আন্দোলনের বিপরীতে সরকারের কৌশল মধ্যযুগীয়
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারমোহাম্মদ ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৭:৫১:২৯ সন্ধ্যা
সিকদার মোহাম্মদঃ
হালে আওয়ামী লীগ যেভাবে যেনতেন ভাবে ক্ষমতা আটকে রাখার বা টিকে থাকার কৌশল যেমন অবলম্বন করছে, তেমনি সরকার বিরোধী হরতাল-অবরোধ ইত্যাদিতে আন্দোলনকারীরা বদলিয়েছেন আন্দোলনের কৌশল । সরকার মনে করছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদিয়ে রাজধানীতে আন্দোলন দমিয়ে রাখতে পারলে ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে । সে জন্য তারা ব্যাপক সংখ্যক আইন শৃঙ্খলাবাহিনীকে শহরগুলোর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ,গলিপথের মুখে বসিয়ে আন্দোলন দমানোর কৌশল গ্রহণ করেছেন । ক্ষমতার শেষ সময়ে এসে প্রশাসনকে তাদের পক্ষে রাখার জন্য দিচ্ছেন নানা রকমের প্রনোদনা । অবস্থাদৃষ্টে মনেহয়, সরকার সেই মধ্যযুগীয় শাসকদের পথেই হাটছেন । যারা মনে করতেন রাজধানী টিকিয়ে রাখতে পারলেই শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা সম্ভব । এই সব ক্ষেত্রে জনগণ বা বিরোধীপক্ষ বিবেচনারই কোন বিষয় না ।
ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্য যুগের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যে কোন ভাবে রাজধানী শহরের পতন ঘটলে পুরো রাজবংশেরই পতন ঘটত । পতিত রাজবংশ যতই পরাক্রমশালী বা শৌর্য-বীর্যের সাথে যত দিনই শাসন করুন না কেন, রাজধানীর পতনের পর তাদের করুণ ও বিয়োগাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হতো । এজন্য তারা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের প্রতি কোন মনোযোগ প্রদান না করলেও রাজধানীর নিরাপত্তায় সদা ব্যস্ত থাকতো । এর অবশ্য কারণ ছিল রাজধানীতে বরাবরই বসবাস করত সুবিধাভোগী গোষ্ঠী আর সারা দেশে বাস করত খেটে খাওয়া মানুষ, যাদের ঘামের বিনিময় শাসক শ্রেণী বিলাস ব্যসনে মত্ত থাকতো । এটা এতোটা গতানুতিক হয়ে যেত যার কারণে দেশে কবে কোন রাজা ক্ষমতায় আসতো, কাদের কখন পতন ঘটতো তার প্রতি সাধারণ প্রজাদের তেমন কোন আগ্রহই ছিলনা ।
৭১’র মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল একটি সর্বাত্মক প্রতিরোধ আন্দোলন । এ আন্দোলন গ্রাম,শহর,পাড়া-মহল্লা সব স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল । সর্বস্তরের মানুষ তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন । সময়ে প্রয়োজনে, সবাই এক হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যার যা ছিল তা নিয়ে নেতার নির্দেশের অপেক্ষা না করেই দেশ স্বাধীন করেছিলেন । এতে কাজ করেছে অভূতপূর্ব উদ্দীপনা, এর সাথে জাতীয় জীবনের কোন ঘটনাই তুলনীয় নয় ।
নব্বইর দশকে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ছিল অনেকটা শহর কেন্দ্রীক । তখন আন্দোলনকে চাঙ্গা করার জন্য প্রায় প্রতি বছর ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচি প্রদান করা হতো ।এর অর্থই ছিল ঢাকার মানুষগুলো ছিল আন্দোলন বিমুখ । মধ্যযুগে রাজধানী শহরে বাসকরা সুবিধাভোগী শ্রেণীর মতোই তখন ঢাকাশহরে একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। এরশাদ শহরের লোকজনদের জন্য বিশেষ বিশেষ সুবিধা উপভোগের আয়োজন করেছিলেন, বিশেষ করে প্রশাসনে লোকদের জন্য । ফলে দেশময় যতই আন্দোলন অবস্থা বিরাজিত ছিলনা কেন তা থেকে তারা দুরত্ব বজায় রেখে চলতো । শেষ পর্যন্ত ছাত্রসমাজের আন্দোলনের তোড়ে এরশাদশাহী উড়ে যান ।
৯৬’র তত্ত্বাবধায়ক আন্দোলন অনেক সহিংস হলেও হালে পানি পাচ্ছিলনা । তখনকার আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাগুরার উপনির্বাচনে ভোট কারচুপির কারণে আন্দোলনের যৌক্তিকতা ছিল । কিন্তু সে সময়ের সরকার পাঁচ বছর মেয়াদ অতিক্রম করে । ১৫ ফেব্রুয়ারীর একতরফা নির্বাচন করে নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই পা দেন । ফলে সংবিধানে কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংযুক্ত করে বিদায় নেন । এই আন্দোলন আওয়ামী লীগ -জামায়াত- জাতীয় পার্টির যুগপৎ হবার কারণে বিএনপি প্রায় এক ঘরে হয়ে পরে । আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তৎকালীন ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হানিফের ‘জনতার মঞ্চ’ আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপদেয় । সে আন্দোলনে গ্রামের লোকদের ঢাকায় আন্দোলনে যোগ দেবার আহ্বান ছিলনা । তবে এরশাদের তৈরি সুবিধাভুগীদের একটি অংশ জনতার মঞ্চে যোগ দিয়ে প্রথম একধরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন , যা নিয়ে পরবর্তিতে আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয় । তবে সে সময়ের বেগম জিয়ার সরকার আন্দোলন সংগ্রামের জন্য সুযোগ দিয়েছিলেন, বর্তমান আওয়ামী লীগের চেয়ে অনেক বেশী গণতান্ত্রিক আচরণ করেছিলেন বলেই ৯৬’র আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে । সেই তুলনায় এখন কোন গণতান্ত্রিক পরিবেশ আছে বলে মনে করা যায় না । সেটা মেধাবীদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন থেকে যুদ্ধাপরাধ বিচার বিরোধী কোন আন্দোলনের সাথেই আওয়ামীলীগ সরকার গণতান্ত্রিক আচরণ করেনি ।
এই কারণেই আন্দোলনের গতি প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে । যুক্ত হয়েছে নাশকতা । আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে এমনকি শহরের পাড়া মহল্লায়, আন্দোলনকারীরা বেছে নিচ্ছে নগরীর অদূরের স্পটগুলোকে যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য পৌঁছানো কষ্টকর । আন্দোলনের কৌশল হিসেবে রাজধানী শহর কে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে । বেড়েছে আন্দোলনে গ্রামের গণমানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ ।
শহরের বাইরের সড়কগুলোতে গাছের গুঁড়ি ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে । গাড়ি থামিয়ে ভাঙচুর, কেরোসিন ঢেলে আগুন দেয়া, গাড়ি উল্টে গর্তে ফেলে দেয়ার মতো কর্মকান্ড করছে সাধারণ আন্দোলনকারীরা । দেশীয় ঢাল-বল্লমে সজ্জিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ ন্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রাত জেগে নেতা কে রক্ষাকরার জন্য বসাচ্ছে পাহাড়া । মামলার কোন আসামীকে গ্রেফতার করতে গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সম্মুখিন হচ্ছে গ্রামবাসীর সম্মিলিত প্রতিরোধের ।
তবে হাল আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি প্রবনতা লক্ষ করা যাচ্ছে, আর তাহল, অর্জিত অর্থ সম্পদ রক্ষা ও জেল জুলুম থেকে বাঁচতে আপোষকামীতার মনোভাব । বিগত দুই দশকে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী একটি গ্রুপের জন্ম হয়েছে যারা রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করে অনেক বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে গেছেন । নিজ দল ক্ষমতায় থাকলে যারা দলীয় প্রভাব বিস্তার করে প্রভূত অর্থ এবং সম্পদের মালিক হয়েছেন। আদর্শের কারণে নয় বরং অর্থ ক্ষমতার লোভে এরা রাজনীতি করেন , নিজ দল ক্ষমতায় এলে অর্থ উপার্জন করে দল ও দেশকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে নিমজ্জিত করেন । আর নিজ দল ক্ষমতায় না থাকলে তা রক্ষার জন্য সরকার পক্ষের সাথে আপোষ করে চলেন ।এই কারণে সে সকল নেতাদের দ্বারা আন্দোলনের কাংখিত নেতৃত্ব এখন আর চোখে পড়ছেনা । এবং ভবিষ্যতেও বাংলাদেশে ন্যায় সঙ্গত আন্দোলন নিয়ে একই পরিস্থিতি তৈরি হবে বলেই বিশ্লেষকদের ধারণা । এটা দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য একটি নেতিবাচক প্রবনতা বলেই মনে করছেন বোদ্ধা মহল ।
( এই লেখাটি ০৩ ডিসেম্বর ২০১৩, মঙ্গলবার এওয়ান নিউজে প্রকাশিত হয়েছে )
বিষয়: রাজনীতি
১০৮৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন