কেন এই নৃশংসতা ?

লিখেছেন লিখেছেন শিহাব আহমদ ১২ আগস্ট, ২০১৫, ১২:২৯:৩০ রাত

নির্মম সহিংসতায় নিভে যাচ্ছে শিশুসহ বহু মানুষের প্রাণ। সভ্য সমাজের নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে নৃশংস হত্যাকান্ড। এসব হত্যার ধরন এমনই যে পাষন্ড হন্তারকরা নৃশংসতার দিক দিয়ে পাশবিক বর্বরতাকেও হার মানাচ্ছে। অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, আজকের বীভৎসতা হারিয়ে যাচ্ছে আগামীকালের নৃশংসতায়। চরম নির্মমতায় প্রাণনাশ হচ্ছে শহরে-বন্দরে, হাটে-বাজারে, রাস্তা-ঘাটে, নদী-নালায়, এমনকি গৃহের নিভৃত কক্ষে। সবকিছু দেখে শুনে মনে হচ্ছে দেশ এক বিভীষিকাময় মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে। আমরা সবাই যেন শব-মিছিলের যাত্রী হয়ে চলছি এক অজানা অচিন মৃতপুরীর দেশে। এমন কি এ থেকে বাদ পড়ছে না আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিশুরাও। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম জানিয়েছে, ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ (জুলাই) পর্যন্ত সাড়ে তিন বছরে দেশে ৯৬৮টি শিশুকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এ সংস্থার তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালে শিশুহত্যার হার আগের বছর ২০১৩ সালের চেয়ে প্রায় ৬১ শতাংশ বেশি ছিল। তাদের তথ্য মতে এ বছর হত্যার পাশাপাশি নৃশংসতাও বেড়ে গেছে। এই ছোট্ট একটি তথ্য আমাদের সামনে এক বিরাট প্রশ্নের উদ্রেক করে। জাতির ভবিষ্যৎ শিশুদের প্রতি এধরনের আগ্রাসী ও নির্মম আচরণ আমাদের কোন্ মানসিকতার পরিচয় বহন করে? কেন আমরা এত নির্দয় পাষাণ হয়ে উঠলাম তাদের প্রতি, আমাদের মধ্যে কি নেই কোন নৈতিক শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ, দয়া-মায়া, স্নেহ-মমতা? জাতির কাছে এসব প্রশ্ন সত্যিই লজ্জাজনক। হ্যাঁ, এর বিপরীত চিত্রও রয়েছে। রাজন হত্যার নৃশংসতায় সাধারণ মানুষের অন্তর মর্মভেদী যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সর্বত্র, রাজপথ মানব-বন্ধন ও মিছিলে হচ্চে সোচ্চার। তবে এর নেই কোন প্রতিকার। কারণ এই দেশে এখন 'প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে'।

অস্বাভাবিক নির্মম হত্যার ফাঁদে পড়েছে দেশ। বড় বড় হত্যাকান্ডেও যখন মামলা নিতে ও আসামী ধরতে গড়িমসি করা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই খুনীরা উৎসাহ পায়। তাদের খুনের তালিকা বড় হতে থাকে। একের পর এক সিরিজ খুন চলতেই থাকে। মামলা নিয়ে খুনীদের খুঁজে বের করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পুলিশের তেমন উৎসাহ নেই। কারণ তারা সরকারের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদেরকে ধরার নামে গ্রেফতার-বাণিজ্যে এতই ব্যস্ত যে দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই। এছাড়া দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিয়েছে। তাদের ক্রসফায়ার, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড, গুম ও নির্যাতনে নিহত হচ্ছে অনেকে। তাই সরকার গুম-খুন-অপহরণেও আন্তর্জাতিক খেতাব লাভ করেছে। অপহরণের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধ, সর্ব ক্ষেত্রে দুর্নীতি, শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন, বিদেশে চাকুরীর নামে মানব-পাচার ও দাস ব্যবসা, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের উপর পুলিশী নির্যাতনের মত এখন গুম ও অপহরণের শীর্ষ তালিকায়ও বাংলাদেশের অবস্থান নির্ণীত হয়েছে। বাংলাদেশের এ নৈরাজ্যকর চিত্র বিশ্বে দেশ ও জাতির মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এসব বিষয়ে সরকারের অস্বীকৃতি ও উদাসীনতা বড়ই পীড়াদায়ক। কায়েমী স্বার্থের পৃষ্টপোষক এ সরকার সাধারণ জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণেই এ ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।

দেশের মানুষের শান্তি কোথাও নেই, নেই জীবনের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা। চলতে ফিরতে, সড়ক পথে নৌপথে সর্বত্রই মরণ-ফাঁদ। পথে পথে যে বেহাল অবস্থা চলছে তাতে প্রায় প্রতি দিনই ঘটছে যানবাহন দুর্ঘটনা, প্রাণনাশ হচ্ছে হাজারো মানুষের। এসব পথে অবিরত মৃত্যুর মিছিল ও শোকার্ত মানুষের আহাজারীতে ভরে উঠছে বাংলাদেশের আকাশ-বাতাস। ঈদের আনন্দে ঘরে ফিরতে অথবা ছুটি শেষে ঘর থেকে কর্মস্থলে ফেরার পথে দুর্ঘটনায় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণ। ঘর থেকে বের হলে প্রাণ নিয়ে যে ফেরা যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। শুধু একটি দৃষ্টান্তেই এর ভয়াবহতা বোঝা যাবে। বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়কটি এমনই দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে যে, চলতি বছরে এ পর্যন্ত সেখানে ৩৪টি দুর্ঘটনায় ৭১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৩৩ জন। বিশ্বব্যাংকের জরীপের তথ্য মতে, বছরে প্রায় ১২ হাজার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরীপে এর সংখ্যা প্রায় ১৮ হাজার। লঞ্চ দুর্ঘটনায় প্রতি বছরে মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক বেশী। সড়ক দুর্ঘটনায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। এ সংস্থাটির হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ প্রতি বছর জিডিপির ১ থেকে ২ শতাংশ যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতের জীবননাশ ও পঙ্গুত্বের ক্ষতি হিসেব করলে তা হবে অপূরণীয় ক্ষতি। এসবের কারণ ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন যানবাহনের ব্যাপকতা, এমন কি চালকদেরও অধিকাংশের ভূয়া লাইসেন্স। এত দুর্ঘটনার পরও সরকারের টনক নড়ছে না। জনগণের প্রতি তাদের কোন দায়িত্ববোধ আছে কি না তা বোঝার উপায় নেই।

সব কিছু দেখে মনে হচ্ছে আইনের শাসন ও জবাবদিহির সংস্কৃতি আমাদের দেশ থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। সরকারের ক্যাডার ও মদদপুষ্টরা থেকে যাচ্ছে আইনের ঊর্দ্ধে। সরকার আইনের চেয়ে পেশী শক্তি ও পুলিশী নির্যাতনের উপরই বেশী নির্ভরশীল। এদের সহায়তায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে ক্ষমতায় টিকে থাকাই সরকারের মূল লক্ষ্য। ফলে সরকারের অবৈধ প্রশ্রয়ে বাড়ছে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, প্রশাসনে দলীয়করণ ও দুর্নীতি, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন-ভঙ্গের সংস্কৃতি, বিচার ব্যবস্থায় শৈথিল্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মত সেবামূলক খাতে বাণিজ্যিকরণ, আরও অনেক অপরাধ প্রবণতা। জবাবদিহির সরকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হলে এরকম নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলতেই থাকবে। লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্য দিতে না জানলে একদিন পরাধীনতার অতলে তলিয়ে যেতে হবে। মর্যাদাবান জাতি হিসেবে শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বেঁচে থাকতে হলে অবশ্যই আমাদেরকে গণতান্ত্রিক জবাবদিহির সরকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বিষয়: বিবিধ

১০১২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

335425
১২ আগস্ট ২০১৫ বিকাল ০৪:৩৩
শুভ কবি লিখেছেন : সুন্দর লিখেছেন, মাশাল্লাহ
335514
১২ আগস্ট ২০১৫ রাত ১০:১৬
শিহাব আহমদ লিখেছেন : ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File