অতিথি পাখি অতিথি নয়!
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২০ ডিসেম্বর, ২০১৫, ১১:১৩:১৪ রাত
অতিথি দাওয়াতে ও হওয়া যায় কিবা বিনা দাওয়াতেও! কিন্তু কারো যদি জিবিকার প্রয়োজনে বছরের নির্দৃষ্ট একটি সময় এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় কাটাতে হয় তাকে অথিতি বলা যায় কি??? বাংলাদেশের অনেক গ্রামিন কৃষি শ্রমিক আছেন যারা ফসল বোনা ও কাটার সময় থাকেন এক জায়গায়। আবার ফসল উঠার পর জিবিকার সন্ধানে চলে যান কোন শহরে। নিজেদের বাড়ি থাকলেও এরা জিবিকার প্রয়োজনে ভিন্ন এলাকায় গিয়ে সাময়িক বসত গড়েন। অনেকেই পরিবার সহ যান। এদের কে কিন্তু কেউ অতিথি বলেনা। বরং অনেকেই এই দরিদ্র কর্মি মানুষদের অসন্মান করে থাকেন। পৃথিবিতে আরব, সাহারা, তিব্বত সহ অনেক দেশেই এমন বেদুইন আছেন। আমাদের দেশেও বেদে সম্প্রদায় আছে যারা একেক ঋতুতে এক এক এলাকায় কাটায়।
অথচ প্রতিবছর শিতের শুরুতেই আমাদের দেশের মিডিয়া তে অতিথি পাখি বলে একটা শব্দ নিয়ে প্রচন্ড চাপাবাজি শুরু হয়। শহরেরর এয়ারকন্ডিশন রুমে বসে কিছু উর্বর মস্তিষ্ক সাংবাদিক এ্ই অতিথি পাখিদের জন্য মায়াকান্নায় ভরিয়ে তুলেন কলাম এর পর কলাম। রাস্তায় মানব বন্ধন থেকে অনেক কিছুই হয় এদের নিয়ে। এই তথাকথিত অতিথি পাখিদের নিয়ে যত চিন্তা করা হয় আমাদের দেশে সবসময় বসবাসকারি পাখিদের নিয়ে কিন্তু তার শতাংশও লিখা হয়না!
আসলে অতিথি পাখি শব্দটাই ভুল। এই পাখিগুলি যেগুলি বিভিন্ন ঋতুতে স্থান বদল করে বসবাস করে তাদের কে ইংরেজিতে বলা হয় মাইগ্রেটরি বার্ডস। যার সঠিক বাংলা হবে পরিযায়ি পাখি। গবেষনায় দেখা গেছে পৃথিবির প্রায় ২০ শতাংশ পাখি পরিযায়ি। এদের কিছু সল্প মাত্রার পরিযায়ি এবং কিছু দির্ঘমাত্রার। সল্পমাত্রার পরিযায়ি পাখিরা তাদের স্থায়ি বাসস্থান এই বেশিরভাগ সময় অবস্থান করে কিন্তু খাদ্যের সন্ধানে তারা কখনও কখনও কিছু দিন এর জন্য স্থান বদল করে। তবে আবার ফিরে আসে। এদের সাধারনত নিদৃষ্ট ঋতু নাই। অন্যদিকে দির্ঘ মাত্রার পরিযায়ি পাখিরা সবসসময়ই বছর এর নিদৃষ্ট সময় ভিন্ন এলাকায় বসবাস করে। শুধু পাখিই নয় অন্যান্য প্রানির মধ্যেও এই পরিযানতা বর্তমান। অনেক পাখি এই পরিযানতার জন্য কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ভ্রমন করে। এমনকি দেখা যায় যে একবার যে এলাকায় একটি ঝাঁক এসেছে পরবর্তিতেও সেই একই এলাকায় আসে। এরা কিভাবে পথ চেনে এটা এখনও গবেষনার বিষয়। তবে অনুমান করা হয় পৃথিবির চুম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করেই এই পাখি গুলি পথ নির্নয় করে থাকে।
বাংলাদেশে প্রতিবছরই বেশ কিছু হাঁস জাতিয় পাখি শিতকালে দেখা যায় যেগুলি বছরের অন্য সময় প্রায়ই দেখা যায়না। এই পাখিগুলির বেশিরভাগই উত্তর গোলার্ধে গ্রিষ্মকালিন সময়টি হিমালয় এর উত্তর অংশ তথা মঙ্গোলিয়া থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত এলাকায় বসবাস করে। গ্রিষ্মকালে এই অঞ্চল গুলিতে নতুন নতুন উদ্ভিদ সহ পোকামাকড় এর জন্ম হয় যা এই পাখিগুলির প্রধান খাদ্য। কিন্তু শিতকালে এই পাখিগুলির প্রয়োজনিয় খাদ্য এর অভাব ঘটে। এছাড়া এই পাখিগুলি অধিক শিত সহ্য করার উপযোগি হয়না । তাই শিতের শুরুতে এই পাখি গুলি অপেক্ষাকৃত নাতিশিতোষ্ণ অঞ্চল এর দিতে তথা বিষুবরেখার নিকটবর্তি অঞ্চলে চলে আসে। এই সব অঞ্চলে শিত পড়লেও বরফ জমেনা ও তুষারপাত প্রায় হয়না বলে এই পাখিগুলির জন্য প্রয়োজনিয় খাদ্য পাওয়া যায়। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই এই পাখিগুলি এই সব এলাকার পরিবেশ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়।
এই পাখিগুলি পরিবেশ এর ক্ষতিতেও অংশ নেয়। পাখির মাধ্যমে রোগ ছড়ায় স্থানিয় জাতের পাখিতেও। এভিয়ান ইনফ্লুঞ্জেয়া বা বার্ড ফ্লু রোগটি আমাদের দেশের গৃহপালিত পাখির মধ্যে কিন্তু এই অতিথি পাখির মাধ্যমেই ছড়িয়েছিল।এছাড়া এই পাখিগুলি অনেক সময় ক্ষেতের ফসল ও নষ্ট করে থাকে। পরিবেশ এর স্বাভাবিক খাদ্য চক্র বজায় রাখার জন্য এই পাখিগুলির কিছু অংশ কে শিকার করা বা খাদ্য হিসেবে গ্রহন করা হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই। এতে এই পাখিগুলির কোন ক্ষতি হয়না। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের হাঁস ছাড়াও দেশিয় পাখি বলে পরিচিত খঞ্জনা বা চটক পাখিও কিন্তু শিত এর সময় আসে। প্রধানত নিলশির,লালশির জাতিয় হাঁস কেই অতিথিপাখি মনে করা হয়।
পরিযায়ি পাখি কে অতিথি পাখি বলা একটি বড় ধরনের ভুল। কারন এই পাখিগুলি আসলে বিদেশি পাখি নয়। এগুলি আমাদের দেশিয় পাখিই। কারন পরিবেশ এর জন্য এই পাখিগুলি প্রতিবছর ই আমাদের দেশ সহ অন্যান্য বিষুব রেখার কাছাকাছি দেশগুলিতে আসে। এরা নির্দৃষ্ট সময় এই দেশগুলিতেই থাকে এবং নিজেরা বাসা বাঁধে। অন্য পাখির বাসায় আশ্রয় নেয় না!
এটা ঠিক যে আমাদের দেশে এখন এই পরিযায়ি পাখির আগমন অনেক কমে গেছে। কিন্তু শিকার বা পাখিগুলি কে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা এর কারন নয়। এর প্রধান একটি কারন হচ্ছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। পৃথিবির গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে এখন অনেক উত্তরেও শিতকালে উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। যে শিত থেকে বাঁচার জন্য এই পাখিরা দক্ষিন দিকে আসে সেই শিত এর প্রভাব কম ও প্রয়োজনিয় খাদ্য পাওয়ায় তারা আর এই দিকে আসেনা। তিব্বত কিংবা হিমালয় এর দক্ষিন ঢালে আসতে পারলেই তাদের বসবাস এর উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে যায়। এছাড়া আমাদের দেশে পাখিদের বিচরন এর উপযুক্ত খোলা জলাশয় ও বন জঙ্গল এর হ্রাস হওয়া ও এর একটি কারন। এছাড়া তথাকথিত আধুনিক বনায়ন এর নামে আমরা যে ইউক্যালিপটাস,একাশিয়া বা মেহগনি জাতিয় গাছ লাগাচ্ছি সেই গাছগুলির সাথেও এই পাখিগুলি পরিচিত নয় এবং তারা এই গাছ গুলি থেকে তাদের জিবন ধারনের প্রয়োজনিয় উপকরন পায়না। এই কারনেও তাদের এই দেশে আগমন অনেক কমে গেছে।
বাংলাদেশে যে সব পরিযায়ি পাখি আসে তাদের একটি বড় অংশই আসে শিতল সাইবেরিয়া থেকে। সাইবেরিয়ান ডাক রোষ্ট একটি বিখ্যাত খাবার। সাইবেরিয়ার মানুষ এর প্রধান খাদ্য গুলির অন্যতম এই ধরনের পাখি। এই শিকার এই পাখিগুলির সংখ্যা নিয়ন্ত্রনে বিশেষ ভুমিকা পালন করে। নয়তো পাখির খাদ্যাভাব দেখা যাবে।
তথাকথিত অতিথি পাখি নিয়ে আবেগ প্রদর্শন এর চেয়ে আমাদের উচিত সকল ধরনের পাখির জন্য প্রয়োজনিয় আবাসস্থল সংরক্ষন এবং পরিবেশ এর ভারসাম্য বজায় রেখে এদের রক্ষাবেক্ষন এর ব্যবস্থা করা। যেহেতু শিতের সময় এই দেশে পরিযায়ি পাখি সহ দেশিয় পাখি দেখা যায় তাই এই সময়টি বার্ড ওয়াচিং এর একটি ভাল সময়। সকলেই সময় করে উপযুক্ত জায়গায় এই পাখি দেখুন। আল্লাহতায়লার এই সুন্দর সৃষ্টি অবশ্যই আপনাকে আপ্লুত করবে। শুধু পরিহার করুন এই অতিথি পাখি সংরক্ষন এর নামে ফালতু আবেগ। এরা আমাদের পরিবেশ এরি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
*ছবিটি কালোমুখ হাঁস এর। এরা সাধারনত শিত কালে আসে। তবে কিছু হাঁস অন্য সময় ও থেকে যায়। এটাও পরিযায়ি পাখিদের একটি বৈশিষ্ট।
বিষয়: বিবিধ
২২৮০ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লেখাটি সম্পাদনা করা হয়নি তাই বানান সমস্যা বেশি তবে কিছু ক্ষেত্রে আমি এই বানান ই অনুসরন করে থাকি। বাংলা একাডেমি সহজ বানান নিতি অনুসারে এটা সঠিক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন