ওলংগং
লিখেছেন লিখেছেন দ্য স্লেভ ২৪ জুলাই, ২০১৩, ১০:৫৮:০৪ সকাল
ওলংগং হল সিডনী থেকে ৮২ কি:মি: দক্ষিনে অবস্থিত সাগর পাড়ের একটি শহর। গাড়িতে গেলে একটু বেশী পথ। এক রবিবারে আমরা রওনা হলাম। হাইওয়েতে ১১০কি:মি: গতিতে আমরা চললাম। লক্ষ্য করলাম হাইওয়ের অনেক স্থানে স্বয়ংক্রিয় গতি পরিমাপক যন্ত্র বসানো রয়েছে। পুলিশ এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন বাঁকে এগুলো স্থাপন করে চলমান গাড়ীগুলোর ওপর কড়া নজরদারী আরোপ করা যায়। হাইওয়েতে চলার কিছু নিয়ম আছে যা রাস্তার ওপর অঙ্কিত দাগ,নির্দেশনা দেখে বোঝা যায়। আর পরিপূর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে চার/পাচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। পরিক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হলে পরবর্তী এক বছরের জন্যে তার জন্যে লাল রঙের ‘পি’ বা প্রাথমিক স্তরের চালক হিসেবে ছাড়পত্র প্রদান করা হয়। এই লাল রঙের ‘পি’ গাড়ির সামনে ও পেছনের অংশে লাগিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক। পরবর্তী এক বছর পর্যন্ত তিনি হাইওয়েতে সর্বোচ্চ ৯০কি:মি: গতিতে চালাতে পারবেন,তার উর্ধ্বে নয়। এরপর তাকে আবার পরিক্ষা দিতে হবে পরবর্তী বছরে। পাশ করলে এবার পাবে সবুজ ‘পি’। এসময়ে হাইওয়েতে ঘন্টায় সর্বোচ্চ ১০০কি:মি: গতিতে চালাতে পারবে। এরপর আরেকটি পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হলে সে হাইওয়ের সর্বোচ্চ গতিসীমা অনুযায়ী চালাতে সক্ষম হবে। তবে তাকে ১২পয়েন্ট ধরিয়ে দেওয়া হবে। সিগন্যাল লাইট অমান্য করলে,রোড একসিডেন্ট করলে,রাস্তার নির্দিষ্ট গতিসীমার বেশী গতিতে গাড়ি চালালে,চলন্ত অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বললে,নিয়ম বহির্ভূতভাবে ওভারটেক করলে এবং আরও কিছু ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করলে নির্দিষ্ট হারে পয়েন্ট কাটতে থাকবে এবং বড় অংকের জরিমানা গুনতে হবে। এভাবে তিন বছরে যদি তার পুরো পয়েন্ট কাটা যায় তাহলে তাকে আবার পরিক্ষা দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে অথবা তারা বিবেচনা করবেন অথবা অবস্থা বিবেচনায় তার লাইসেন্স পুরো বাতিলও হতে পারে। উল্লেখ্য ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করলে ৩ পয়েন্ট কাটা। আর মাতাল হয়ে গাড়ি চালালে যদি ধরা পড়েন তাহলে অনেক বেশী টাকা জরিমানা গুনতে হয় এবং লাইসেন্স পুরোপুরি বাতিল হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। এ কারনে অস্ট্রেলিয়ায় মানুষ অনেক সাবধানে গাড়ি চালিয়ে থাকে। তারপরও সড়ক দূর্ঘটনা ঘটে থাকে।
কেউ মদ খেয়ে গাড়ি চালালে পুলিশের সন্দেহ হলে তাকে থামিয়ে বিশেষ যন্ত্রের সামনে এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনতে বলে। এক থেকে তিন পর্যন্ত গেলেই যন্ত্র বলে দেয় সে এ্যালকোহল পান করেছে কিনা। রাস্তায় যে সিগন্যাল বাতি রয়েছে,তার ভেতরে বিশেষ ক্যামেরা স্থাপন করা আছে। প্রচন্ড গতিতে পার হয়ে গেলেও সেটা ড্রাইভার,গাড়ি সম্পর্কে সঠিক তথ্য ধারন করতে পারে। পুলিশের কাছে এমন যন্ত্র আছে যা চাকার সাথে লাগিয়ে বোঝা সম্ভব কিছুক্ষন পূর্বে এটি কত দ্রুত চলেছে। ফলে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তা যথেষ্ট কম।
রাস্তার বিভিন্ন মোড়ে পুলিশ গাড়ি নিয়ে বসে থাকে বা টহল দেয়। হাইওয়েতে দূর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশী থাকাতে পুলিশ সেখানে বেশী তৎপর। অনেক রাস্তার বাঁকে পুলিশ গোপনে যন্ত্রপাতি নিয়ে বসে থাকে। কেউ গতিসীমা অতিক্রম করলে তাকে তাড়া করে। যে সকল হাইওয়ের মাঝখানে কোনো ডিভাইডার নেই সেসকল হাইওয়েতে সাদা রঙের দাগ দিয়ে চিহ্নিত করা আছে কিভাবে তারা ওভারটেক করবে। কিছু দাগের অর্থ এপাশের যানগুলো এখন ওভারটেক করতে পারবে,কিছু দাগের অর্থ এই পরিমান দূরত্বের মধ্যে ওপাশের যানগুলো ওভারটেক করতে পারবে। আর কিছু দাগের অর্থ দুপাশের যানগুলো ওভারটেক করতে পারবে।
আইন অমান্যকারী চালকদেরকে পুলিশ আটক করে শাস্তি প্রদান করে। এসকল আদায়কৃত জরিমানার বড় অংশই উক্ত পুলিশ টিম বা পুলিশটি পেয়ে থাকে। কিন্তু এমন অভিযোগ পাওয়া যায়না যে,অর্থের লোভে তারা নিয়ম বহির্ভূতভাবে গাড়ি থামিয়েছে। কেউ নির্দেশ অমান্য করে গাড়ি না থামিয়ে কেটে পড়তে চাইলে প্রয়োজনে এরা আকাশে হেলিকপ্টার ওঠায় এবং ধাওয়া করে ধরে ফেলে। প্রযুক্তি,নিষ্ঠা,সততার কারনে এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেশ ভাল। তারপরও অপরাধ থেমে নেই।
আমরা বেশ কয়েকটি গাড়িকে আটক করতে দেখলাম। চলার পথে ডানে বামে ইউক্যালিপটাসের বন দেখলাম। বনের বেতর দিয়ে প্রশস্ত রাস্তা চলে গেছে। ওলংগং যেতে যেসকল রাস্তার ওপর দিয়ে গেলাম তা ছিল দেখার মত। এরা এতটা যতœ করে রাস্তা তৈরী করেছে,না দেখলে বিশ্বাস হয়না। রাস্তার সৌন্দর্য বর্ধনে সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থাই নিয়েছে। কোথাও পাথরের পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরী করা হয়েছে। সেসকল স্থানে পাহাড়কে এমনভাবে রক্ষ করা হয়েছে যাতে তা ভেঙে রাস্তার ওপর না পড়ে। কোথাও পাথরের ব্লক দিয়ে রাস্তার দুপাশ বাধানো এবং অনেক স্থানে তার ওপর তারের বেষ্টনীও রয়েছে। কোথাও সবুজ মাঠ এবং তার ভেতর পাইনসহ অনেক রকমের গাছ। সেগুলোর বুক চীরে রাস্তা চলে গেছে। কোথাও পাহাড়ী উচু নীচু রাস্তা এবং সবুজে ঢাকা টিলা। কখনও পাহাড়ের ওপর ব্রিজ। প্রশস্ত ,নতুন চকচকে রাস্তা। রাস্তার সৌন্দর্যই যেন আসল।
আমরা রাস্তা ভুলে গেলাম। সমস্যা নেই। এখানে চলার পথে সরকারী তথ্যকেন্দ্র রয়েছে। সেখান থেকে যে কোনো বিষয়ে ম্যাপ সম্বলিত বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে । সকল সার্ভিস একেবারে ফ্রি। আমরা তথ্য নিলাম এবং একটি যাত্রা বিরতীও করলাম। অনেকক্ষন চলার পর ওলংগং চলে এসেছি। আমরা পাহাড়ি এলাকার ওপর দিয়ে যাচ্ছি। ওলংগং এখান থেকে অনেক নীচে। আমরা বুল্লী পার্ক নামক স্থানে একটি যাত্রা বিরতী করলাম। এখানে রাস্তার পাশে একটি লুকআউট আছে। সেখান থেকে নীচের দিকে তাকালে পুরো ওলংগঙের বেশীরভাগ এলাকা দেখা যায়। ওপর থেকে সেটা দেখতে চমৎকার। আমরা ওপর থেকে দেখলাম পাহাড়ী বনভূমী ক্রমশ নীচের দিকে চলে গেছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। এখানে লম্বা লম্বা সুপারী গাছের মত গাছ দেখলাম।
এখানে একটা বিষয় দেখে বেশ হাসি পেল। একটা টং ঘরের মত স্থান দেখলাম যার নীচের দিকে একটি পানিভর্তী বড় পাত্র। ওপরে লেখা আছে উইশ করার জন্যে। তারমানে মানতের স্থান। কোনো কিছু পাওয়ার জন্যে এখানে ডলার ফেলতে হবে। পীরের দরগায় টাকা-পয়সা,শিরনী দেওয়ার অনুরূপ বিষয় মনে হল। একেবারে নাস্তিকরাও অনেক সময় এমন কিছু করে ফেলে যার ফলাফল দাড়ায় কর্মের মাধ্যমে তারা কখনও কখনও ইশ্বরকে মানে। এরা অবশ্য আস্তিক,তবে যারা এখানে পয়সা ফেলে কল্যাণ কামনা করে,তারা আমাদের দেশীয় ভাষায় খাজাবাবা পন্থী। অবশ্য খাজা বাবারা বংশানুক্রমিকভাবে পয়সার সরবরাহ লাইন পরিষ্কারের সুবিধার্তে নানান নিয়ম-কানুন,বিধি বিধান তৈরী করে তা গেলায়,এরা সেরকম কিছু করেনা। এখানে পয়সা নেওয়ার জন্যে কোনো মুরীদও নেই। তবে পয়সা যাতে কেউ উঠিয়ে নিতে না পারে তার জন্যে পানিভর্তী পাত্রের ওপর একটি লোহার গ্রিল ঢাকনী হিসেবে রয়েছে। ভেতরে তাকিয়ে দেখলাম অনেক পয়সা। ভক্তকূল একেবারে কম নয়।
চলমান....
বিষয়: বিবিধ
২৩৬১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন