডোল ব্যবহার করা হত। আর তাকে বলা হত ডোল ফেলা । এটি হল ধান হতে চাল করার কাজে কৃষকরা বা গৃহস্থরা পুকুরে ধান ভেজাবার কাজে এই ডোল ব্যবহার করত। বড় বড় গৃহস্থরা সারা বছরের চাল করার জন্য ৫-৬ টা ডোলে করে ধান ভিজিয়ে তা হতে চাল করত। আজ সে সব স্মৃতি।

ক্রয় বিক্রয়ঃ

প্রতিটি ডোল বিক্রি হয় ৩০০-৩৪০ টাকায় । একটি ডোল তৈরিতে খরচ হয় ২৫০ থেকে ২৫৫ টাকা আর এ হিসাবে একটি ডোল বিক্রি করে ৫০ থেকে ৮৫ টাকা । এর মধ্যে রয়েছে যাতায়াত ও হাটের খাজনা খরচ। ফলে লাভের পরিমাণ খুবই কম।

যে ভাবে সংরক্ষণ করা হত ধান –চালঃ

কৃষকেরা সাধারণত ডোল ( সংরক্ষণের জন্য বাঁশের তৈরি বড় আকৃতির পাত্র বিশেষ) ব্যবহার করে। ধান-চাল বা অন্যান্য শস্য সংরক্ষণ করতে হলে নীচের কৌশলগুলো অনুসরণ করতে হবে।

১ম ধাপ------- গোবর ও মাটি একসাথে মিশিয়ে ডোলের ভেতরে ও বাইরে এমনভাবে লেপে দিয়ে রোদে শুকাতে হবে যাতে ডোলের ছিদ্র ভালো ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ডোলের শরীর বাতাস প্রুফ করা হয়।

২য় ধাপ-------- এর পর সেই ডোল কে ঘরের নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে এরপর ভালো ভাবে রোদে শুকানো ধান-চাল বা অন্যান্য শস্য ঠান্ডা করে ডোল এ রাখতে হবে।

৩য় ধাপ ------- সবশেষে উপরের ডোলের গলা বা মুখ একটু খালি রেখে ডোলে রাখা ধান-চাল বা অন্যান্য শস্যের উপর প্লাস্টিক বা কাগজ দিয়ে ভাল মত আস্তরণ দিয়ে তার উপর অংশে ছাই অথবা শুকনা বালি দিয়ে কমপক্ষে ৩ ইঞ্চি পুরো করে ছিটিয়ে ঢেকে দিতে হবে।

উপকারিতা

১) বালির আবরণ থাকার ফলে গুদামজাত ধান-চাল বা অন্যান্য শস্য উপর পোকা ডিম পাড়তে পারে না, ফলে পোকার আক্রমণ থেকে ধান-চাল বা অন্যান্য শস্য রক্ষা করা যায়।

২) খুব কম খরচেই এ পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়।

৩) এটি দূর্যোগমুক্ত এবং পরিবেশ বান্ধব একটি পদ্ধতি।

সচরাচর জিজ্ঞাসা

প্রশ্ন ১ : এই পদ্ধতি ব্যবহারে কি ধরনের উপকারিতা পাওয়া যায় ?

উত্তর : এ পদ্ধতি ব্যবহার করার ফলে বিভিন্ন পোকার আক্রমণ থেকে ডাল রক্ষা করা যায়।

প্রশ্ন ২ : এ পদ্ধতির কি পরিবেশের উপর কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে ?

উত্তর : না, বরং এটি দূর্যোগমুক্ত এবং পরিবেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি পদ্ধতি।

বিষয়: বিবিধ

২৪২৫ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

266471
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০১:২০
চোথাবাজ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:০৪
210559
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ
266533
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:০৬
গোলাম মাওলা লিখেছেন : | ধন্যবাদ
266585
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ০৮:৩৩
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো
ডোল প্লাস্টিক বা সিনখেটিক বস্তার থেকে অনেক বেশি পরিবেশ সম্মত।
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দুপুর ০৩:০৪
210558
গোলাম মাওলা লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File