তাতার মুসলমানদের অস্থিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ....
লিখেছেন লিখেছেন আমি আহমেদ মুসা বলছি ২২ মার্চ, ২০১৪, ০৯:২৬:০০ রাত
রুশ বলয়ভূক্ত ক্রিমিয়ার ঐতিহ্যসমৃদ্ধ তাতার মুসলিম জনগোষ্টী তিন শ’ বছরের বাধা-বিপত্তি ও গোলামীর জিঞ্জির ছিড়ে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রামে বিজয়ী হতে চলেছিল। অব্যাহত নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও গণ নির্বাসন চালিয়েও তাতারদের মুসলিম জাতিসত্ত্বা মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। আবার তারা জেগে উঠছে ধর্ম ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিজস্ব বলয়ে। কৃষ্ণ সাগরের উপকূলে আবার দেখা দিয়েছিল ইসলামী নবজাগরণ। নতুন নতুন মসজিদ ও ইসলামী কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছিল এবং আনুপাতিক হারে বেড়ে চলেছিল নামাযীদের সংখ্যা। উত্তরাধিকার ঐতিহ্য ও তাওহিদী চেতনায় জীবন গড়ার তাগিদ তীব্রভারে অনুভূত হচ্ছিল তাতারদের মাঝে। হারিয়ে যাওয়া তাতার ভাষার পুনরুজ্জ্বীবনের জন্য ক্রিমিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে গড়ে উঠেছিল তাতার ভাষা স্কুল। কিন্তু , ক্রিমিয়ার স্বাধীনতা এবং রাশিয়ায় অন্তর্ভূক্তি নিয়ে বিজয় ধ্বনিতে হারিয়ে যেতে বসেছে তাতার মুসলমানদের সে অর্জন। ইউক্রেন ছেড়ে রাশিয়ার আইনের আওতায় আসার প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে এখন চরম অনিশ্চয়তার মুখোমুখি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা বিতাড়িত হওয়া এবং তার আগে জোসেফ স্টালিনের দমনের শিকার হওয়ার পর ইউক্রেনকেই নিজেদের জন্য উপযোগী বলে মনে করে তাতাররা। আর তাই ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত করার চেষ্টায় শুরু থেকে বিরোধিতা করে আসছিল তারা। বর্জন করেছিল গণভোট। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়নি।আর শেষ পর্যন্ত নিজেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত হতে হচ্ছে তাদের।
★ক্রিমিয়ান তাতার★
ক্রিমিয়ান তাতার হচ্ছে কৃষ্ণ সাগরের উত্তর উপকূলে অবস্থিত ইউক্রেনের একটি স্বায়িত্বস্বাসিত প্রজাতন্ত্র। বহু উত্তান পতনের নীরব সাক্ষী ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়ার এ বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত বছর ধরে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও শাসকদের দ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে। ২৬, ২০০ কিলোমিটারের আয়তন বিশিষ্ট ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্রের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৯, ৭৩, ১৮৫ জন। ক্রিমিয়া হচ্ছে ক্রিমিয়ান তাতারদের জন্মভূমি, যারা নৃতাত্ত্বিকভাবে সংখ্যালঘু। গোটা জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ ক্রিমিয় তাতার।
★অস্থিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ....★
ক্রিমিয়ান তাতারদের পূর্বপুরুষ হচ্ছে তুর্কী। ত্রয়োদশ শতাব্দী হতে তারা ক্রিমিয়ান উপদ্বীপে বসবাস করে আসছে। মূল তাতারগণ পঞ্চম শতাব্দীতে গোবী মরুভূমির উত্তর পশ্চিমে বসবাস করত। নবম শতাব্দীতে খিতানগণ তাদের এলাকার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করলে তারা দক্ষিণ অভিমূখে যাত্রা করে। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মোঙ্গল শাসন কায়েম করে। চেঙ্গিস খানের দৌহিত্র বাতু খানের পরিচালনায় তাতারগণ পশ্চিম দিকে রাশিয়ার সমতল অভিমূখে রওনা হয়। যাত্রার সময় তারা তাদের সাথে তুর্কী উরাল বংশোদ্ভুত জনগণকেও সাথে নিয়ে যায়।
বর্তমানে ভাগ্য বিড়ম্বিত বিপুল তাতার রাশিয়া, ইউক্রেন, মলদোভা, লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, চীন, কাজাখস্তান, তুরস্ক ও উযবেকিস্তানে বসবাস করে আসছে। তাতার জনগোষ্ঠীর একটি অংশ হেলসিংকী, ফিনল্যান্ড ও নিউইয়র্কে হিজরত করে স্থায়ী আবাস গড়ে তুলেছে। গোটা দূনিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাতারদের জনসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
চেঙ্গিস খানের বংশধর বার্কাই খানের (১২৫৭-১২৬৭) আমলে তাতারদের সাথে ইসলামের পরিচয় ঘটে। উযবেগের (১৩১৩-১৩৪০) ক্ষমতায় আরোহণের আগ পর্যন্ত এতদঞ্চলে ইসলাম ব্যাপকতা লাভ করেনি। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতি তাতাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। চতুর্দশ শতকে পরিভ্রমণকারী পর্যটগণ এতদঞ্চলে ইসলামী সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিদর্শন প্রত্যক্ষ করেন। সময়ের বিবর্তনে ইসলামী অনুশাসন, সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রতি তাতারদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
কিপচাক সাম্রাজ্যের (Golden Hordes) পতনের পর উক্ত অঞ্চলের উপর গড়ে উঠা তাতার রাজ্য সমূহের মধ্যে ক্রিমিয়াই ছিল সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী স্বাধীন রাজশক্তি। ক্রিমিয়ার এই তাতার বংশের রাজত্বকাল ১৪২০ হতে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ সাড়ে তিন শ’ বছর স্থায়ী হয় এবং সিংকোরাপোলকে রাজধানী করে পর্যায়ক্রমে ৬২ জন তাতার খান ক্ষমতায় অধিষ্টিত থেকে রাজনৈতিক প্রাধান্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। কাজান বংশের প্রতিষ্ঠাতা উলুঘ মুহাম্মদের জনৈক ভ্রাতা তাশ-তিমুর তোখতামিশের সেনাপতি ছিলেন এবং তিনিই ক্রিমিয়ায় তাতার বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। গীরাই খান নামে পরিচিত তাতার শাসকদের সাথে পোলান্ডের ডিউক ও উসমানীয় তুর্কী সুলতানগণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে ক্রিমিয়া অবস্থিত হওয়ায় এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব সম্পর্কে সবাই সজাগ ছিলেন। বহিঃশত্র“র আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তাতারগণ দু’লাখ সদস্য বিশিষ্ট দূর্ধর্র্ষ সেনাবাহিনী গঠন করেন যার মাধ্যমে পোলান্ড, রাশিয়া ও কোসাকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালিত হয়। এমনকি ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দওলত গিরাই এর নেতৃত্বে তাতার বাহিনী রাশিয়ার জার আইভানকে পরাজিত করে মস্কো নগরী বিধ্বস্ত করে দেয় এবং জারকে কর প্রদানে বাধ্য করে। সে সময় ককেসাস, দাগিস্তান ও রুমালিয়ার উপরও তাতারদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
অবশেষে কৃষ্ণ সাগরের উপর আধিপত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাশিয়ার জারিন ক্যাথারিণ ১৭৩৬ ও ১৭৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়াকে বিধ্বস্ত করে দেয় এবং ১৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে রুশ ও কোসাক বাহিনী ক্রিমিয়ার রাজধানী সিংকোরাপোল দখল করে নেয়। কৃষ্ণ সাগরে রুশদের অবাধে প্রবেশের মহামতি পিটারের দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন ক্রিমিয়া দখলের মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করল। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পাদিত কুচকায়নারজির সন্ধিতে ক্রিমিয়া স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৭৭৪ হতে ১৭৭৬ সাল পর্যন্ত তাতারগন নির্বিঘ্নে ক্রিমিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ব্যবসা বানিজ্য সম্প্রসারন করেন। নিজেদের সন্তানদেরকে তাঁরা উচ্চ শিক্ষার জন্য বুখারার বিখ্যাত মাদ্রাসায় পাঠাতে থাকেন। এমনকি তাতারদের পূর্ব পুরুষগণ যারা খ্রিষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন তাঁরা আবার ইসলাম ধর্মে ফিরে আসেন। কিন্তু তাতারদের এ স্বাধীনতা প্রাপ্তি বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।
পরিশেষে ক্রিমিয়ার খান শাহীন গিরাই এর সাথে তুর্কী সুলতানের মনোমালিন্যের সুযোগে সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ৯ই এপ্রিল জারিনা দ্বিতীয় ক্যাথারিণ ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভূক্ত করে নেন।
উক্ত ঘোষণায় তাতারদের ধর্মীয়, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার অক্ষুন্ন থাকার আশ্বাস দেয়া হলেও তা আদৌ কার্যকর হয়নি। বস্তুত রুশদের অধীনে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিম জাতি গোষ্ঠীর পরবর্তী ইতিহাস বড়ই মর্মন্তুদ ও হৃদয়স্পর্শী। জারদের অনিয়ন্ত্রিত বর্বরতায় তাতারগণ সীমাহীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হন এমনকি জোর পূর্বক তাতারদের ধর্ম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়। নিজেদের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ভিত্তি যখন বিধ্বস্ত হয়ে যায় তখন অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু’লাখ পঞ্চাশ হাজার তাতার মুসলিম নারী-পুরুষ স্বদেশভূমি পরিত্যাগ করে তুরস্ক ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেন। শত নিগ্রহ ও নির্যাতন স্বত্ত্বেও যারা পৈত্রিক বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করেনি তাদের উপর নেমে আসে পৈশাচিকতার খড়গ কৃপাণ। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে এতদঞ্চল সাময়িক ভাবে তুরস্ক ও ইংরেজদের অধীনে চলে যায়। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতি তাতার মুসলমানদের জন্য সৃষ্টি করে নতুন বিপদ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতার অপরাধে ক্রিমিয়ার তাতারদের অভিযুক্ত করা হয়। জার সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জিঘাংসার উন্মত্ততায় নির্বিচারে ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও নিপীড়ন চালিয়ে তাতারদের নির্মূল প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে এ Ethning cleansing অভিযান। ইতিহাসবিদ জি, হ্যান্বলী Central Asia শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ১৭৮৩ খ্রিষ্টাব্দে ক্রিমিয়ায় যেখানে তাতার মুসলমানদের সংখ্যা ছিল পাঁচ লাখ, নির্মূল অভিযানের ফলে ১৯১৭ সালে সে সংখ্যা এসে দাঁড়ায় মাত্র এক লাখে।
নানামূখী অত্যাচার ও নিপীড়নে বিধ্বস্ত হয়েও ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানগণ বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালায়। ইসমাইল বে নামক জাতীয়তাবাদী এক নেতার নেতৃত্বে তাতারদের মধ্যে এক নব জাগরণের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার সমন্বয়ের মাধ্যমে তিনি তাতারদের Pan Islamic আদর্শে সংগঠিত করেন এবং ১৯১৭ সালে ‘মিল্লি ফিরকা’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম দেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘তরজুমান’ পত্রিকা যুবকদের মাঝে ব্যাপক সাড়া জাগায়। গণহারে দেশত্যাগ ও নানাজাতির সংমিশ্রনের ফলে তাতারগণ ক্রিমিয়ায় ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে বলশেভিকগণ ক্রিমিয়াকে সোভিয়েত সোশ্যালিষ্ট রিপাবলিক ইউনিয়নের (USSR) অন্তর্ভূক্ত করে নেয়। ১৯২০ হতে ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট সাত বছর স্বায়ত্বশাসিত প্রজাতন্ত্র হিসেবে ক্রিমিয়া পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ভোগ করে। এমনকি রাশিয়ার কমিউনিষ্ট পার্টি ও মিল্লি ফিরকা কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। তাতার ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয় এবং মুসলমানগণ সরকারী উচ্চপদে নিযুক্তি লাভ করেন। কিন্তু দূর্ভাগ্য ক্রিমিয়ার তাতার মুসলমানদের এ সৌভাগ্য বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে মস্কো সরকার তাতার জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নির্মূল করার জন্য পূর্বাপেক্ষা কঠোরতম পন্থায় আঘাত হানে। তাতার মুসলমানদের স্বাধীনভাবে বাঁচার স্বপ্নসাধ সাময়িকভাবে ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় পুরো তাতার জনগোষ্ঠীকে ষ্ট্যালিন নাজী জার্মানীর দালাল হিসেবে অভিযুক্ত করে প্রতিশোধের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪৪ সালে ষ্ট্যালিন সরকার ক্রিমিয়ান তাতারদের ভাষাকে সিরিলিক (Cyrillic) অক্ষরে পরিবর্র্তিত করে দেয়। রুশ বুদ্ধিজীবিদের মাধ্যমে ক্রিমিয়দের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে মুছে ফেলা হয়। পারিবারিক জীবনে, সামাজিক বন্ধনে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রচন্ডরূপে ধ্বস নামে। অতঃপর শুরু হয় তাতার মুসলমানদের পুনঃ উৎখাতের পালা। ষ্ট্যালিনের নির্দেশে তাতার মুসলমানদেরকে নিজ মাতৃভূমি ক্রিমিয়া হতে জোর করে বের করে দেয়া হয়। বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ, যুবা-বৃদ্ধ ও শিশু গণহত্যার শিকার হয়ে পড়ে। অধিকাংশ তাতার বাস্তু-ভিটা ও সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষত উযবেকিস্তানে উদ্বাস্তু রূপে আশ্রয় নেয়। তাতারগণ সোভিয়েত শাসনের প্রতি ‘অনুগত’ নয় ষ্ট্যালিনের এ যুক্তিই ছিল নির্বাসনের ভিত্তি। তিনি তাতারদের ‘অবিশ্বস্ত নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে, ৫০ হাজার থেকে এক লাখ তাতারকে ষ্ট্যালিন দেশ ত্যাগে বাধ্য করেন। বিপুল সংখ্যক তাতারের জীবন প্রদীপ নিভে যায় কারা অন্তরালে। তখনকার আদমশুমারী অনুযায়ী তাতার মুসলমানদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩ শতাংশে।
ষষ্টদশ ও বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে জার রাশিয়া ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ক্রিমিয়ার জনগণের প্রতি দমন মূলক শাসন ও পক্ষপাতদুষ্ট আর্থ-সামাজিক নীতি গ্রহণ করেও ব্যাপকভাবে এ অঞ্চলকে রুশীয়করণ করতে ব্যর্থ হয়। অধিকাংশ জনগণ রুশ আত্নীকরণকে দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেন এবং ইসলামী পরিচিতি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসলামী অনুশাসন প্রতিপালনের প্রতি দৃঢ়তার ফলে তাতার জনগোষ্ঠী বিভিন্ন সামাজিক পরিমন্ডলে বসবাস করেও একটি ভারসাম্যপূর্ণ রীতি বজায় রাখতে সক্ষম হন। প্রবল বিপত্তি সত্ত্বেও মুসলমান পরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকাকে তাতারগণ গৌরব মনে করেন।
ইতোমধ্যে আড়াই লাখ তাতার স্বদেশে ফিরে আসলেও বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তাঁরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাকীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বাধাগ্রস্থ হয়। সোভিয়েত সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে কিন্তু একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে ক্রিমিয়ার তাতারদের স্বাধীনতা তো দূরের কথা নিজ মাতৃভূমিতে তাদের প্রত্যাবাসনের কাজ টুকু পর্যন্ত সম্পন্ন হয়নি।
★সমসাময়িক★
জাতিসংঘের উদ্বাস্তু বিষয়ক হাই কমিশন (UNHCR) ক্রিমিয়ায় ফিরে আসা তাতার জনগণের গৃহ নির্মাণ সহ পুনর্বাসনের জন্য ২.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করলেও আবাসন সমস্যার তীব্রতা এখনো হৃাস পায়নি। বছরের পর বছর ধরে রাশিয়ানরা তাতারদের বাস্তু-ভিটা ও ব্যবসা-বানিজ্য দখল করে রাখার ফলে মূল মালিকগণ ফিরে আসতে পারছেন না। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশ ও সংগঠন তাতার মুসলিম ভাইদের সাহায্যার্থে এগিয়ে এসেছে সোভিয়েত যুগের অবসানের পর। সউদী সরকারের আমন্ত্রণে প্রতিবছর বহু তাতার পবিত্র হজ্ব ব্রত পালন করে থাকেন। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (UNHCR) তাতার ভাষা, সাহিত্য ও ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন, নির্বাসিত তাতারদের স্বদেশে পুনর্বাসন এবং ক্রিমিয়ায় একটি ইসলামী সেন্টার স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দিয়েছে। তুরস্কের সাথে ক্রিমিয়ার তাতারদের রয়েছে ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। ক্রিমিয়ায় তুরস্কের ২০টিরও বেশী যৌথ অর্থনৈতিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে এবং তাতার ছাত্রদের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়া-লেখার জন্য তুরস্ক সরকারের রয়েছে বিপুল সংখ্যক বৃত্তি। স্বদেশে প্রত্যাবর্তিত তাতারদের গৃহ নির্মান প্রকল্পে অর্থ যুগিয়ে আসছে The Turkish Agency for International Development (TIKA) নামক একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা।
১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়ান মুসলিম কমিটি, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কর্পোরেশন ও যমযম আন্তর্জাতিক ফাউন্ডেশন ক্রিমিয়ার Simferopol জেলার Nizhnegorskoye, Stroganovka I Rodnikovoye অঞ্চলে। ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পূর্বে পুরো ক্রিমি য়ায় মসজিদের সংখ্যা ছিল ১৭৫০, বলশেভিক বিপ্লবের পর তা হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১০০ তে। স্থানীয় ও বাইরের মুসলমানদের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে নতুন মসজিদ, পাঠাগার ও পবিত্র কুর’আন শিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠছে। তাতার মুসলমানদের ব্যাপক দাবী ও বিভিন্ন মুসলিম দেশের অব্যাহত চাপের মুখে ইউক্রেন সরকার তাতারদের বিভিন্ন দাবী-দাওয়া পূরণে ক্রমান্বয়ে এগিয়ে আসছে। ক্রিমিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকার বেশ ক’টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব ক্রিমিয়ায় প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের উদ্দেশ্যে ইউক্রেন ১০ কোটি ডলার ব্যয়ে ১৬৭ মাইল দীর্ঘ পাইপ লাইন নির্মানের কাজ সমাপ্ত করেছে ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি ও উষ্ণ পানি সল্পতার কারণে সৃষ্ট গণ দূর্ভোগের অবসান ঘটবে। শত বছরের বঞ্চনা, নিপীড়ন, হতাশা ও ক্ষোভ সত্ত্বেও তাতারগণ কোন রূপ সহিংসতা ও সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়নি বরং নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। আলোর পথে দৃপ্ত পদে এগিয়ে চলেছে ক্রিমিয়ার তাতার মুসলিম জনগোষ্ঠী। গোটা মুসলিম উম্মাহর রয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতি ।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৪ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 7238
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 7238
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 917
"> রায়হান রহমান লিখেছেন : তো, আপনি যাদের ভাই বলে ডাকেন তারাই কিন্তু ইরাক-আফগানিস্তান-পাপিস্তানে মসজিদে/মসজিদে বোমা মেরে ইসলামের ভাইভাই জিগির কায়েম করে। ধন্যবাদক্রিমিয়াতে বসবাস কারি রূশরা যাদের তথাকথিত ভোটে রাশিয়ার সাথে যুক্ত হলো ক্রিমিয়া তারা বা তাদের পুর্ব পুরুষ মাত্র ৭০-৮০ বছর আগে ক্রিমিয়াতে বসতি স্থাপন করেছিল। ক্রিমিয়ার আদি বাসিন্দা তাতার মুসলিম রাই। সেবাস্তপোল এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রনে একমাত্র বন্দর যেটা সারাবছর ব্যাহারউপযোগি থাকে। যদিও এর আর্ন্তজাতিক ব্যবহার তুরুস্কের উপর নির্ভরশিল। রাশিয়াকে ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রন দেয়ার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার নিয়ন্ত্রন নিতে পারে। অন্যদিকে তুরুস্কের পুর্ব আনতোলিয়াতেও আর্মেনিয় রুশ দের নিয়ে এই ধরনের একটি চেষ্টা চলছে। রাশিয়া তার সোভিয়েট সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার এর চেষ্টায় রত। ইইউর নিষেধাজ্ঞাটি মনে হয় স্রেফ ইউক্রাইন এর জনগন কে শান্ত রাখার জন্য।
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন